মানব জীবন

 মানব জীবন

যখন জনম নিয়া এসেছিল ভবে

একা তুমি কেঁদে ছিলে হেসে ছিল সবে।

এভাবে জীবন তুমি কর হে যাপন

মৃত্যু কালে হাস যেন কাঁদে সর্ব জন।

বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে একত্রিশ লোক নিয়ে এক চক্র বাল (বিশ্ব)।  তেমন গণনা তীত চক্র বাল বিদ্যমান।  এই একত্রিশ লোকের মধ্যে কাম লোক এগার, রূপ লোক ষোল এবং অরূপ লোক চার।  এগার কাম লোকের মধ্যে নরক, প্রেত, অসুর ও তির্যক এই চারি দুর্গতি ভূমি এবং মনুষ্য লোক ও ছয় স্বর্গ এর সাত সুগতি ভূমি।  প্রাণীগণ আপন কুশলা কুশল কর্মানু সারে উক্ত লোক সমূহে উৎপন্ন হয়ে।  সুখ দুঃখ ভোগ করে।  ঐ লোক সমূহের একটিও নিত্য নহে বলে উহারা দুঃখ সত্য এর অন্তর্গত।  সর্ব প্রকার দুঃখকে অতি ক্রম করাই মুক্তি, শান্তি বা নির্বাণ ।


আরো দেখুন: দেবদূত সূত্র

আরো দেখুন: বুদ্ধের ১২টি কর্ম বিপাক

 

মানব জীবন

মানব জীবন

চারি দুর্গতি ভূমি, চারি দুর্গতিতে উৎপন্ন প্রাণী বিপুল দুঃখ বিপাক ভোগ করে।  পুণ্য কর বার অবকাশ পায় না।  চারি অরূপ ব্ৰহ্ম লোক অরূপ (নিরাকার) ব্রহ্ম লোক দেহের অভাবে ব্ৰহ্মাগণ ধর্ম শ্রবণাদি করতে পারেন না, তাঁদের ধ্যান কর্মের বিপাকই সুদীর্ঘ কাল ভোগ করেন মাত্র। কিংবা রূপ লোকের অসংজ্ঞ সত্ত্ব লোক অসংজ্ঞ ব্রহ্ম লোকে ব্রহ্মাদের ধ্যান কর্মানু সারে প্রাণ হীন বিরাট দেহই উৎপন্ন হয় এবং সুদীর্ঘ কাল স্থিত থাকে।  উৎপন্ন হলে, অহেতুক প্রতিসন্ধি যুক্ত মানুষ অলোভ ও অদ্বেষ এই দুই হেতু যুক্ত দুর্বল কুশল কর্মের দ্বারা মনুষ্য লোকে অহেতুক প্রতিসন্ধি (জন্ম) হয়ে থাকে। 

 

হলে এবং ত্রিহেতুক প্রতিসন্ধি যুক্ত মানুষ অলোভ অদ্বেষ ও অমোহ এই তিন হেতু যুক্ত সবল কুশল কর্ম মনুষ্য ও দেবলোকে ত্ৰিহেতুক প্রতিসন্ধি দিয়ে থাকে।  হলে ও প্রত্যন্ত দেশে যে প্রদেশে জ্ঞানী ভিক্ষু নেই, সদ্ধর্মের চর্চার অভাব এবং অধর্মের প্রাবল্য বেশী।  জন্ম হলে, মিথ্যা দৃষ্টি ঈশ্বরই সব করেছেন এবং করাচ্ছেন বা প্রাকৃতিক নিয়মেই সব হচ্ছে এরূপ বিশ্বাসী।  এবং কর্ম ফলে অবিশ্বাসী নিয়ত মিথ্যা দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিই এখানে অভি প্রেত।  সম্পন্ন হলে এবং বুদ্ধের অনুৎপত্তিতে বুদ্ধের অনুৎপত্তি কালে নির্বাণ মার্গ অজ্ঞাত থাকে।  উৎপন্ন হলে প্রাণী পুণ্যার্জন করতে পারে না।  

 

এই কারণে এই সব লোকে, অবস্থায় ও সময়ে উৎপত্তিকে বৌদ্ধ শাস্ত্রে অক্ষণে উৎপত্তি বলা হয়।  এই অক্ষণ মুক্ত মানব জীবন লাভ পরম দুর্লভ। সঞ্চিত সম্পত্তি ভোগের ন্যায় পুণ্য ফল ভোগী সত্ত্বগণ দেব ব্রহ্ম লোকে কোটি কোটি বৎসর বিপুল আনন্দ সুখ উপভোগ করেন।  সেই সুখ লোকে প্রজ্ঞাদি উৎকৃষ্ট গুণ ধর্ম উৎপন্ন ও বর্ধনের সুযোগ অতি কম বলে বুদ্ধ প্রত্যেক বুদ্ধ এবং সাধু সন্তগণ সুখ দুঃখ মিশ্রিত এই মনুষ্য লোকেই উৎপন্ন হন।  বোধিসত্ত্ব স্বেচ্ছা মৃত্যুকে বরণ করে দীর্ঘায়ু সম্পন্ন দেব ব্রহ্ম লোক হতে মুনষ্য লোকেই জন্ম নেন।  ইহার মনুষ্য লোকের শ্রেষ্ঠতা।   সবার উপরে মানুষ সত্য।  তাহার উপরে নাই।

 

মানুষকে সর্ব প্রথম মনুষ্যত্ব লাভের জন্য যত্ন শীল হতে হবে।  মনুষ্যত্ব লাভের পথ কখনও কুসুমাস্তীর্ণ নয়; বরং পিচ্ছিল ও কন্টকা কীর্ণ। মানুষের মত মানুষ হতে হলে সেই দুর্গম পথেই অগ্রসর হতে হবে। পার্বত্য নদী বাধার পর বাধা অতি ক্রম করে বৃহৎ হতে বৃহত্তর হয়; উভয় কুল উর্বর ও শস্য শ্যামলা করে জীব জগতের অপ্রমেয় হিত সাধন করে এবং শেষে আপন লক্ষ্য মহা সমুদ্রে মিশে যায়।  মানুষকেও তেমন জীবন পথের সকল বাধা অতিক্রম করে আত্ম পর হিতের মাধ্যমে মহৎ হতে মহত্তর হতে হবে এবং শেষে শান্তি সমুদ্রে মিশে যেতে হবে। 

 

প্রজ্ঞা বান এবং বীর্য বান না হলে মনুষ্যত্বের এ দুর্গম পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।  অতএব মানুষের মত মানুষ হতে হলে প্রত্যেককে যেমন প্রাজ্ঞ হতে হবে তেমন শারীরিক মানসিক বলে বলীয়ান হতে হবে।  সৌভাগ্য ক্রমে অক্ষণ মুক্ত শ্রেষ্ঠ মানব জীবন লাভ করলেও ইহার সদ ব্যবহার করতে পারে তেমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। কর্মানুসারে মানুষ যেমন অধ্যাপক ডাক্তার উকিল ও কুলি মজুর নামে পরিচিত, তেমন মানুষের কর্মানুযায়ী বুদ্ধ মানুষকে তম তম পরায়ণ, অসুন্দর দেহ নিয়ে সহায় সম্বল হীন দরিদ্ৰ কুলে উৎপন্ন এবং পাপ কর্মে নিরত ব্যক্তি। জ্যোতি মত পরায়ণ সুন্দর দেহ যুক্ত উচ্চ কুল ও ধনীর ঘরে উৎপন্ন অথচ পাপ কাজে নিরত ব্যক্তি। 

 

তম জ্যোতি পরায়ণ অসুন্দর দেহ নিয়ে সহায় সম্বল হীন দরিদ্ৰ কুলে উৎপন্ন অথচ পুণ্য কর্মে নিরত ব্যক্তি।  ও জ্যোতি জ্যোতি পরায়ণ সুন্দর দেহ  যুক্ত উচ্চ কুল ও ধনীর ঘরে উৎপন্ন এবং পুণ্য কর্মে নিরত ব্যক্তি।  রূপে ভাগ করে দেখিয়েছেন।  প্রথম দুই শ্রেণীর মানুষ অধোগামী এবং দ্বিতীয় দুই শ্রেণী উর্ধ্বগামী। অন্য স্থানে উর্ধ্বগামী মানুষকে ‘পরমার্থ মানব’ এবং অধোগামীকে তাদের কর্মানুসারে ‘পশু’ ‘প্রেত ও নারকী মানব বলে অভি হিত করেছেন।  জীবন সম্বন্ধে অজ্ঞ ব্যক্তি উচ্চ ডিগ্রী এবং বিপুল ধনের অধিকারী হলেও পশু প্রেত বা নারকী মানবের জীবনই যাপন করে থাকে।  জগতের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে তেমন শতশত দৃষ্টান্তচোখে পড়ে।

 

সাধারণ মানুষের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডিগ্রী পেলেই মানুষ জ্ঞানী হয়।  সে ধারণা সত্য নয়।  ধনীদের অনেকে ভাল ভাল খাদ্য খেয়ে অজীর্ণ রোগাদিতে আক্রান্ত হয়ে যেমন বেশী দুর্বল হয়ে যায়, তেমন শিক্ষিত দের অনেকও ভাল ভাল বই পড়ে সার গ্রহণ করতে অক্ষম হয়ে বেশী মূর্খ বা অসৎ ও পাপী হয়।  প্রকৃত পক্ষে ধন যেমন একটা শক্তি, শিক্ষাও তেমন একটা শক্তি মাত্র।  ধন মূর্খের (অসতের) নিকট উৎপন্নহলে তারদ্বারা যেমননিজের ও মানবসমাজের বিপুল অহিতহয়, তেমনমূর্খ শিক্ষারঅধিকারী হলে নিজের ও পরের মহাঅমঙ্গল করেথাকে। 

 

তাই বিজ্ঞ জনের উপদেশ “মণি দ্বারা ভূষিত হলেও বিষাক্ত সর্প যেমন ভয়ঙ্কর, তেমন বিদ্যার দ্বারা অলঙ্কত হলেও দুর্জন পরি ত্যাজ্য। ” চাণক্য শ্লোক।  বুদ্ধ মূর্খ ও পণ্ডিতের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন “ভিক্ষুগণ! তিনটি মুখের লক্ষণ, মূর্থের নিমিত্ত, মূর্খের অবদান।  ভিক্ষুগণ! মুর্থ দুশ্চিন্তা কারী, দুর্বাক্য ভাষী ও দুষ্কর্মকারী হয়।  তেমন না হলে পণ্ডিতগণ কি রূপে জানতেন যে, এ ব্যক্তি মূখ অসৎ পুরুষ? উক্ত কাজের দ্বারা মুখ অব্যক্ত অসৎ নিজকে ক্ষত উপহত করে দোষণীয় বিজ্ঞ নিন্দিত জীবন যাপন করে।  ইহাতে  সে বিপুল পাপ সঞ্চয় করে। ” তৎবিপরীতই পণ্ডিতের লক্ষণ কৃত্য।  ধনী দের  অনেকে রোগ গ্রস্ত এবং দুর্বল হলেও যেমন সবাই ধনী হতে চায়, তেমন শিক্ষিত দের মধ্যে মূর্খ বা অসতের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও সকলকে শিক্ষিত হবার চেষ্টা করতে হবে।

 

সার কথা মানুষকে ধনী যেমন হতে হবে, তেমন সুস্থ সবলও হতে হবে।  সেরূপ শিক্ষিত যেমন হতে হবে তেমন জ্ঞানীও (সৎ) হতে হবে।  এ জ্ঞানী হওয়া অর্থ জীবন সম্বন্ধে জ্ঞানী হওয়া।  জীবন নিয়ে যত সাধনা গবেষণা হয়েছে তাদের লিপি বদ্ধ রূপই ধর্ম শাস্ত্র।  অত এব ধর্ম শাস্ত্রই জীবন শাস্ত্র  জীবন বেদ, জীবন দর্শন ও জীবন বিজ্ঞান।  তাই ধর্ম বা জীবন সম্বন্ধে অজ্ঞ ব্যক্তিই ইতর মানবের জীবন যাপন করে থাকে।  মানুষের মত মানুষ হতে।  হলে প্রথম জীবন হতেই ধর্ম শিক্ষা লাভ করতে হবে এবং ধর্ম শীল হতে হবে।  জ্ঞানী আর্য ঋষি গণ চতুরা শ্রমের ব্যবস্থায় তজ্জন্য প্রথমেই ‘ব্রহ্ম চর্যা শ্রম’ এবং চতুবর্গের প্রথমেই ‘ধর্ম’ এর স্থান দিয়েছেন। 

 

জীবন সম্বন্ধে জ্ঞানী ব্যক্তিই ধার্মিক ও চরিত্র বান হন।  তিনি কোন প্রকার প্রলোভন এবং বাধা বিপত্তিতে বিচলিত হন না।  প্রয়োজন হলে সকল প্রকার।  দুঃখ কষ্টকে বরণ করেও তিনি ন্যায় সত্যে স্থির থেকে মনুষ্যত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত ও সুভোভিত হন। এমন মানুষের সংখ্যা আকাশের অগণিত জ্যোতিঙ্কের মধ্যে বিশেষ জ্যোতিষ্ক শুক তারা দির ন্যায় কম হলেও তারাই সর্ব জন পূজ্য মানব রত্ন।  এমন মানুষের আদর্শে জীবন গঠনের জন্য সকলে।  যত্ন বান হওয়া উচিত।

ধুলি শয্যা ছাড়ি উঠ উঠ সবে

মানবের সাথে যোগ দিতে হবে;

তা যদি না পার চেয়ে দেখ তবে

ওই আছে রসা তল ভাই।

আগে চল আগে চল ভাই। 

মানব জীবন সমাপ্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url