বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি
বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি
মারকে পরাভূত করিয়া বোধিসত্ব ধ্যানে নিরত হইলেন। পৃথিবীর সর্ব প্রকার দুঃখ, কুকর্মোদ্ভূত অশুভ এবং তজ্জনিত যাতনা, তাহার মনশ্চক্ষু অতি ক্রম করিয়া গেল। তিনি চিন্তা করিলেন: “যদি প্রাণী সমূহ তাহাদের কুকর্ম জনিত ফল দেখিতে পাইত তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাহারা অসৎ কর্মে বীতস্পৃহ হইত। কিন্তু আত্মাভিমান দ্বারা অন্ধ হইয়া তাহার হীন বাসনার দাস।
“ভোগাস হইয়া তাহার ক্লেশ পায়; মৃত্যু তে যখন তাহাদের ব্যক্তিত্ব ধ্বংস হয়, তখন তাহারা শান্তি পায় না; জন্মের জন্য তাহাদের তৃষ্ণা অটল ভাবে বর্তমান থাকে এবং পুনর্জন্মে তাহাদের আত্মত্ত্ব প্রকাশ পায়। “এই রূপে কুণ্ডলী ভূত হইয়া তাহারা নিজকৃত নিয়ে হইতে মুক্তি পায় না। অথচ ভোগ জনিত সুখ এবং তাহাদের প্রয়াস সম্পূর্ণ রূপে অন্তঃসার শূন্য, কদলী বৃক্ষ ও জল বৃদ্ধ দের ন্যায় সার হীন।
আরো দেখুন: উরুবিল্ব
আরো দেখুন: মুক্তির প্রমানন্দ
![]() |
বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি |
“জগত পাপ ও দুঃখের আগার, যে হেতু ইহা ভ্রান্তি পূর্ণ। মানুষ পথ ভ্রষ্ট হয়, যে হেতু তাহারা মোহ কে সত্য অপেক্ষা শ্রেয়: জ্ঞান করে। সত্যের অনুসরণ না করিয়া তাহারা ভ্রান্তির অনুগামী হয়। এই ভ্রান্ত পথ প্রারন্তের সুখকর জ্ঞান হয়, কিন্তু ইহা উদ্বেগ, সন্তাপ ও দুঃখের জনক।” তৎপরে বোধিসত্ত্ব ‘ধর্ম’ ব্যাখ্যা আরম্ভ করিলেন।
ধর্মেই সত্য
নিহিত। ধর্মই পবিত্র বিধি। ধর্মই ধর্ম। এক মাত্র ধর্মই আমাদিগ কে ভ্রান্তি, পাপ ও দুঃখ
হইতে মুক্ত করিতে পারে। জন্ম ও মৃত্যুর
মুল সম্বন্ধে চিন্তা করিয়া বুদ্ধ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে, অবিদ্যা সমুদয়
অমঙ্গলের মূলীভূত। জীবনের বিকাশে যাহারা দ্বাদশবিধি নিদান বলিয়া কথিত হয়, সেইগুলি
এই: প্রারম্ভে জীবন অন্ধ ও জ্ঞান হীন; এই অবিদ্যার সমুদ্রই নানা স্বাভাবিক
প্রবৃত্তির জনক।
ঐ সকল প্রবৃত্তি সৃষ্টি ও গঠন ক্ষম। এই সকল সৃষ্টি ও গঠন ক্ষম স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হইতে চৈতন্য কিম্বা সংজ্ঞার উৎপত্তি। চৈতন্য হইতে ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট জীবের উৎপত্তি, উহারাই ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীতে পরিণত হয়; ঐ জীব সমূহের দেহে পঞ্চেন্দ্রিয় এবং মন বিকশিত হয়। পঞ্চেন্দ্রিয় ও মন বস্তু সমূহের সহিত সংস্পর্শে আনীত হয়। সংস্পর্শ হইতে অনু ভূতির উৎপত্তি। অনুভূতি তৃষ্ণার জনক।
জীবনের
তৃষ্ণা হইতে বস্তু তে আসক্তি উৎপন্ন হয়। এই আসক্তি হইতে আত্মাভিমানের উৎপত্তি ও
প্রসারণ। আত্মাভিমান পুনর্জন্মে অবসিত হয়। এই পুনর্জন্মই ক্লেশ, বার্ধক্য, ব্যাধি এবং মৃত্যুর কারণ। বিলাপ, উদ্বেগ, ও নৈরাশ্য উহা হইতেই উৎপন্ন হয়। দুঃখের কারণ আদিতে; যে অবিদ্যা হইতে জীবনের
উৎপত্তি উহা সেই অবিদ্যায় অন্তর্নিহিত।
অবিস্তার ধংস সাধন কর, উহা হইতে উৎপন্ন দুই বৃত্তিও ধ্বংস হইবে। ঐ সকল বৃত্তির উন্মলন কর, উহা হইতে উৎপন্ন ভ্রান্ত অনু ভূতিও উন্মলিত হইবে। ভ্রান্ত অনু ভূতির উচ্ছেদ সাধনে বিভিন্ন জীবের ভ্রম দূর হইবে। ঐ সকল ভ্রমের ধ্বংস সাধন করিলে পঞ্চেন্দ্রিয়ের মোহও অপসারিত হইবে।
মেহের
অবসানে বস্তুর সহিত সংস্পর্শ হইতে আর ভ্রান্ত সংস্কার উৎপন্ন হইবে না। ভ্রান্ত সংস্কারের উচ্ছেদনে তৃষ্ণা দূরী ভুত
হইবে। তৃষ্ণার নাশ হইলে দুষ্ট আসক্তি নষ্ট হইবে। দুষ্টা সক্তির দূরী করণে
আত্মাভিমানের স্বার্থ পরতা দূর হইবে। আত্মাভিমানের
স্বার্থ পরতা বিনষ্ট হইলেই জন্ম, বার্ধক্য, ব্যাধি, মৃত্যু এবং সর্ব প্রকার ক্লেশ
হইতে মুক্তি।
ভগবান বুদ্ধ নির্বাণের পথ প্রদর্শন কারী চতুরঙ্গ সত্য উপলব্ধি করিলেন: দুঃখের অস্তিত্ব প্রথম সত্য। জন্ম দুঃখ, দেহের বৃদ্ধি দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ। যাহা অকাম্য তাহার সহিত মিলিত হওয়া দুঃখ। প্রিয় বন্ধুর সহিত বিচ্ছেদ গভীরতর দুঃখ। যাহা দুষ্প্রাপ্য তাহার জন্য আকাক্ষা দুঃখ।দুঃখের কারণ দ্বিতীয় সত্য।
দুঃখেয় কারণ লালসা। অনু ভূতি চতুষ্পার্শ্বস্থ জগৎ কর্তৃক বাস্তবিত হইয়া
তৃষ্ণার উৎপাদন করে; উৎপত্তি মাত্র তৃষ্ণা তৃপ্তির প্রার্থী হয়। আত্মাভিমানের মোহ উৎপন্ন হইয়া বস্তু তে আসক্তি রূপে
প্রকাশিত হয়। ভোগ সুখের লাল সায় প্রাণ ধারণের
বাসনা মানুষ কে দুঃখ পাশে বন্ধ করে। ভোগ প্রলোভন,
উহা দুঃখের জনক।
দুঃখের নিবৃত্তি তৃতীয় সত্য। যিনি আত্মাভিমান দমন করিয়াছেন, তিনি লালসা মুক্ত হইবেন। তাহার আর আসক্তি নাই; বাসনার অগ্নি প্রজ্জলিত হইবার কোন উপাদান নাই। এই রূপে সে অগ্নি নির্বাপিত হইবে। দুঃখের নিবৃত্তির পথ প্রদর্শক অষ্টাঙ্গ মার্গ চতুর্থ সত্য। সত্যের সম্মুখে যিনি আত্মাভিমান কে বলি দিতে পারেন, যাহার ইচ্ছা শক্তি কর্তব্যে প্রযোজিত হয়, যাঁহার এক মাত্র বাসনা কর্তব্য পালন, তিনি মুক্ত হইবেন।
জ্ঞানী এই মার্গ
অবলম্বন করিয়া দুঃখের বিনাশ সাধন করিবেন। অষ্টাঙ্গ
মার্গ এই: (১) যথার্থ বোধ; (২) যথার্থ সংকল্প, (৩) যথার্থ উক্তি; (৪) যথার্থ
কার্য; (৫) ন্যায় উপায়ে জীবিকা নির্বাহ; (৬) যথার্থ উদ্যম, (৭) যথার্থ চিন্তা; এবং
(৮) প্রশান্ত মানসিক অবস্থা।
ইহাই ধর্ম। ইহাই সত্য। এই ‘ধর্ম’ই ধর্ম। তৎপরে বুদ্ধ এই শ্লোকটি আবৃত্তি করিলেন: ‘ভ্রমিয়াছি বহু দিন। বাসনা শৃঙ্খলে বদ্ধ জন্ম জন্মান্তরে খুঁজিয়াছি বৃথা; কোথা হই তে আসে এই অশান্তি নরের? অহঙ্কার বেদনার কারণ কোথায়? অসহ্ন সংসার দুঃখ মৃত্যু ঘেরে যবে নরে! পাইয়াছি! পাইয়াছি এবে! অন্মিতার মূল তুই, তুইরে আসক্তি, নাহি চাহি তোরে আর।
ভগ্ন এবে পাপা গার; দূরী ভূত যতেক উত্বেগ,
নির্বাণে প্রবিষ্ট চিত্ত আকাক্ষারে করি পরাজয়।” আত্মাভিমান ও সত্য উভয়ই বৰ্ত্তমান। যেখানে আত্মাভিমান সেখানে সত্য নাই। যেখানে সত্য সেখানে আত্মাভিমান নাই। আত্মাভিমান সংসারের ক্ষণ স্থায়ী ভ্রান্তি;
স্বাতন্ত্র জ্ঞান ও অস্মিত হইতে হিংসা ও দ্বেষ উদ্ৰিক্ত হয়।
ভোগের আকাঙ্ক্ষা ও বৃথা আড়ম্বরের বাসনাই আত্মাভিমান। বস্তু সমুহের যথার্থ জ্ঞানই সত্য; ইহা চিরস্থায়ী ও অনন্ত বিশ্বের সার, পবিত্র তার পরমানন্দ। স্বার্থের অস্তিত্ব মোহ মাত্র। এমন কোন অন্যায় নাই, কোন অধর্ম নাই, কোন পাপ নাই, যাহা আত্মাভিমান হইতে উদ্ভূত নয়।স্বার্থের অস্তিত্ব যখন মোহ বলিয়া স্বীকৃত হয়, মাত্র তখনই সত্যের উপলব্ধি সন্ধব।
চিত্ত যখন অহঙ্কার হইতে মুক্ত হয়, মাত্র তখনই পবিত্র তার আচরণ সম্ভব। যিনি ‘ধর্ম’ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন, তিনি ধন্য। যিনি প্রাণী হিংসায় বিরত, তিনি ধন্য। যিনি পাপ কে জয় করিয়াছেন এবং হিংসা দ্বেষাদি হইতে মুক্ত, যিনি স্বার্থ পরতা ও বৃথা গর্ব পরি ত্যাগ, ধন্য, পবিত্র তার আধার বুদ্ধ। বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি সমাপ্ত।