পটাচারা জীবনী

 পটাচারা জীবনী

“এসছো? এসেছো প্রিয়?”

“হ্যা প্রিয়া, এসেছি।  খাওয়ার পরে সবাই বিশ্রাম করছে,

এ সুযোগে এদিকে ছুটে এলাম। ”

“বেশ করেছে, আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। ”

“কেন? আমার আর প্রয়োজন কি?”

“প্রয়োজন আছে। ”

“কি প্রয়োজন?”

“কাল যে আমার বিয়ে, শোন নি?”

“তা তো শুনেছি। ”

“বর আসবে পুষ্পরথে। “

“তার পর?”

“হীরা মুক্তার অলংকার পরে, রাজ রাণীর বেশে,

বরের সাথে চলে যাবো শ্বশুর বাড়ী। ”

“তার পর?”

“তার পর আমার দেখা আর পাবেনা। ”

“কেন? সংসার ছেড়ে কোথাও উধাও হয়ে যাবে না কি?”

“উধাও হয়ে যাবো না বটে, কিন্তু তোমার সঙ্গে আর তো দেখা হবে না। ”

“কেন? আর কি বাপের বাড়ি আসবে না?”

“আসবো বই কি কালে ভদ্রে, তখন তো আমি কুল বধূ,

পর পুরুষের মুখ দেখতে নেই। ”

“আমি তো তোমার বাল্য সখা খেলার সাথী!”

“সে টাই তো প্রতি বন্ধক, সবাই দেখবে সন্দেহের চোখে। ”


আরো দেখুন: সুপ্রিয়া


আরো দেখুন: পটাচারা জীবনী


পটাচারা জীবনী

পটাচারা জীবনী

তখন একটা দীর্ঘ শ্বাস যুবকের বুক চিরে যেন বেরিয়ে গেল।  চোখহলো অশ্রুসিক্ত, কিছু বলবার শক্তি সে হারিয়ে ফেলল।  অন্তরে তীব্র বেদনা অনুভব করল, মুখ বিমর্ষ হয়ে গেল।  তখন তরুণী তরণের চিবুকে হাত দিয়ে মমতা পূর্ণ কণ্ঠে বলল “প্রিয়া সখা, চাঁদের মতো তোমার প্রফুল্ল আনন এমন বিমর্ষ হয়ে গেল কেন? চোখেও জল কেন টলমল?”

 

চোখ মুছে যুবক বলল “সে কথা শুনে আর লাভ কি? তুমি বুঝবে না আমার মনের বেদনা।  তোমার প্রতিটি কথা আমার অন্তরে বিদ্ধ হচ্ছে বিষদগ্ধ শেলের মতো, সৃষ্টি করছে অসহ্য যন্ত্রণা, যা সারা জীবন আমায় দগ্ধ করবে তিলে তিলে।  “কেন, কেন সখা? কেন যন্ত্রণার সৃষ্টি করছে, কেনই বা দগ্ধ করবে তিলে তিলে!”

 

“কেন? তা কি তুমি জান না? আমার প্রাণে ভালোবাসার আগুন জ্বেলে দিয়েছে কে? অপরূপ মনো মোহিনী বেশে আমার শান্ত সরল অন্ত রে উদিত হয়ে কে আমায় অশান্ত বিভ্রান্ত করে দিয়েছে? আমার মানস সরসীতে শোভন মোহন কমলিনীর বিরাজ করে কে আমায় বিমুগ্ধ করে তুলেছে? আজ কিন্তু আমি হয়েছি তোমার কৌতুকের সামগ্রী।  এতোদিন তোমায় বুঝিনি, এখন প্রকাশ পেয়েছে তোমার স্বরূপ।  বুঝেছি তুমি কুহকিনী নারী! মায়াবিনী, তুমি পাষাণী?”

 

তরুণী ব্যস্ত হয়ে বলল “না, না প্রিয়! তা নয়; আমি জানতে চাই তোমার অন্তরের কথা, বুঝতে চাই তোমার মনের দৃঢ়তা।  বড়ো জটিল, বড়ো সংকট মুহূর্তের সম্মুখীন হয়েছি প্রিয়তম! আমি কুহকিনী নই আমি সরলা নারী; আমি মায়াবিনী নই আমি অবলা, তোমার অনুগ্রহ ভিখারিণী; আমি পাষাণী নই আমি স্নিগ্ধ সুধার নিঝরিণী; একদিন পাবে আমার পরিচয়।  প্রিয়তম, এখন উপায় কি? চলো আমরা পালিয়ে যাই।  আমায় নিয়ে কোথাও উধাও হয়েযাও।  অরণ্যে, পর্বতে, গুহায়, কন্দরে যেখানে তোমার ইচ্ছা; পারবে কি?”

তরুণীর কথা শুনে যুবক অবাক হয়ে তার প্রতি চেয়ে রইল।  

তরুণী বলল গাঢ়স্বরে “কি, পারবে না?”

ক্ষুব্ধ স্বরে বলল তরুণ “কৌতুক করছে না তো?”

“কৌতুক নয় প্রাণে স্বর, আমার অন্তরের কথা


বিস্ময় নেত্রে চেয়ে যুবক বলল “কি যে বলছো তুমি, কিছুই বুঝতে পারছি না।  চিন্তা করে কথা বলো।  আমি হলাম অজ্ঞাত কুলশীল অনাথ, নিতান্ত দরিদ্র, তোমাদের আশ্রিত সেবক।  আর তুমি হলে ধনীর দুলালী, যুথিকা স্তবকের মতো সুন্দরী যুবতী, ফুলের মতো কোমল দেহ, সুখে বর্ধিত, তোমার বরাঙ্গের সজ্জা হীরা মুক্তার অলংকার, পরিধানে সূক্ষ্ম পট্টবসন, সুবাসিত তৈলে সিক্ত করা হয় তোমার ভ্রমর কৃঞ্চ সুদীর্ঘ কেশ রাশি।  রাজ পুত্রের মতো বর আসছে তোমার যার অপার ঐশ্বর্য, কতো দাস দাসী, গাড়ী ঘোড়া।  খাবে রাজ ভোগ, থাকবে রাণীর সুখে।  আমার ন্যায় নিঃস্ব কাঙ্গালের সঙ্গে তুমি যাবে কোথায়? কোন সুখেই বা থাকবে? এ কি তোমার পরিহাস? পরিহাসেরও একটা সময় আছে!”

 


“পরিহাস! অমন কথা বলো না প্রিয়তম।  তা শুনলে প্রাণে বড়ো ব্যথা পাই।  আমি ধন মান, ঐশ্বর্য কিছুই চাই না, চাই না হীরা মুক্তা, চাই না হৰ্ম্য প্রাসাদ, দাস দাসী।  আমি চাই তোমায়, তুমিই আমার ঐশ্বর্য, তুমিই আমার মণি মুক্তা, তুমিই আমার অঙ্গের ভুষণ, তুমিই আমার আনন্দ, তুমিই আমার সুখের উৎস।  বাল্য সখা, তুমি চন্দ্র আমি চন্দ্রিকা; তুমি অনন্ত আকাশ আমি আকাশ গাত্রে সৌদামিনী; তুমি সরোবর আমি সরোবর আশ্রিতা কমলিনী।  তোমায় দিয়েছি আমার মন প্রাণ, রূপ যৌবন, আমার দেহ, আমার সর্বস্ব।  আর এমন কিছুই  অবশিষ্ট নেই যা দিতে পারি অপরকে।  সবাইতো উজাড়করে তোমায় দিয়েছি।  তুমিই আমার ধর্ম, তুমিই আমার পুণ্য, তুমিই আমার কাম্য, আমি চাই একমাত্র তোমাকেই। ”

 

“সত্যি, সত্যি প্রিয়া? যা শোনালে, তা কি তোমার সরল অন্তরের একান্ত সত্যি কথা?” “হ্যা প্রাণনাথ! সত্যি, আমার সরল অন্তরের তা একান্তই সত্যি কথা।  চল সখা, আমরা পালিয়ে যাই। বিলম্বের আর সময় নাই।  আজ রাতের অবসানে, ভোরের অন্ধকারেই এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।” “কিন্তু প্রিয়া, তোমার বাবা কি আমায় ক্ষমা করবেন? তিনি আমায় নিশ্চয়ই হত্যা করবেন। ”  “সখা, আমরা পালিয়ে যাবো, উধাও হয়ে যাবো, দূর দূরান্তরে চলে যাবো এ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে। ” “সখি, আমার ভয় হচ্ছে; দেখো আমার বুকে হাত দিয়ে, কেমন ধুক ধুক করছে। ”

 

তরুণী যুবকের বক্ষে হাত দিয়ে বলল “আমার জীবন সাথী, বুকে সাহস আনো।  পুরুষ মানুষের অত ভয় করলে চলে? উদ্যোগী পুরুষ সিংহ। মনকে দৃঢ় কর।  আমরা লুকিয়ে যাবে, নিখোঁজ হয়ে যাবো, কোনও ভয় নেই।  তুমি প্রস্তুত হও।  কাল ভোর রাতের আলো আঁধারীতে আমি এসে তোমার সঙ্গে একত্র হবো।  বলো, তখন তুমি কোথায় থাকবে, আমার জন্য কোথায় অপেক্ষা করবে?”

 

যুবক চিন্তা যুক্ত হয়ে বলল “প্রিয়া, তুমি যে কী ভয়ংকর কথাই বলছো, তা আরো একটু সূক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে দেখো।  আমার সঙ্গে গিয়ে প্রথমেই তোমাকে বরণ করতে হবে দারিদ্র। নিঃস্ব অবস্থা দুঃখ ভারাক্রান্ত করে তুলবে জীবনকে।  তা হবে তোমার পক্ষে দুর্বিসহ।  অভাব অনটনের যে কি দুঃখ, তা তো জীবনে উপলব্ধি করতে পারো নি।  তোমার দৈন্য দশা আমার প্রাণে সহ্য হবে না।  এখনও সময় আছে, চিন্তা কর।  বুদ্ধি মানের কাজ করবার পুর্বেই চিন্তা করে, বিচার করে। ”

 

“আমি সানন্দে যা বরণ করে নিচ্ছি, তাতে তোমার অসহ্য হবার কি আছে? তুমি অত চিন্তা করে মাথা খারাপ করো না প্রিয়া!” “বাড়ী থেকে তুমি কি রূপে বের হবে? বিবাহ বাড়ী কতো লোক জন, দাস দাসী, কর্ম চারী।  দ্বারে আছে প্রহরী।  এ ব্যুহ চক্র ভেদ করবে কি করে?” “সে চিন্তা আমার, সে জন্যে তুমি মাথা ঘামিও না। ” “প্রিয়ে, বিপদের খুব সম্ভাবনা, অসম্ভব মনে হলে বের হয়ো না।  আর যদি বের হয়ে পড়, নগর দ্বারের কিছু দূরে যে একটা প্রকান্ড বট বৃক্ষ আছে, তাঁর অন্তরালে আমি গা ঢাকা দিয়ে থাকবো, সেখানেই এসো।  কিন্তু সাবধান, ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই।  তুমিতো মাবাপের আদরিণী কন্যা, তোমার কিছুই হবে না; হবে এ অনাথের সর্বনাশ।  হয় শূলে দেবে; না হয়, বিষ দিয়ে মারবে। ” “প্রিয় সখা, সে ভয় করো না।  তোমায় মরতে দেবো না। তুমি মরলে আমারও হবে সহ মরণ, এটা নিশ্চয়।  একদিন তো মরতেই হবে।  এখন যাও, গমনের জন্য প্রস্তুত হও গে।  আমিও প্রস্তুত হচ্ছি। ”

 

আড়াই হাজার বৎসর আগেকার কথা।  পুণ্য ভূমি শ্রাবস্তী নগর।  সেখানে ছিলেন এক ধনাঢ্য ব্যক্তি।  তাঁর ধনের পরিমাণ চল্লিশ কোটির উপর। তাঁর প্রকান্ড অট্টালিকা, বহু হস্তী অশ্ব রথ শকট।  চতুর্দিকে প্রাকার বেষ্টনী। বহিৰ্ধারে সশস্ত্র প্রহরী।  এ ভাগ্যবান লোকটি ও তাঁর সহ ধর্মিনী দীর্ঘ দিন যাবৎ পুত্র কন্যার অভাব বোধ করছিলেন।  তাই তাঁরা তত দিন সর্ব তো ভাবে সুখী হতে পারেন নি।  পরি শেষে বহু সাধনার ফলে লাভ করলেন এক কন্যারত্ন।  আনন্দিত হলেন জনক জননী।  কন্যাটির প্রতি তাঁদের অগাধ স্নেহ মমতা।  কন্যাটি বর্ধিত হলো পরম যত্নে ও সুখে।  সে ছিল দেবী প্রতিমার মতো সুন্দরী।  তাঁর চোখে মুখে প্রতি ভার উজ্জ্বল দীপ্তি।  মাতা পিতা আদর করে তাকে ডাকতেন মণি।

 

পাঁচ বৎসরের পরের কথা।  হেসে খেলে মণির দিন কেটে যায়।  ধনীর দুলালী মণির এমন একটা বাস ভবন হওয়া চাই তা যেন হয় অতি সুন্দর মনোরম, আলো বাতাস ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে পরি পূর্ণ।  অচিরে প্রাসাদ তৈরী হলো, দিব্য বিমানের মতো।  সজ্জিত হলো চারু শিল্পে। চার পাশে রচিত হলো সুন্দর পুষ্পোদ্যান! মণি ফুল দেখে খুশি হয়, উদ্যানে খেলা করে মহানন্দে।  ফুলের সাথে সে কথা কয়, হাসে, অভিমান করে।  ফুল গুলিও যেন প্রফুল্ল হয়ে হাসে, তাঁর কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে ফুলের সর্বাঙ্গে যেন বয়ে যায় আনন্দের হিল্লোল।  যূথী, মালতী, কামিনী, মাধবী ও মল্লিকা প্রভৃতির সঙ্গে সে যখন সখিত্ব পাতায় তখন তাদের সঙ্গে সে মিলে যায়, সেও যেন সুন্দর এক কুসুম স্তবক।

 

এমন সময় এই সুখী পরিবার আলো করে এলো এক সুন্দর পুত্র সন্তান। তখন মণির আনন্দ কে চয়! শিশু ডাইটিকে সে আধূলিয়ে রাখে সারাক্ষণ।  কখনো কোলে নিতে চায়, কখনো ছোট ছোট আঙ্গুল নিয়ে খেলা করে, কখনো নাক টেনে দেয়, কখনো ললাটে চুম্বন দেয়, হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ে, আনন্দে মাকে বলে “মা, খোকন মণি আমায় ডাকবে দিদি মণি, কেমন তাই না?”

 

মা মৃদু হেসে বলেন “হ্যাঁ মা, ডাকবে।  তোরা ভাই বোন আমার বুক জুড়িয়ে সোনার সংসার উজ্জ্বল করে বেঁচে থাক। ” এ বিশাল ভবনে এ দুই জন মাত্র ভাই বোন।  তাদের দেখলে জনক জননীর অন্তর যেন পরম শান্তি ও তৃপ্তিতে ভরে উঠে।  তাঁরা সকল দিক দিয়ে সুখী।  সুখের দিন তাঁদের সুখেই কেটে যাচ্ছে।  এক দরিদ্র বালক।  ছেলেটি পিতৃ মাতৃ হীন অনাথ।  তার বয়ঃক্রম আট কি নয় বৎসরের মতো।  পরি ধানে ছিন্ন মলিন একখানা ছোট কাপড়; ময়লা মলিন শরীর, দেহ শীর্ণ, মুখ পাংশু বিশুষ্ক।  এর মধ্য দিয়েও তার দেহ কান্তি যেন উঁকি মারছে।  তার চোখ মুখ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সুলক্ষণ যুক্ত।  দেখলে ছেলেটির প্রতি স্বতঃই করুণার সঞ্চার হয়।

 

সেদিন শ্রাবন্তীর সেই ধন পতি কর্ম স্থান থেকে ফির ছিলেন নগর পথে।  সম্মুখে দেখতে পেলেন তিনি এই অনাথ ছেলেটিকে।  ছেলেটি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।  সে সম্মুখে এসে হাত পেতে বলল “বাবা, একটা পয়সা দেবেন? বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে।” শ্ৰেষ্ঠীর অন্তরে করুণার সঞ্চার হলো।  তিনি করুণা বিগলিত কষ্টে জিজ্ঞাসা করলেন “তোর বাড়ী কোথায় রে?”

“আমার তো কোনো বাড়ী নেই বাবা। ”

“রাতে ঘুমাস কোথায়?”

“কারো ঘরের দেহ লীতে। ”

“তোর মা বাবা কোথায়?”

“তারা কেউ বেঁচে নেই। 

“তুই আমার সঙ্গে যাবি?”

“কোথায় বাবা?”

“আমার বাড়ীতে। ”

“খেতে পেলে বাবা, যেখানে হাকো যেতে পারি। ”

“তবে আয়। ” বলে তাকে তিনি সঙ্গে করে গৃহে নিয়ে এলেন।  স্নানের পর যখন ছেলেটিকে পরিস্কার কাপড় পরিধান করানো হল, তখন তার দেহের স্বাভাবিক উজ্জ্বল কান্তি ফুটে উঠল। তাকে প্রথম দেখেই ভালো লাগল মণির।  বাবাকে সে জিজ্ঞাসা করল “কে এ বাবা?” উত্তর হলো “তোমার খেলার সাথী। ” মণি হেসে বলে উঠল “বেশ হয়েছে বাবা, আমার খেলার সাথী একটা জুটে গেল।  দুই জন না হলে কি খেলা করা যায়? একলা মোটেই ভালো লাগে না বাবা।”

 

“ছেলেটি ভালো খাবার পেয়ে কিছু দিনের মধ্যেই সুগঠিত ও সুন্দর হলো।  মণি তাকে পেয়ে খুবই আনন্দিত হলো।  তার কথা, তার হাসি, তার চাহনি, তার অঙ্গ ভঙ্গী, তার ভ্রুবিলাস বড়ো মনোরম, বড়ো মিষ্টি মনে হলো।  অল্প দিনের মধ্যেই বালিকার অন্তর অধিকার করে বসল বালকটি।  তারা এক সঙ্গে বসে, এক সঙ্গে বাগানে লুকো চুরি খেলে, ছুটা ছুটি করে, কতো হাসে, কতো আনন্দ করে।  মণি তাকে ডাকে আদর করে “সখা, বন্ধু, খেলার সাথী। ” সে ডাকে “সখি, সই, মণি। ” মাতা পিতা মেয়ের আনন্দ দেখে সুখী হন, তৃপ্তি অনুভব করেন।  বালকটির প্রতি তাদের আদর মমতা বৃদ্ধি পায়।

 

মণির বয়স এখন চৌদ্দ বৎসর।  তার বাল্য সাথী এখন আঠার বৎসরের যুবক।  তাদের ক্রীড়া কৌতুক এখন অনেকটা সংযত হয়ে এসেছে।  কিন্তু মণির অন্তরে তার প্রতি কেমন একটা আকর্ষণ এসে।  পড়েছে।  তার সখাকে ক্ষণ কাল না দেখলে সে অস্বস্তি বাধো করে, নিরানন্দের ছায়া পড়ে তার মর্মস্থলে।  নানা অজুহাত ও খুঁটিনাটি কাজ করিয়ে তাকে রাখতে চায় চোখের সম্মুখে।  তবুও তাকে বাইরের কাজেই অধিক সময় ব্যস্ত থাকতে হয়।  এরূপে চলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। অনুরাগের গাঢ় রেখা অংকিত হলো উভয়ের মানস।  পটে।

 

মণি এখন ষাড়োশী যুবতী।  যৌবনের উজ্জ্বল লালিত্য বিকশিত হয়ে ওঠে তার সর্বাঙ্গে, মনও হয় অনুরাগে রঞ্জিত, কামনা বাসনায় বিভাসিত অভিভূত।  যৌবনের উন্মাদনায় কামিনীগণ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য।  হয়ে পড়ে।  অপসারিত হয় লজ্জা ভয় আত্মমর্যাদা বোধ।  যুবতী মণির মোহনী মায়ার মোহন পাশে আবদ্ধ হয়ে পড়ল নবীন বাল্য সখা।

 

সে এখন মণিগত প্রাণ।  প্রিয়াকে প্রসন্নময়ী দেখলে তার আনন্দের সীমা থাকে না।  মণির আশা আকাঙ্খ মিটাতে পারলে সে তৃপ্ত হয়, তুষ্ট হয়।  কামিনী কামানলে হলো তাপিত, সন্তাপিত, বিচলিত।  বিলাসিনীর বিলাস চাঞ্চল্যে মোহিত হয়ে সে অনলে ঝাপিয়ে পড়ল তরল মতি যুবক। কামিনীর কামনা হলো চরিতার্থ।  মণির ললাট লিপিটে ঘোর কৃষ্ণ মসীর রেখা পাত হলো।  আর যুবকের? তার কর্মের ফল আরো ভয়ঙ্কর।  বড় অশুভ ক্ষণেই ঘটে ছিল তাদের প্রথম দৃষ্টি বিনিময়।

 

শ্রাবস্তীর অপর এক ধনাঢ্য ব্যক্তি।  তিনিও শ্রেষ্ঠী নামে খ্যাত।  সম্রান্ত কুল, সুখী পরিবার।  তাঁর ছিল এক বিবাহ যোগ্য পুত্র।  যুবকটি যেমন সুদর্শন, তেমনি শিক্ষিত ও অমায়িক।  তার জন্য মনোনীত করলেন লাবণ্যময়ী মণিকে।  বরের পিতা প্রার্থী হয়ে উপনীত হলেন কন্যার পিতার নিকট। পরিচিত লোক, সমজাতি ও সম অবস্থা সম্পন্ন।  মণির পিতা সানন্দে সম্মত হলেন।  শুভ বিবাহের শুভলগ্ন নির্ধারিত হলো।  উভয়েই ধনাঢ্য কুল।  সাড়ম্বরে বিবাহ উৎসবের প্রস্তুতি চলতে লাগল। বাদ্য মঞ্চ প্রস্তুত হলো, সুন্দর পুষ্পতোরণ নির্মিত হলো, বিবাহ উৎসরের সর্বাঙ্গীন কার্য সম্পাদনের জন্য হুল স্থুল পড়ে গেলো।

 

মণি নীরবে শুনলো সকল কথা।  কিন্তু এ বিবাহে তার মন সায় দিল না। তার হৃদি সমুদ্রে ঝড় উঠল, অন্তরে সৃষ্টি হলো মহাবিতর্কের।  চিন্তা করল দৃঢ় ভাবে “তা কক্ষণো হতে পারে না।  আমি যাকে সমর্পণ করেছি মন প্রাণ, রূপ যৌবন, যাকে করেছি আত্ম দান আমি তাকেই চাই।  চাই না আমি ধন সম্পদ, মান সম্মান, হীরা মুক্তা, মণি মাণিক্য, চাই না হৰ্ম প্রসাদ, চাই না দাস দাসী, গাড়ী ঘোড়া, চাই না অন্য।  পুরুষ যদিও সে হয় দেবতুল্য। 

 

 

আমি যাকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছি তিনিই আমার একমাত্র স্বামী, তিনিই আমার দেবতা, তিনিই আমার প্রাণেশ্বর, তিনিই আমার ধন রত্ন, তিনিই আমার মান সম্মান, তিনিই আমার ধ্যান ধর্ম, তিনিই আমার স্বর্গ, তিনিই আমার সর্বস্ব।  অন্য পুরুষ আমার পক্ষে পিতৃসম, ভ্রাতৃসম।  এর অন্যথায় আমি হবো দ্বিচারিণী, ব্যভিচারিণী, অধর্ম পরায়ণা।  আমি মানুষের কাছে দোষী হতে পারি, কিন্তু ধর্মের কাছে দোষী হতে পারি না। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর চললে তখন আমি সানন্দে বরণ করে নেবো মৃত্যুকে।  জীবন পণ করে রক্ষা করবো আমার ধর্ম সতীত্ব ইত্যাদি কতো অনন্ত চিন্তা তার।

 

দিন ঘনিয়ে এলো।  আগামী কাল মণির বিয়ে।  চলন্ত বিয়ে।  রাত্রে পুষ্পরথে করে আসবে বর আলোকিত করে দীপমালায়।  মহার্ঘ যৌতুক সামগ্রীতে ঘর ভর্তি করা হয়েছে।  ঐকতান বাদ্যের সুতান লহরী আকাশ বাতাস মুখর করে তুলছে।  বাঁশরীর ললিত বেহাগ রাগিণীর করুণ মধুর সুর প্রাণ আকুল হয়ে তুলছে।  বিচ্ছেদ বিধুর চোখ বার বার সজল হয়ে উঠছে।  মণির মাতার অশ্রু কিছুতেই বাধ মানছে না।  পিতাও যথেষ্ট কাতর হয়ে পড়েছেন।

 

দিবা দ্বি প্রহর।  মণি আপন প্রকোষ্ঠে নির্জনে পালংকে শুয়ে কি সব চিন্তা করছে।  সে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন।  এমন সময় অনাথ যুবকটি সেখানে উপস্থিত হলো।  তাকে দেখেই মণি তাড়াতাড়ি উঠে ‘এসেছে, এসেছো প্রিয়?’  বলতে বলতে গিয়ে তার একখানা হাত ধরল।  তার পর উভয়ের মধ্যে যা কথোপকথন হয়ে ছিল, পাঠকগণ তা পূর্বেই অবগত হয়েছেন।  দিবাকর অস্তাচলে হেলে পড়েছে; মণি আপন শয্যায় শুয়ে আছে।  নির্জন প্রকোষ্ঠ।  সে কত চিন্তা করছে আকাশ পাতাল।  এমন সময় সে শুনতে পেলো তার পাশে উদ্যানে করুণ সুরে গান করছে তার স্নেহের ছোট ভাই শোভন।

 

তার গানের সুর ভাষা বড় করুন।  বিয়ের পর যদি দিদি শ্বশুর বাড়ী চলে যাবে।  একাকী সে এই বিরাট ভুবনে কেমন করে থাকবে? দিদির আসন্ন বিদায় লগ্ন স্মরণ করেই তার অন্তরে নিবিড় বেদনা সঞ্চার হয়েছে।  সেই দুঃসহ বেদনাই সঙ্গীত হয়ে তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ছে।  গান শুনতে শুনতে মণির চোখেও অশ্রু ঘনিয়ে উঠল।  গান থামল।  মণির নয়ন যুগল অশ্রু সিক্ত হলো এমন সময় “দিদি মণি, দিদি মণি” বলে শোভন দ্রুত প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করল।  শোভন এখন দশ বৎসরের বালক।  সুন্দর লাবণ্য মাখা দেহ।  সে এসে পালংকে বসল তার দিদির কাছে।  সে বলল “দিদি মণি, উদ্যানে তোমায় খুঁজে না পেয়ে এখানে ছুটে এলাম, এ সাঁঝের বেলায় তুমি শুয়ে আছো কেন দিদি! অসুখ করেছে?”

 

“না ভাই শোভন” বলে মণি উঠে বসে আদরের ছোট ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ” শোভনও দিদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল “দিদি মণি, আমার প্রাণ কেমন করছে, আমায় ছেড়ে তুমি কেমন করে যাবে দিদি! তোমার প্রাণও কেমন করছে, না? দিদি মণি, আমি কাকে দিদি মণি ডাকবো? কে আমায় তোমার মতো আদর করবে? একলা আমি কেমন করে থাকবো? আমার মোটেই ভালো লাগবে না দিদি মণি?”

 

মণির চোখে অশ্রুর বন্যা নেমে এলো।  তার দু’গন্ড বেয়ে অশ্রু।  ঝরতে লাগল।  কেঁদে কেঁদে বলল “প্রাণের শোভন, ভাই আমার, আমি আবার আসবো, তোমায় আদর করবো, কোলে নেবো, আমাকে ডাকবে দিদি মণি, তুমি কেঁদো না। ” “তুমিও তো কাঁদছো দিদি, প্রাণ জ্বলছে, না? জ্বলবেই তো, আমরা আছি মোটে দুই ভাই বোন, যেন এক বৃন্তে দু’টি কুসুম।  আমার বুকে হাত দিয়ে দেখে দিদি, প্রাণ কেমন হু হু করে কাঁদছে। ”

 

অনুরাগ রূপ কাল সর্প তীব্র বিষ উদগার করে।  রিপু পীড়িত জনগণ হয় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য, ব্রতী হয় অসাধ্য সাধনে, মহা দুঃখকে করে আলিঙ্গন, হয় দুশ্চিন্তা গ্রস্ত, দুগ্ধ ফেননিভ সুকোমল শয্যায়ও তাদের নিদ্রা হয় না।  মণির অবস্থাও হলো তাই।  সে যাপন করল বিনিদ্ররজনী, ভীষণ সংকল্পে হলো বদ্ধ পরিকর, চলতে লাগল মন প্রাঙ্গণে দুর্জয় সংগ্রামে পরাভূত হলো মাতা পিতার স্নেহ মমতা, ভ্রাতার প্রতি আদর ভালোবাসা, কুল গৌরব, আত্ম মর্যাদা।  বিজয়িনী তার বেশ পরিবর্তনে প্রবৃত্ত হলো।  তখন রাত্রির শেষ প্রহর।  পরিধান করল একখানা জীর্ণ মলিন বস্ত্র। মাথায়, মুখে, হাতে ও পায়ে মাখল ছাই।  নিজের মূল্য বান অলংকার ও কয়েক খানা শাড়ী মাত্র সঙ্গে নিয়ে, দাসীর মতো বেশ ধরে, ভাঙ্গা একটা টুকরী কাঁধে নিয়ে গোপন গবাক্ষ পথে গৃহত্যাগ করল।

 

নগরদ্বার অতিক্রম করে বট বৃক্ষের ছায়ায় একত্র হলো তার প্রিয়তমের সঙ্গে।  তার পর তারা উভয়ে দ্রুত পথ অতি ক্রম করতে লাগল। শ্রাবন্তীর প্রান্ত সীমায় সম্প্রপ্ত হলো বিস্তীর্ণ অচিরাবতী নদী।  এতে জল মাত্র জানু প্রমাণ।  তারা অক্লেশে নদী উত্তীর্ণ হলো।  চলতে লাগল দ্রুত গতিতে।  বহু দূর গিয়ে উপনীত হলো অরণ্যময় বন্ধুর প্রদেশে।  একপদী কঙ্কর যুক্ত পথ।  দিবা দ্বি প্রহর রৌদ্রের প্রখর তাপ।  মণি অসাধ্য সাধনে অগ্রসর হয়েছে।  ধনীর আদরিণী কন্যা, সুকোমল শরীর, সুখে বর্ধিত। দূর পথ পায়ে হাঁটায় অনভ্যস্ত, ঘর্ম সিক্ত হয়েছে তার দেহ ও পরিহিত বস্ত্র। স্নিগ্ধ কোমল মুখ মন্ডল হয়েছে জবা ফুলের মতো টকটকে লাল। কঙ্করময় অসমতল অরণ্যপথ অতিক্রম করা তার পক্ষে।  বড় কষ্ট সাধ্য। পদতল ক্ষত বিক্ষত হয়ে বেদনার সৃষ্টি করছে।

 

যুবক তার প্রিয়তমার প্রতি এক একবার তাকিয়ে দেখে।  ওর অবস্থা দেখে তার অন্তরে অনুভব করে বেদনা এবং ভাবে “এ মা বাপের কতো আদরের দুহিতা, সুখেবর্ধিতা।  ‘আহা, এ বিলাসিনী কোমলাঙ্গিনী নবীনা নারী এ অভাগাকে ভালোবেসে এতো দুঃখ ভোগ করছে।  এখন একটু বিশ্রাম করা প্রয়োজন। ” এই মনে করে সে তরুণীকে বলল “প্রিয়া, এখন একটু বিশ্রাম করা যাক। ” দ’জনে ঘন ছায়া যুক্ত এক বৃক্ষ মূলে উপবেশন করল।  যুবকটি বৃক্ষের কয়েকটা পল্লব নিয়ে প্রিয়াকে বীজনে প্রবৃত্ত হলো।  তরুণীর ললাট ও মুখ থেকে অজস্র ঘর্ম বিন্দু ঝরে পড়তে লাগল। বস্ত্রাঞ্চলে স্বেদকণা মুছে সে হেসে বলল প্রিয়তম, তোমায় দেখছি, এরই মধ্যে প্রিয়তমাকে স্বস্তি ও আনন্দ দান করতেও শিখেছো। 

 

তরুণ বল মৃদু হেসে “প্রিয়সখি, বাল্য কাল থেকে তুমিই তো শিখিয়ে এসেছে প্রিয়তমার কি রূপে করতে হয় আনন্দ বর্ধন।  তুমিই তো গুরু স্বরূপা। ” তরুণী জিহ্বায় কামর খেয়ে বলল “মাণিক আমার, অমন কথা বলতে নেই।  তুমি আমার স্বামী, গুরু, প্রাণেশ্বর।  পত্নীকে গুরু বলতে আছে? আমায় দোষী করলে, তজ্জন্য তোমার পায়ে প্রণাম জানাচ্ছি। ” যুবক আশ্চর্য হয়ে বলল “আমি এতদূর অন্যায় বলে ফেললাম।  আচ্ছা, এমন ভুল আর হবে না।  কিন্তু, আমি বুঝতে পারিনি ‘স্বামী, গুরু ও প্রাণেশ্বর’ এসব গুরুত্ব পূর্ণ পদের যে আমি অধিকারী হয়ে বসেছি।”

 

“হ্যাঁ আমিন, সেদিনই ধর্ম সাক্ষী করে অনন্য মনে তোমায় বরণ করে নিয়েছি।  আমি লোকাচার মানি না, আমি মানি ধর্মকে।  অন্তরে একমুখে অন্য তা আমি অন্তরের সাথে ঘৃণা করি।  অন্তরের অন্তঃস্থলে যে সত্য নিহিত আছে আমি তারই পূজা রিণী।  সততাই মানবত্বের মূল ভিত্তি। ” যুবক সবিস্ময়ে বল্ল “তাই না কি!” যুবতী বলল দৃঢ় তার সাথে “নিশ্চয়ই তাই।  তা না হলে, আমার পক্ষে আজ এতো বড়ো মহান ত্যাগ সম্ভব হতো না।  আমি জানি, তোমাকে অবাধ নিবিড় ভাবে পেতে হলে ত্যাগের মাধ্যমেই পেতে হবে। ”

 

সব শুনে যুবক অবাক হয়ে গেল।  তখন এক অনাবিল শান্তি ও তৃপ্তিতে তার হৃদয় ভরে উঠল। পত্নী প্রেমের জোয়ার যেন তার প্রাণের দু’কূল ছেপে প্রবাহিত হলো। তাকে নীরব দেখে মণি বলল “প্রিয়তম, আমাদের আর কত দূর যেতে হবে?” যুবক বলল “এ দীর্ঘ পথ হেঁটে খুব কষ্ট বোধ করছে না। ” মৃদু হেসে তরুণী বলল “প্রিয়তম, তুমি যেখানে সেখানেই তো আমার শান্তি এবং সুখ।  দুর্লভ বস্তু পেতে হলে, দুঃখের মাধ্যমেই তো।  পেতে হয় দুঃখের পেছনে রয়েছে অনন্ত সুখ।  আমি যা সানন্দে সাগ্রহে বরণ করে নিয়েছি, সেখানে দুঃখের কথা আসতে পারে না।  এসব কথা এখন থাক, কোন দিকে যাবে, যাওয়া যাক আর কত দূর যেতে হবে, কোথায় বসতি স্থাপন করা হবে, তা তো বললে না?” যুবক বলল, “আমি ভাবছি তোমার ভাব গম্ভীর কথা গুলো।  তোমার কথা কিন্তু খুব চমৎকার!” “হয়েছে, আর প্রশংসা করতে হবে না।  তোমায় কি জিজ্ঞাসা করলাম তাই, বলো না। ”

 

“আমরা কোথা যাবো, সে কথা? যে দিকে যাচ্ছি, সে দিকেই যেতে থাকবো সন্ধ্যা পর্যন্ত।  তখন যে গ্রাম পাবো, সে গ্রামেই হবে আমাদের।  বসত বাড়ী এখন চল প্রিয়ে, আরো অনেক দূর যেতে হবে। ” এ বলে উভয়ে আবার চলতে আরম্ভ করল।  আজ কন্যা সম্প্রদানের দিন।  তাই শ্ৰেষ্ঠী ভবনের সর্বত্র চলছে উৎসব কার্যের সাড়ম্বর প্রস্তুতি।  প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গেই ঐকতান মঞ্চে বাদ্য ভান্ড বাজ্জতে আরম্ভ করল।  মণির পিতা সর্বত্র গিয়ে পরিদর্শন করছেন এবং কাজের নমুনা দিচ্ছেন।  কর্মচারীরা কাজে বড় ব্যস্ত।

 

বেলা অনেক হয়েছে।  মণির প্রকোষ্ঠ দ্বার এখনও বন্ধ।  সে যাবার সময় বুদ্ধি করে জানালা দিয়েই বের হয়ে গিয়ে ছিল।  শোভন এসে “দিদি মণি, দিদি মণি” বলে ডাকতে লাগল, আর দ্বারে করা ঘাত করতে লাগল।  কিন্তু, দিদির কোনও সাড়া না পেয়ে, সে গিয়ে বলল মাকে “মা, দিদি মণি এখনে যে উঠছে না! এতো ডাকলাম, তার কোনও সাড়া নেই!” মাতা অবাক হয়ে বলল “কি, এখনে ওঠেনি!” “তুমি গিয়ে দেখো মা, কাল কিন্তু, দিদি খুব কেঁদে ছিল। ”

 

শ্ৰেষ্ঠী পত্নী হাতের কাজ ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে মণি, মণি, বলে বার বার ডেকে যখন সাড়া পেলেন না, তখন তিনি গিয়ে স্বামীকে বললেন “দেখতো মেয়ের কান্ড, তার ঘুম তো আজ ভাঙ্গছে না! এতো ডাকলাম, কোনও যে সাড়া নেই!” শ্রেষ্ঠী বিরক্ত হয়ে বললেন “কি বলছো? রাতে হয় তো ঘুম হয়নি, একটু বেলা করে ঘুমাচ্ছে আর কি!” “বেল কি কম হয়েছে? আর অতো ঘুমোতে হবে না, তুমি গিয়ে জাগিয়ে দাও গে।  আমার মন কিন্তু কেমন করছে।  রাতের কি সব দুঃস্বপ্ন আমার মন কেমন ভারি করে তুলেছে।  যাও, শীগগির ওকে তুলে দাও। ”

 

পত্নীর কথা শুনে শ্ৰেষ্ঠীর প্রাণ কেঁপে উঠল।  পুত্র কন্যার অমঙ্গল আশংকা করাই মাতা পিতার স্বভাব ধর্ম।  তিনি দ্রুত গিয়ে “মা মণি, মা মণি” বলে বার বার ডাকলেন এবং দ্বারে করাঘাত করলেন।  কিন্তু, কোনও সাড়া নেই।  তিনি চিন্তা যুক্ত ও আতঙ্ক গ্রস্ত হলেন।  শোভন প্রকোষ্ঠের চার ধারের জানালায় করা ঘাত করে ডাকতে লাগল।পালংকের পাশের জানালাটায় হাত দিতেই তা খুলে গেল।  সে দেখল প্রকোষ্ঠে কেউ নেই, পালংক শূন্য। তার বাবাকে ডেকে বলল “বাবা, এদিকে জানালা খোলা রয়েছে, দিদিকে তো দেখছি না। ” এ বলে প্রকোষ্ঠে ঢুকে দ্বার খুলে দিল।  শ্ৰেষ্ঠী প্রকোষ্ঠে ঢুকে কন্যাকে না দেখে মহাচিন্তা গ্রস্ত হলেন।  বাড়ীর সর্বত্র অন্বেষণ করা হলো, কোথাও নেই। আর তাঁদের ছোট চাকর সেই আশ্রিত যুবক টিকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।  তখন সকলেরই সন্দেহ হলো শ্ৰেষ্ঠী কন্যা নিখোঁজ হবার মূলে রয়েছে একমাত্র তারই চক্রান্ত।

 

শ্রেষ্ঠী কর্মচারীদের পাঠিয়ে দিলেন নানা দিকে, নানা স্থানে।  অশ্বারোহণে তারা ছুটে গেল।  শ্রাবন্তীর সর্বত্র অন্বেষণ করল, আনাচে কানাচে দেখল, কোথাও তাদের সন্ধান পাওয়া গেল না।  বৃথা হলো পরিশ্রম।  নিষ্ফল মনোরথ হয়ে সকলেই ফিরে এলো।  মাতা কান্না জুড়ে দিলেন।  কেঁদে কেঁদে তিনি সংজ্ঞাহারা হয়ে গেলেন।  শ্রেষ্ঠী দুঃখে, ক্ষোভে, লজ্জায় অপমানে মরমে মরে গেলেন।  মর্মন্তুদ দুঃখ ও আতংকে সমভাবেই তিনি আক্রান্ত হলেন।  তাঁর মন একেবারে ভেঙ্গে পড়ল, অন্তর যেন শূন্য তার হাহাকারে ভারাক্রান্ত, হৃদয়ের বল হারিয়ে ফেললেন।  তিনি শয্যায় আশ্রয় নিলেন। কাঁদতে লাগলেন তিনি, অশ্রু জলে সিক্ত হলো উপাধান।  এক একবার আকুল কণ্ঠে বলে ওঠেন “মা মণি, তুই কোথা গেলি মা, আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয় মা।  ‘আমার সাধনার ধন, নয়ন মণি ফিরে আয়, ফিরে আয়। ” আবার ক্ষুব্ধ স্বরে বলে ওঠেন “অকৃতজ্ঞ দুষ্ট দুরাচার, তোকে পথ থেকে কুড়িয়ে এনেছিলাম, আমার অন্নে তোর রক্ত মাংস, শেষ কালে আমাকেই করলি সর্বস্বান্ত, দুধ দিয়ে কাল সাপ পোষণ করেছিলাম, পরিশেষে আমাকেই করছি দংশন।  আগুন জ্বেলে দিয়েছিস, অন্তর পুড়ে যাচ্ছে, উঃ, দারুণ জ্বালা।  পাষন্ড, তোকে এর প্রতিফল নিশ্চয়ই ভোগ করতে হবে, এ আগুন তোকে দগ্ধ করবে, ভস্ম করবে।  কৃতঘ্ন, তোর রক্ষা নেই।  উঃ, ভীষণ জ্বালা!”

 

বর পক্ষ ও কন্যা পক্ষের লোকেরা হলো দুঃখিত বিস্মিত, স্তম্ভিত।  বন্ধ হয়ে গেল বিবাহের সকল উদ্যোগ আয়োজন।  উৎসব মুখর বিবাহ বাড়ী হলো শাশানের মতো নিস্তব্ধ শোকাহত।  নগরে, গ্রামে, পথে, ঘাটে সর্বত্র কেবল আলোচনা চলতে লাগল মণির।  সকলেই এ বলে নিন্দা করতে লাগল “দেখো তো! কী দুষ্ট মেয়ে।  বর ঠিক হয়েছে রাজ পুত্রের মতো, বাপ হলো খরচান্ত, বিয়ের দিন পালিয়ে গেল চাকরের সঙ্গে।  পথ থেকে কুড়িয়ে এনে মেয়ের সাথে দিলে অবাধ মেলা মেশা করতে।  হায় রে খেলার সাথী! কুলে কলংক লেপন করে চলে গেল কুলকলঙ্কিনী হয়ে, ছিঃ ছিঃ দেখে তো কেমন ভ্রষ্টা দুশ্চরিত্রা মেয়ে! কুলটা পতিতা হলি তো বাপু অজ্ঞাত কুল শীল অপদার্থের সঙ্গে! কী জঘন্য কথা!”

 

পতিতা (পটিত) আচার থেকেই মণি লোক সমাজে ‘পটাচারা’ নামেই আখ্যায়িত হলো।  মণি নাম ঘুচে গিয়ে পটাচারা নামেই সে হলে পরিচিত।  অস্তাচলের অন্তরালে দিন মণি ডুবে গেল। ধূসর অঞ্চল ছড়িয়ে সন্ধ্যা রাণী নেমে এলো ধরণীর বুকে।  এমন সময় দু’জন অতিথি উপস্থিত হলো জন বিরল এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক পুকুরের পাড়ে।  অতিথি দু’জনের মধ্যে একজন তরুণ, অপরটি তরুণী।  পথ শ্রান্ত হলেও যুবক সুদর্শন, সুগঠিত তার অঙ্গসৌষ্ঠ। যুবতী লাবণ্যময়ী, সুদক্ষ শিল্পী বিশ্বকর্মার নির্মিত চারুশিল্প।  এরূপ সুন্দর যুবক যুবতী এদেশে বিরল।

 

অপরিচিত আগন্তুক দেখে স্থানীয় কয়েক জন লোক সেখানে সমবেত হলো।  সকলেই তাদের পরিচয় জানতে চাইল।  যুবতী লজ্জায় অধোবদন হলো। যুবক বলল আপনারা আমাদের চিন বেন না, বহু দূর দেশ শ্রাবস্তীর আমরা নাগরিক।  আমাদের দেশ আপনাদের অপরিচিত।  তাই কি করে পরিচয় দেবো বলুন।  যাক, আজ এক রাত্রি এখানে অবস্থান করতে হবে, তেমন কোনও দয়ালু ব্যক্তি আমাদের।  প্রতি অনুগ্রহ করবেন কি?”

 

একজন অবস্থাপন্ন কৃষক উপস্থিত ছিলেন।  আগন্তুকদের প্রতি তার দয়া উৎপন্ন হলো।  তিনি বললেন “হ্যা, তোমরা পথশ্রান্ত হয়েছে, আজ রাত্রে আমার গৃহেই বিশ্রাম করতে পার। ” এ বলে তিনি আগন্তুকম্বয়কে সঙ্গে করে গৃহে নিয়ে গেলেন।  অতিথিদ্বয় কৃষকের আতিথ্য গ্রহণ করল।  এই অতিথিদ্বয় মণি বা পটাচারা ও যুবকটি।  সেই গ্রামে তাদের নিয়ে বহু আলোচনা চলতে লাগল।  লোকেরা অনুমান করে নিল “উভয়েই বড় লোকের ছেলে মেয়ে হবে, তাদের চেহারা দেখেই বুঝা যায়।  মনে হয়, একে অন্যের ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে পালিয়ে এসেছে।  যা হোক, ভালো হয়েছে, আমাদের গ্রামে একটি পরিবার বেড়ে গেল। ”

 

তারা সে দেশেরই অধিবাসী হলো।  একটা স্থান নির্বাচন করে।  তাদের বসত বাড়ী প্রস্তুত করল। সেখানকার হিত কামীদের সুপরামর্শে যুবক কৃষি কর্ম করবে মনস্থ করল।  পটাচারার অলংকার বিক্রি করে যুবকটি গরু লাঙ্গলদি কৃষি কর্মের যাবতীয় দ্রব্য সংগ্রহ করল।  কাজ আরম্ভ হলো  গ্রামের নিকটবর্তী অরণ্যের পাশে কিছু অনাবাদী জমি আবাদ করল।   আবার অবসর সময়ে সে বনে গিয়ে জ্বালানী কাঠও আহরণ করে থাকে।

 

আর পটাচারা গৃহের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সংগ্রহ করে ঘরকন্না আরম্ভ করল।  কলসী ভরে জল আনে, বাটনা বাটে, উদূখলে ধান ভানে, রান্না করে, সেলাই করে।  গৃহ স্থালীর সকল কাজই সম্পাদন করে।  যদিও বা এসব কাজে সে অনভ্যস্ত, তবুও তার উৎসাহ উদ্যমের অন্ত নেই।  তার একান্ত ইচ্ছা তার প্রত্যেক কাজই সুন্দর হোক, উত্তম।  হোক কারণ, তার প্রতিটি কার্যে সন্তুষ্ট করতে হবে তার প্রিয়তমকে।   নতুন সংসার পেতে বসা কতো ঝঞ্জাট, কতো খাটুনি, তবুও এতে তার কোনো দিন নিরানন্দের আভাস পাওয়া যায়নি।   থাকতে হবে তাকে দশ জনের মাঝে একজন হয়ে, চলতে হবে সকলের সঙ্গে তাল।  মিলিয়ে।  তার প্রত্যেক কাজই শৃঙ্খলা পূর্ণ, বাড়ীর সর্বত্র পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।  আসবাব পত্রের সুন্দর সজ্জা ইত্যাদি দেখে প্রতিবেশী নর নারী সকলেই চমকৃত হয় এবং প্রশংসা বাক্যে বলে “ভদ্র পরিবারের মেয়ে হবে। ”

 

স্বামীর যে সময়ে যা প্রয়োজন, এর যেন কিছুই ক্রটি না হয়, সেদিকে তার বিশেষ দৃষ্টি।  সন্ধ্যায় কর্ম ক্লান্ত স্বামী ফিরে আসে কর্ম স্থান থেকে। এর পূর্বেই পটাচারার সমাপ্ত হয় রন্ধন কার্য। তাড়াতাড়ি এসে স্বামীকে বসবার আসন পেতে দেয়, পাখার শীতল বাতাস দানে প্রিয়তমের শান্তি বিনোদন করে।   হাসি মুখে মধুর প্রিয়ালাপে মনে শান্তি দেবার প্রয়াস পায়।  স্বামী বলে “হাতের পাখাটি আমায় দাও। ” পটাচারা বলে “কেন?” “তোমার কষ্ট হচ্ছে। ” “এ কষ্টে আনন্দ আছে, পতি ব্রতা নারী স্বামী সেবায় আনন্দ পায়; থাতে পুণ্যও আছে।  নারীকে স্বামীর পরিচর্যা করতে হয় দাসীর মতো, সে পুণ্যে নারী পায় সুগতি।  তুমি আমার সুগতির প্রতি বন্ধক হতে চাও?” “কেন” “আমায় যে সেবা করতে দিচ্ছ না। ” “তুমি এতো কথা জান!”

 

“এটা তো না জানার কথা নয়।  মেয়েদের এসব জানা থাকাই উচিত।  না জানাটাই সুখ শান্তির পরিপন্থী।  যেহেতু, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।  যাক, আর কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, স্নান সেরে এস।  আমি আহারের আয়োজন করছি।  যুবক যখন খেতে বসে, তখন পটাচারা পাখার বাতাস করে এবং এটা ওটা সুখাদ্য পাতে দিয়ে তৃপ্ত করে। উভয়ের আহার কৃত্য সমাপনান্তে বিবিধ আলাপ কৌতুকে পরস্পর পরস্পরের সন্তোষ বর্ধনের চেষ্টা করে।  যুবক চিন্তা করে “মণি পিতৃ গৃহে কতো সুখেই না ছিল।  কতো দাস দাসী তার সেবা করতো, তার খাওয়া পরা কতো উচ্চস্তরের।  শয্যা কতো কোমল ও দুধের মতো ধবধবে সাদা সুন্দর, কোন কাজ কর্ম তাকে করতে হতো না, অথচ এখানে কতো কষ্টই না সে করছে।” এচিন্তা করে সে পটাচারার প্রতি অত্যধিক করুণা ও সহানুভূতি সম্পন্ন হয়ে সদয় ও প্রীতি পূর্ণ ব্যবহারই করে। কিন্তু, নিজের পরিশ্রম জনিত যে দুঃখ, তা তার অন্তরেই গোপন রাখে।  পটাচারার সম্মুখে সর্বদা সে প্রসন্ন বদনেই থাকে, এরূপেই তাদের দিন চলে।  মোহ হতেই সংসারের উদ্ভব।  মোহের প্রভাবেই অনিত্যে নিত্য, অসত্যে সত্য, দুঃখে সুখ প্রত্যয় হয়।  অজ্ঞজনই মোহে মোহিত হয়ে প্রপঞ্চময় আশায় বিষয় বিষে জর্জরিত হয়।  মূঢ়জন বোঝে না এ সংসার মরু প্রান্তরের ভীষণ মায়ামরীচিকাসম দুঃখদায়ক।  মহা অন্ধ তাপের সৃষ্টি করে মোহ।

 

প্রথম সূচনা পটচারা হয়েছে অন্তঃসত্ত্বা।  যে মুহূর্তে সে অনুভব করল তার অন্তর্বত্নী অবস্থা, সে মুহুর্তেই একটা দুর্ভাবনা এসে তার সমগ্র অন্তরকে নিপীড়িত করে তুলল।  যত দিন যেতে লাগল, তার দুশ্চিন্তাও ততবেড়ে চলল; মনও হতে লাগল দুর্বল অশান্ত।  সেভাবে “গর্ভবতী নারী ক্রমশঃ উপস্থিত হয় জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে।  গর্ভভার দুর্বহ। রমণীদের পক্ষে এটাই খুব সংকট মুহূর্ত।  এসংকট হতেকে আমায় রক্ষা করবে? কার যত্নে ও পরিচর্যায় আমি নির্বিঘ্ন হবো? সম্মুখে আসছে আমার মহাবিপদ।  এখানে আমার সেরূপ কোন আত্মীয় নেই, যার সাহায্যে অনুকম্পায় আমি নিরাপদ হতে পারি।  জগতে মাতা পিতাই পরম শান্তিময় আশ্রয়।  এমন স্নেহ মমতা, মৈত্রী করুণা আর কারো অন্তরে বিরাজ করতে পারে না।  আমি মাতা পিতা নিকটই যাবো।  তাদের পায়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবো।  স্নেহের আধার মাতা পিতা কি আমায় ক্ষমা করবেন না? নিশ্চয়ই করবেন।  আমি যাবো তাঁদেরই আশ্রয়ে, তাঁদেরই শান্তিময় স্নেহের ছায়াতলে। ”

 

সন্ধ্যার সময় যুবক কর্মস্থান থেকে ফিরে এলো।  কিছু ক্ষণ বিশ্রামের পর স্নান সেরে আহার করল।  তার পর উভয়ে সুখাপে প্রবৃত্ত হলো।  সুযোগ পেয়ে পটাচারা মৃদু হেসে বলল “তোমায় একটা কথা বলবো।” যুবক সহাস্যে বলল “একটা কেন, এতক্ষণ অনেক কথা তো বলে ফেললে।” “এটা কিন্তু, খুব গুরুত্বপূর্ণ!” যুবক চক্ষু বিস্ফারিত করে বলল “গুরুতু পূর্ণ! তেমন কোনো কথা বলো না কিন্তু, থাতে আমার ভয় করে।  আমার মন এতো লঘু যে, গুরুভার মোটেই সয় না। ”

 

“তোমার হেঁয়ালি রাখ, আমার কথার গুরুত্ব নষ্ট করোনা। ”

“আচ্ছা, তা হলে বলো তোমার কি কথা। ”

“বছি তোমার আশালতা ফলবতী হয়েছে। ”

“ফলবতী হয়েছে! বেশ, ফল হলে সুখ ভোগ করা যাবে। ”

“এই আবার হেঁয়ালি। ”

“কি বলতে চাও, সোজা বলে ফেল না।  

আশালতা ফলবতী এসব আমি বুঝি না। ”

 

“তবে শোন আমি জীবন মরণ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। ”

“তাও বুঝলাম না, আরো স্পষ্ট করে বলো। ”

“মা গো, তুমি কেমন পুরুষ, এ কথাটি বোঝ না!”

“তুমি বলতে না জানলে, কি করে বুঝবো?”

“আচ্ছা তা হলে বলি আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি। ”

“তা তো আনন্দের কথা। ”

“আনন্দ তো করবে, যদি আমি বেঁচে থাকি। ”

“বাঁচবে না! কেন?”

 

“তাই তো বলছি ‘আমার জীবন মরণ সমস্যার সন্ধিক্ষণ। ’  কতো নারী যে, 

এ অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, তা কি তুমি শোনো নি?”

“তুমি যে ঢলে পড়বে, তার নিশ্চয়তা কি?”

“ঢলে যে না পড়বে, তারও বা নিশ্চয়তা কি?”

“যাক, তোমার মরণের কথা আমার মোটেই ভালো লাগে না। 

 তুমি এখন কি বলতে চাও, বলো। ”

 

“পুরুষেরা মেয়েদের দুঃখ বোঝে না।  মেয়েদের এ বিপদই মহাবিপদ। এ বিপদ ত্রাণের জন্য আমি মা বাপের কাছে যেতে চাই।  মেয়ের দুঃখ লাঘবের জন্য মা নিশ্চয়ই যত্ন নেবেন।  এখানে তো আমার সেরূপ বান্ধব কেউ নেই। ” যুবক বিমর্ষ হয়ে বলল “পাগল হয়েছে।  কি করে যে এসেছো, সব ভুলে গেছো! সেখানে গেলে কি আর রক্ষা আছে? তুমি তাদের মেয়ে, হয়তো তোমায় ক্ষমাও করতে পারেন।  কিন্তু, আমাকে যে ক্ষমা করবেন না, একথা অবধারিত।  নিশ্চয়ই আমাকে হত্যা করবেন।  তুমি কি তাই ইচ্ছা কর?”

 

“তুমি অমন কথা বলো না, আমার বড়ো দুঃখ হয়।  আমার ভালোবাসায় আঘাত পড়ে।  তোমার এতো ভয় হলে, আমায় নগরদ্বারে দিয়ে ফিরে আসতে তো পারো চার পাঁচ মাস পরেই তো আবার ফিরে আসছি। ” “তবে তাই হবে। ” “কখন যাবে?” “একটা ভালো দিন দেখে যাবো আর কি। ” পটাচারা এখন পূর্ণ গর্ভা।  এযাবৎ তার পিতৃ গৃহে গমন ঘটে ওঠে নি।  কারণ, স্বামীটি কেবল দিন ফেলছে।  কাল পরশু করে সময় একেবারে ঘনিয়ে এসেছে সে পত্নীকে আশ্বাস দিচ্ছে বটে, কিন্তু তার মোটেই ইচ্ছা নয় যে, তার প্রিয়তমা পিত্রালয়ে যাক।

 

পটাচারা মহা ভাবনায় পড়ল।  তার মনে এবার বিরক্তি ধরে গেল।  চিন্তা করল “স্বামী আমায় মিথ্যা বলে ফাঁকি দিচ্ছেন মাত্র।  তিনি যাবেন না, এটাই ঠিক।  আমাকে কিন্তু যেতেই হবে।  তাকে না বলেই যেতে হবে।  কাল প্রাতে আমিচলে যাবো।” এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো।  পটাচারী। রাত্রি প্রভাত হলো।  যুবক কর্ম স্থানে চলে গেল। পটাচারা গৃহকর্মী সম্পাদনের পর তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে খেয়ে নিল।  স্বামীর আহার্য ঢেকে রেখে পিতৃগৃহ অভিমুখে যাত্রা করল। যাবার সময় প্রতিবেশিনী এক রমণীকে বলে গেল।

 

দুপুরে খাওয়ার সময় যুবক এসে দেখল পটাচারা ধরে নেই।  ‘অন্বেষণ করে দেখল, কোথাও নেই।  প্রতিবেশিনীর নিকট জানতে পারল সঠিক সংবাদ।  সে বিশেষ অনুতপ্ত হয়ে চিন্তা করল “আহা, এ সম্ভান্ত বংশের কন্যা আজ আমার কারণেই অসহায়।  তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ” সে খেয়ে দ্রুত গিয়ে অর্ধ পথে তার সাক্ষাৎ পেয়ে বলল “প্রিয়ে, আমি বারণ করছি, তুমি যেয়ো না। ” “না প্রিয়, আমাকে যেতেই হবে।  তুমি বার বার ফাঁকি দিয়ে আমায় গুরু ভারাক্রান্ত করেছা।  এখন পথ চলতে আমার কী যে কষ্ট হচ্ছে, তা তুমি বুঝবে না। ” “তাই বলছি, তুমি যেও না; অনুরোধ করছি, কাতর বাক্যে বলছি তুমি যেও না।  আমার মন সায় দিচ্ছে না, তোমার কল্যাণ হবে বলে মনে হচ্ছে না, তুমি যেও না। ”

 

“প্রিয়তম, তুমি সেজন্য চিন্তা করো না।  মা আমার শান্তি ময়ী কল্যাণ ময়ী মায়ের কাছে পৌছলেই সব শান্তি পূর্ণ ও কল্যাণ ময় হয়ে যাবে। ” এ বলে পটাচারা অগ্রসর হলো স্বামীর কাতর অনুরোধ উপেক্ষা করে।অগত্যা যুবক ও তার সঙ্গে সঙ্গে যেতে লাগল।  কিছু দূর যাওয়ার পর পটাচারার প্রসব বেদনা আরম্ভ হলো।  যুবককে তা জানাল এবং এক বৃক্ষ ছায়ায় গিয়ে বসল।  অসহ্য বেদনায় অস্থির হয়ে সেখানেই সে শুয়ে পড়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগল। বহু দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে সে প্রসব করল এক পুত্র সন্তান।  এ সময় যা কর্তব্য যুবকটি তা সম্পাদন করল। প্রসূতি একটু সুস্থ বোধ করলে, যুবককে বলল প্রিয় যে উদ্দেশ্য পিত্রালয়ে যাচ্ছিলাম, তা যখন সম্পন্ন হয়ে গেল, এখন আর কেন যাবো।চলো, গৃহে ফিরে যায়। ”

 

যুবক বলল “বেশ ভালো কথা, চলো। ” বলে সে শিশুকে বক্ষে নিল। প্রসূতি খুব ধীরে ধীরে চলল।  গৃহে পৌঁছতে তাদের রাত্রি হয়ে গেল। রাত্রে যখন শিশু সন্তানকে বক্ষে নিয়ে জননী শয়ন করল, তখন পটাচারা পূর্ণ মাত্রায় উপলব্ধি করল সন্তানের প্রতি জননীর কি রূপ স্নেহ মমতা ও মৈত্রী করুণা।  তখন স্নেহ কণার অফুরন্ত ভান্ডার তার জনক জননীর কথা মনে পড়ল, চিন্তা করল অকুল অন্তরে তাদের অমৃতময় মৈত্রী মমতার কথা।  তখন সে পারল না আত্ম সম্বরণ করতে, কেঁদে উঠল ব্যাকুল অন্তরে।  হৃদয় দগ্ধ হতে লাগল তীব্র অনুতা পানলে, মর্মান্তিক দুঃখে হলো জর্জরিত, অভিভূত।

 

বৎসরাধিক পরের কথা।  পটাচারা আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে।  এবারও সে মাতা পিতার নিকট যাবার জন্য আকুল হয়ে উঠল।  স্বামীকে বলল সেকথা।  কিন্তু তার পরিবর্তন হয়নি পূর্বমনো ভাব।  পটাচারা কেঁদে কেঁদে তাকে অনুরোধ করতে লাগল।  অগত্যা তাকে নিতে হলো মিথ্যার আশ্রয়।  কাল যাবে, পরশু যাবো করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অতীত করতে লাগল। এরূপে পটাচারা হলো এখন পূর্ণ গর্ভা।  আর অপেক্ষা করার সময় নেই।  যুবকের অজ্ঞাতে সে ছেলেটিকে কোলে নিয়ে পূর্বের মতোই পিতৃ গৃহা ভিমুখে যাত্রা করল।  সে ক্ষণেই এক কাক বিকট ‘কা ক’ কারর করে তার মস্তকের উপর দিয়ে উড়ে গেল।  এটা যে শুভ লক্ষণ নয়, তা চিন্তা করে পটাচারার মনও কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।  তবুও সে দুর্মনা হয়েও অগ্রসর হলো।

 

পূর্ণ গর্ভা পটাচারার পক্ষে ছেলে কোলে নিয়ে পথ চলা বড়ো কষ্ট কর হয়ে উঠল।  কিছু দূর গিয়েই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।  তার মনেও তীব্র বিরক্তির সঞ্চার হলো এবং নিজের প্রতিও ধিক্কার এলো।  “আমিই তো এ দুঃখকে বরণ করে নিয়ে ছিলাম স্বেচ্ছায় ও সানন্দে।  তখন তো সবই সুখময় বলে মনে হয়ে ছিল! মা বাপের মনে দিয়েছি কতো দুঃখ, কতো বেদনা।  তারা কি অপমানে জর্জরিত হননি? দগ্ধ হননি অনুতা পানলে? তাদের চিত্ত ক্ষোভ কি অভি শাপে পর্যবসিত হয়নি? সে সঙ্গে আমার জীবনও অতি শপ্ত হয়নি? আমি খুবই অন্যায় করেছি, পাপ গ্রস্ত হয়েছি। এর সমুচিত দন্ড নিশ্চয়ই আমাকে ভোগ করতে হবে। ”

 

কর্ম শক্তি মহাশক্তি।  স্বর্গ মর্ত্যের প্রত্যেকেই এ দুর্জয় শক্তির করায়ত্ত। যে মেয়ে কুলটা হয়ে আদি গুরু, মহাগুরু, ব্রহ্মা সদৃশ মাতা পিতার অন্তরে অশান্তির তীব্র অনল জ্বেলে দেয় তাকেই ভোগ করতে হয় অসহ দুঃখ, সারা জীবন অনুতাপে দগ্ধ হতে হয় তিলে তিলে।  পটাচারার দুষ্কর্মের নিষ্ঠুর বিপাক যব নিকার অন্তরাল থেকে নির্মম পরিহাসে তাকে বলে দিচ্ছে “হে দুর্বিনীত কুলকলঙ্কিনী নারী, তোর ললাটে লেখা রয়েছে এর চেয়েও ভীষণতর দুঃখ।  সমাগত হচ্ছে যে মর্মদাহী নিদারুণ দুঃখ। দুঃসহ দুঃখানলে হতে হবে দগ্ধীভূত কর্মের।  কর্মের তাড়নে হতে হবে নির্যাতিত।  রক্ষা নেই, ত্রাণ পাবার উপায় তোর নেই। ”

 

যুবক দ্রুত অনুধাবন করে অর্ধপথে পটাচারার সঙ্গে একত্র হলো।  এবার কিন্তু সে বরণ করল না, সেও সঙ্গে সঙ্গে যেতে লাগল।  শিশু পুত্রকে সে কোলে নিল।  পটাচার অত্যধিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তবুও ধীরে ধীরে পথ অতিক্রম করতে লাগল।  ক্রমশঃ এসে অরণ্য পথ সম্প্রাপ্ত হলো। অতি কষ্টে চলতে লাগল পটাচারা কলঙ্কময় বন্ধুর পথে।  কিছু দূর গমনের পর অকাল মেঘ উঠল।  ঘোর কালো মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন হলো।  প্রবল শীতল বায়ু প্রবাহিত হতে লাগলো।  পুনঃ পুনঃ বিদ্যুৎ স্ফুরণে গগন মাত্র প্রদীপ্ত হয়ে উঠল।  মুহুর্মুহুঃ প্রলয়ঙ্কর বজ্রনির্ঘোষ কর্ণ বধির করে তুলল, দেহ বার বার চমকে উঠল, প্রাণে মহা আতঙ্কের সৃষ্টি করল।  সে সঙ্গে আরম্ভ হলো মুষলধারে বৃষ্টি পাত।

 

এমন সময়ে পটাচারারও আরম্ভ হলো প্রসব বেদনা।  উঃ, দুঃখ! আশ্রয় নেই।  অগত্যা এক বৃক্ষ মূলে বসে পড়ল।  বৃষ্টির জলে সবাই সিক্ত হতে লাগল, প্রবল শীতে সবাই কম্পমান, আতংকেও সন্ত্রস্ত।  শিশুটি কাঁদতে লাগল চিৎকার করে।  তখন যে পটাচারার কি রূপ সংকট মুহূর্ত, কী যে দারুণ দুঃখ যন্ত্রণাময় দুঃসময়, তা বর্ণনাতীত।  তীব্র প্রসব বেদনায় তরুণীর তন্বী দেহলত লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।  সে কাতর কণ্ঠে বলে উঠল “প্রিয়তম, রক্ষা কর, রক্ষা কর শিশুকে।  উঃ, অসহ্য যন্ত্রণা! আমি আর বাঁচবো না।  না বাচি ক্ষতি নেই; কিন্তু, প্রাণেশ্বর, যে আসছে সুকোমল শিশু সন্তান, তাকে রক্ষা করো, বৃষ্টি থেকে রক্ষা কর।  প্রিয়তম, যাও, শীগগির যাও, লতা পাতা যা পাও নিয়ে এসো।  উঃ, তীব্র বেদনা, আর সহ্য হচ্ছে না।  যাও, তাড়াতাড়ি গিয়ে নিয়ে এসো।”

 

যুবক দ্রুত গমন করল।  দ্রত হস্তে লতা পাতা সংগ্রহ করতে করতে সে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।  পটাচারা অস্ফুট কাতর শব্দে পাশ পরিবর্তন করতে লাগল।  বলতে লাগল কাতর ক্রন্দনে “মাগো, মা জননী, এসংকট থেকে ত্রাণ পেতে যাচ্ছিলাম তোমার আশ্রয়ে, এ পোড়া অদৃষ্টে তা ঘটলো না।  দেখে যাও মা, একটি বার দেখে যাও, স্নেহ ময়ী মা আমার, তোমার আদরের মণি কী দারুণ সংকটে পড়েছে।  মাগো বাবাগো তোমাদের পায়ে আমার এ ভিক্ষা আমায় ক্ষমা কর। মাগো, উঃ যন্ত্রণা! ওগো মা, মা!” বলে কাতরোক্তি করতে করতে সে প্রসব করল এক সুন্দর পুত্র সন্তান।  “আহা দুঃখ, ইনি গেলেন কোথা! এতক্ষণ হলো এখনো তার দেখা নেই কেন? স্বামী শীগির এসে শিশুকে রক্ষা কর।  কই এলে না?” বলল প্রসূতি কাতর কণ্ঠে।

 

দিবা অবসান হলো।  সন্ধ্যা নেমে এলো।  বৃষ্টি থেমে গেছে।  আকাশ কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন।  দেখতে দেখতে ধরা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।  যে দিকে চায়, সে দিকে আঁধার।  এ অন্ধকার ঘেরা অরণ্যে প্রভৃতি পটাচারার উপায় কি? এ বিপদে তাকে কে রক্ষা করবে? একটু আশ্বাস দেবারও তো কেউ নেই! যে একজন ছিল সেও তো কোথায় অন্তর্ধান করল! শিশু দ’টিও সচিৎকারে কাঁদতে লাগল সমতালে।  জননী তাদের শান্ত করবে কোন উপায়ে? প্রবল শীতে কাঁপছে প্রসূতি, কাপছে শিশু দু’টি।  মাটি সিক্ত, দেহ সিক্ত, কাপড় সিক্ত, সব কিছুই সিক্ত।  কি করবে দুর্ভাগিনী জননা? কি রূপে সন্তান দ্বয়কে রক্ষা করবে? একটু উষ্ণতার বিধান করবে, দুর্বিষহ দুঃখে মায়ের হৃদয় যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।  সে করল কি, তার বুকের ধন দুটিকে রাখল বুকের নীচে; হাতের কনুই ও জানুর উপর ভর রাখল আপন দেহের।

 

শ্বাপদ সঙ্কুল অরণ্য, ক্ষণে ক্ষণে বিপদের আশংকায় অবলা সন্ত্রস্ত।  বৃক্ষ পত্র থেকে জল পড়ার শব্দেও সে শিউরে উঠে।  দুঃখের বিদ্রিরজনী শেষ হতে চায় না।  কতো চিন্তা, কতো অশান্তি, কতো অনুতাপ তার অন্তরকে করছে নিপীড়িত নিষ্পেষিত।  আহা, অভাগিনী পটাচারার এ কেমন দুঃখ। সে ভাবে “আমার এ অভিশপ্ত জীবনে সুখের মুখ দেখবো কি? যাকে ভালোবেসে, যার আশায় কুলত্যাগিনী হয়ে এতো দুঃখ ভোগ করছি, সে এখন কোথায় গেল? সে কি বিপদ গ্রস্ত হলো?  ভগবান, আমার প্রিয়তমের যেন কোন বিপদ না ঘটে।  আমার মন কেন এরূপ করছে! স্বামীর বিপদ আশংকায় প্রাণে হাহাকার জাগলো কেন?  হা অদৃষ্ট, না জানি আমার কপালে কি আছে?  উঃ, আর যে চিন্তা করতে পারছি না।

 

আমার বুক যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে।  স্বামিন, প্রাণেশ্বর, আমার পরমায়ু সব তোমায় দিচ্ছি, তুমি আরো দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকো।  উঃ, কি কু ক্ষণে আমি জন্মে ছিলাম জানি না।  আমার স্নেহ মন্দাকিনী মাতা, করুণা নির্ঝর, পিতা ও রক্তের সম্বন্ধ জ্ঞাতিদের মুখে কালি দিয়ে কুলকলঙ্কিনী হয়ে কুল ত্যাগ করে ছিলাম।  তাদের মর্মান্তিক দুঃখ দানের এই তো সমুচিত প্রতি ফল! মোহই আমায় মতি ভ্রম করে দিয়ে ছিল।  উঃ, দুর্দান্ত মোহ, তুই করলি আমার সর্বনাশ।  চরম দুঃখময় দুর্দিন সৃষ্টি করলি তুই।  তোর এ কেমন প্রভাব! আহা, আমার এ লাঞ্ছিত ঘৃণ্য জীবনের এহেন দুঃখ বারতা শুনে তরুণী কুমারীগণ সাব ধান হবে কি? ওগো কুমারীগণ, এহেন দারুণ দুঃখ পূর্ণ মোহ পাশে জীবনে কখনও পা দিও না, এটা আমার একান্ত অনুরোধ।  আমি ভুক্ত ভোগিনী হয়ে তোমাদের সাব ধান করছি। ”

 

ঐদিকে পটাচারার স্বামী যুবকটি প্রবল বারি ধারা মাথায় নিয়ে দ্রুত গিয়ে নানা স্থানে থেকে লতা পত্র সংগ্রহ করছিল।  দেখল, এক বলীকের উপর লতাঝাড় ও বড় বড় পত্র।  দেখেই সেগুলি সংগ্রহে ব্যস্ত হলো। সেখানে ছিল এক কালান্তক সর্প, ঘোর বিষধর।  লতা যেই আকর্ষণ করল, অমনি ক্রুর সর্প ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে করল দংশন।  দংশন করা মাত্রই অগ্নি জ্বালার মতো দেহে দারুণ জ্বালার সৃষ্টি হলো।  চোখে সে অন্ধকার দেখল।  আর্ত কাষ্ঠে বলে উঠল “উহুঃ, জ্বলে গেলাম, জ্বলে গেলাম; চোখে তো কিছুই দেখছি না; পারলাম না, পারলাম না প্রিয়ে, তোমাদের রক্ষা করতে; উঃ, জ্বালা জ্বালা, দারুণ জ্বালা” বলতে বলতে সে মাটিতে ঢলে পড়ল।  তার সর্বাঙ্গ হয়ে গেল ঘোর নীলবর্ণ।  সেখানে সে মুহূর্তেই তার মৃত্যু হলো।

 

কাল রাত্রির অবসান ঘটল।  প্রভাত হলো।  ধীরে ধীরে তরুণ তপন তার সোনালী কিরণ অরণ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে দিল।  মার্তান্ডের প্রবল প্রতাপ অশুভ রজনীর বিভীষিকাকে বিদূরিত করে দিল।  আকাশ নির্মল। মনোরম সাজে সজ্জিত হয়েছে প্রকৃতি।  বিহঙ্গ কূল প্রফুল্ল মনে রব করছে।  দুই একটা কোকিল মধুর স্বরে প্রকৃতির সৌম্যভাব ঘোষণা করছে।

 

প্রকৃতির মোহন দৃশ্য পটাচারার অন্তরে কিন্তু প্রভাব বিস্তার করতে পারল না।  তার চিত্ত দুশ্চিন্তা গ্রস্ত, শঙ্কাকুল ও ভীতিব্যাকুল।  সে ধীরে ধীরে বসল। দেহ হিম শীতল ও রক্ত শূন্য, বড়ো দুর্বল, মুখ মন্ডল বিশুদ্ধ পাংশুবর্ণ, চক্ষু কোটরাগত।  তার অন্তরে কে যেন বলে দিচ্ছে “পটাচারা, তোর দুঃখ এখনও শেষ হয়নি।  আরো রয়েছে যা এর চেয়েও ভীষণতর, দারুণতর শোক দুঃখ সমাকুল।  তাতে তোকে হতে হবে নিপীড়িত, মর্মাহত, অভিভূত। “স্বামীকে খুঁজে দেখতে হবে, অবস্থা বুঝতে হবে” পটাচারা এ করে দুর্বল হাতে ধীরে সযত্নে বক্ষে তুলে নিল তার বক্ষের ধন নবজাত শিশুটি।  স্নেহা তিশয্যে শিশুর মুখে ললাটে অঙ্কিত করলো স্নেহ চুম্বন।  একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে সে ধীরে উঠে দাঁড়াল।  বড় শিশুটির হাত ধরে বলল “এসো বাবা, তোমার পিতা কোথায় গেল দেখি। ”

 

পটাচারা ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে বন পথে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলো।  তার হৃদয় বল্লভ যে পথে গিয়েছিল, সে পথ ধরেই সে যেতে লাগল।  কিছু দূর গিয়ে বল্মীকের কাছে থমকে দাঁড়াল।  মুখ দিয়ে বের হয়ে পড়ল একটা মর্মন্তুদ অস্ফুট কাতর ধ্বনি।  মাথা ঝিমুঝিম করে উঠল, থর থর কাঁপতে লাগল সর্বাঙ্গে, চোখে অন্ধকার দেখল, বক্ষ বিদীর্ণ হবার উপক্রম হলো, হৃৎপিণ্ড যেন ছিড়ে যাচ্ছে এরূপ অনুভূত হলো।  তখন সে আর্তকণ্ঠে কেঁদে উঠে স্বামীর প্রাণ শূন্য দেহের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। কেঁদে কেঁদে সে বলতে লাগল “স্বামী, প্রিয়তম, একটি বার।  চোখ খোল, চেয়ে দেখো তোমার আশা আকাঙ্খর স্নেহের দুলাল নবজাত শিশুকে।  যার আবির্ভাবের কথা শুনে তুমি আনন্দিত হয়ে ছিলে, তাকে একটিবার দেখো।  প্রাণেশ্বর, আমায় না বলে কোথায় লুকালে? কার হাতে আমায় সঁপে দিয়ে গেলে? শিশুদের কি গতি হবে? কাকে তার বাবা ডাকবে? প্রাণ নাথ, অভাগিনীর জন্য কতো যে দুঃখ পেলে। আমাদের রক্ষা করতে গিয়ে তুমি প্রাণ হারালে।  আহা, সাপের দংশন, কী দারুণ জ্বালা! কী ভীষণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তোমার প্রাণ বায়ু বের হয়ে গেছে।  আহা, হৃদয় রতন, তুমি চলে গেলে, চির তরে? আমি আর চিন্তা করতে পারছি না।  উঃ, এতো দুঃখ আমার কপালে ছিল! হায় হায়, অভাগিনীর একি হলো।” বলে কপালে করা ঘাত করতে লাগল, কাতর কণ্ঠে বিলাপ আরম্ভ করল  

“হায় হায়! একি হল

সর্পবিষে মৃত্যু হল।

অরণ্যেতে হয়ে অসহায়।  

অভাগীর প্রাণনিধি

হরি কেন নিলে বিধি,

অনাথিনী করিয়া আমায়।  

শিরে মম বক্স হানি

কেন গেলে প্রাণ মণি

শোক শেল হৃদয়ে বিধিয়া,

ওগো মম প্রাণ পতি

কি হবে আমার গতি

কোথা গেলে মোরে ফাকি দিয়া।  

শিশু তব প্রাণ ধানে

না দেখিলে দুনয়নে

এই দুঃখ ভুলিব কেমনে?

চোখ খোল প্রাণ পতি

করিতেছি এ মিনতি

দেখ তব হৃদয় রতনে। ”

এরূপ হৃদয় বিদারক বিলাপ করতে করতে বন থেকে কয়েকটা ফুল চয়ন করল।  প্রাণ পতির দেহের উপর রেখে পূজা করল, প্রণাম করল। তার পর বিলাপের সুরে বিদায় নিল চির বিদায়।

“ওগো! বাল্য বন্ধু প্রাণ সখা

তোমাকে রাখিয়া একা

চলে যেতে হৃদয় বিদরে,

ক্ষম ওগো মোরে তুমি

বহু দোষে দোষী আমি

নিবেদন করি সকাতরে। 

ছোট কালে যবে

মম মাত্র পথ বয়ঃক্রম

প্রীতি পাশে বাধিলে আমায়,

আবাল্য বান্ধব তুমি

কি রূপে ভুলিব আমি

ওগো স্বামী প্রণমি তোমায়।  

প্রাণ কাঁদে অশ্রু ঝরে

শোকানলে দগ্ধ করে

হৃদে মম পাষাণ বাঁধিয়া,

বিদায় নিতেছি প্রভু,

দেখা নাহি হবে কভু

বন মাঝে তোমাকে রাখিয়া। ”

এরূপ বিলাপ করতে করতে পাচারা শিশুদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে ধীরে ধীরে পিত্রালয় অভিমুখে চুল।  সে এতো দুর্বল, এতো কাতর হয়ে পড়ল যে, তার দেহ কাঁপতে লাগল, মাথা ঘুরতে লাগল, অবশ হয়ে এলো পদদ্বয়। দুঃখের উপর দুঃখ, অনাহার অদ্রিা, আর কতো সহ্য হয় অবলা প্রসূতি নারীর।  তবুও চলতে লাগল।  কিছু দূর চলার পর সম্মুখে পড়ল বিস্তীর্ণা অচিরাবতী নদী।  পূর্ব দিনের প্রবল বৃষ্টির দরুণ।  নদীতে জল হয়েছে এক বুক পরিমাণ, স্রোত হয়েছে প্রখর।

 

পটাচারার সাহস হলো না শিশু দ্বয়কে এক সঙ্গে নিয়ে নদী পার হতে।  বড় ছেলেকে বলল “বাবা, এখন তুমি এখানে বসে থাকো, তোমার ছোট ভাইকে ওপারে রেখে আসি, পরে তোমায় নিয়ে যাবো। ” এ বলে শিশুকে মস্তকের উপর তুলে ধরে অতি কষ্টে সে নদী পার হতে লাগল। খর স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়।  তার দুর্বল শরীরে।  যত টুকু শক্তি আছে, তা দিয়ে সংগ্রাম করতে লাগল স্রোত গতির বিরুদ্ধে।  অতি কষ্টে উত্তীর্ণ হলো পরতীরে।  কতেক বৃক্ষ পত্র সংগ্রহ করে তদু পরি শিশুকে শুইয়ে রেখে আবার সে নদীতে নেমে পড়ল।  নদীর মধ্য স্থলে যখন সে পৌছল, তখন দেখে যে এক শ্যেন পক্ষী শ্যেন নজরে নিরীক্ষণ করছে তার নয়ন মণিকে।  রক্তি মবরণ শিশু টিকে মাংস খন্ড মনে করে শ্যেন পক্ষী তৎক্ষণাৎ ছোঁ মেরে তাকে নিয়ে চলল উর্ব আকাশের নীলপথে।

 

জননী দিশেহারা হয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে চীৎকার করে শব্দ করল “হো হো, হোয়া হোয়া হায় হায়। ” তার এ শব্দ পেছিল না শোনের কর্ণে।  গগন পথে নিয়ে চল শ্যেন অভাগিনীর দুঃখে লব্ধ বক্ষ নিধিকে তীক্ষ্ম নখশল্যে বিদ্ধ করে, শিশুর করুণ ক্রন্দন ধ্বনি শোনা যাচ্ছে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর।  হত বুদ্ধি ও মূহ্যমান হয়ে পটাচারা অপর তীরের ছেলেটির প্রতি চোখ ফিরাতেই দেখতে পেল ছেলেটি নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।  কারণ হলো মাতাকে উর্ধ হস্তে ‘হায় হায়’ চীষ্কার করতে শুনে সে মনে করল মা তাকে ডাকছে।  তখন সে দ্রুত এসে নদীর জলে ঝাপিয়ে পড়ল।  আর কি রক্ষা আছে? জল রাশি তাকে সাদরে গ্রহণ করল।  শিশু নিমগ্ন হলো জলে।  স্রোতাস্বিনীর স্রোত তাকে দ্রুত নিয়ে চলল সোল্লাসে।

 

সব শেষ! কিং কর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পটাচারা দাড়িয়ে রইল সেখানে নদীর মধ্য স্থলে।  সে হয়ে গেছে সংজ্ঞা হারার মতো।  কিছু ক্ষণ দাড়িয়ে থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হায় হায় করুণ স্বরে কেঁদে কেঁদে কম্পিত কলে বরে ধীরে ধীরে এসে তীরে উঠল।  যেখানে তার নবজাত শিশুটি রেখে ছিল, সেখানে এলো।  শোকাবেগ সংবরণে অসমর্থ হয়ে সেখানেই সে লুটিয়ে পড়ল।  তার শরীর ও মন এতো দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, রোদন করার শক্তিও সে হারিয়ে ফেলেছে, চোখের জলও শুকিয়ে গেছে।  বুদ্ধি বিবেচনাও লোপ পেয়েছে।  বক্ষ যেন চুরমার হয়ে।  যাচ্ছে, হৃৎপিণ্ডে যেন বিদীর্ণ হচ্ছে।  দুঃখের উপর দুঃখ, আর কত সহা।  যায়।  শোক, দুঃখ ও বিয়োগ যন্ত্রণা তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করল।  কখন যে সে সংজ্ঞহারা হয়ে মাটিতে ঢলে পড়েছে, সেও জানে না।  প্রখর রৌদ্র, উর্ধে অসীম নভোমন্ডল, নিম্নে বিশাল ধরিত্রী, পার্শ্বে তর তর বাহিনী অচিরাবতী।

 

জগত আত্যন্তিক দুঃখ পূর্ণ এটা চির সত্য।  কেবল অচ্ছেদ্য দুঃখের মধ্য দিয়েই চলছে জন্ম মৃত্যুর প্রবাহ। জীব জীবনে সুখের পরিকল্পনা ঐন্দ্রজালিকের মায়া উদ্যানের মতো।  দারুণ দুঃখের অঝোর ধারাবর্ষী রজনীর ঘনান্ধকারে বিদ্যুৎ চমকের মতো মিথ্যা সুখের আলোকে যে বিহ্বল হয়ে পড়ে সে নিশ্চয়ই বাতুল।

মহা দুঃখে জর্জরিত মানব জীবন,

অবিদ্যা কারণে হয় দুঃখের সৃজন।  

জন্ম দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, দুঃখ শৈশবের,

মহা দুঃখ যৌবনের, দুঃখ বার্ধক্যের।

অপূর্ব বাসনা আর প্রিয়ের বিয়োগ,

নিদারুন দুঃখময় অপ্রিয় সংযোগ।  

জরা মরণের দুঃখ বড় ভয়াবহ,

অনির্বাণ চলে এই দুঃখের প্রবাহ।

পটাচারা আজ বড়ো দুঃখিনী, অনাথিনী।  কী না ছিল তার! কোন দুঃখে সে বিসর্জন দিল সর্বস্ব, ত্যাগ করল কুল, মাতা পিতা আত্বীয় স্বজন? কিসের তাড়নায় বরণ করে নিল মহাদুঃখকে? আজ কেন সে সর্বহারা, দিশা হারা, সংজ্ঞাহারা হয়ে পড়ে রয়েছে মৃত্তিকা শয্যায় ? আহা, কী যে দারণ দুঃখ এ দুঃখিনী নারীর! এ দুঃখের অবসান ঘটবে কখন? না কি এর চেয়েও ভীষণতর দুঃখ রয়েছে ওর অদৃষ্টে!

 

দিবাকর পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে নেমে পড়েছে।  শীতল বায় প্রবাহিত হচ্ছে।  তারই স্পর্শে পটাচারার সংজ্ঞা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগল।  তার শরীর ও পরিহিত বস্ত্র ধর্মসিক্ত।  অনুভব করল সে অত্যধিক দুর্বলতা অবশতা।  এত ক্ষণ যাবৎ সে কোন অচিন দেশে গিয়ে ছিল তার প্রাণ পতি ও হৃদয় রত্ন শিশু দ্বয়ের সন্ধানে, তা সে বুঝে উঠতে পারছে না।  সে সংজ্ঞা লাভ করল বটে, কিন্তু এখনও প্রকৃতিস্থ হতে পারেনি।  সে বুঝতে পারছে না, তার যে কি অবস্থা হয়েছে।  মৃত্তিকা শয্যায় শায়িত কেন, সে তা চিন্তা করতে লাগল।

 

ক্রমশঃ মনে পড়ল তার জীবনের সমস্ত ঘটনা।  এবার কেঁদে উঠল ডুকরে।  দুর্বল কাতর কণ্ঠে বলে উঠল “হায় হায়, পতি মরল পথে, দু’টি পুত্রের একটি নিল শ্যেন পক্ষী, আর একটি মরল নদীর জলে ডুবে। আমি হলাম সর্বহারা, দিশা হারা।  আমার জীবন অভিশপ্ত।  মা বাপের অন্তরে দিয়েছি বড়ো জ্বালা।  আমি পাচ্ছি তার শত গুণ অধিক যন্ত্রণা। উঃ, বুক ফেটে যাচ্ছে।  দুর্ভাগিনীর মরণও নেই।  এখন যাবো, মা বাপের পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবো।  আহ, তাঁদের অন্তরে কতো স্নেহ, কতো মমতা। ” এরূপ সে অনেক কথা চিন্তা করল।  সে মাথার মধ্যে কেমন এক যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল।  কখনো কাঁদে, কখনো বিলাপ করে, কখনো নীরব থাকে।  চোখে কিন্তু জল নেই।  তার শোকা বেগ যখন উচ্ছল হয়ে পড়ে, তখন আরম্ভ করে বিলাপ।  সে বিলাপ কত করুণ, কত মর্মান্তিক

পতি পুত্র তিনজন

দুঃখিনীর প্রাণধন

করে গেল মোরে অনাথিনী,

ওরে মম বাছাধন

দেখা দিয়ে কিছু ক্ষণ

কোথা গেলি নয়নের মণি।

আমি বড় অভাগিনী

চির দুঃখী মা জননী

এত দুঃখ সহিব কেমনে,

হায় হায় একি দুঃখ!

দুঃখিনীর নাহি সুখ

এত দুঃখ পাই কি কারণে!

বড় আশা ছিল মনে

নিয়ে পতি পুত্র ধনে

সংসার পাতি মন সুখে,

হায় হায়! একি হল

ভরা নৌকা ডুবে গেল

শোকানল জ্বলে মম বুকে।

ওগো পতি, কত করে

নিবারিলে বারে বারে

না শুনিয়া তোমার বচন,

কর্ম দোষে অবশেষে

নিদারুণ দুঃখ এসে

শোক তাপে করিছে পীড়ন

আমি অভাগিনী নারী

এ শোক সহিতে নারি

শোকা নলে বড় যে ভীষণ,

দুই পুত্র, প্রিয় পতি,

দিলে মোরে দুঃখ অতি

সারা ক্ষণ দহিতেছে মন। 

নিজকে ধিক্কার দিয়ে বলছে

ওরে তুই পটাচারা

স্বামী পুত্র সর্ব হারা

অভি শপ্ত তোর এ জীবন,

তুই বড় পাতকিনী

লজ্জাহীনা কলঙ্কিনী

পাপ তোর নিশ্চয় ভীষণ।  

মাতা পিতা গুরু জনে

দিয়ে ছিস দুঃখ মনে

মোহ বশে প্রণয়ে মাতিয়া,

দুষ্ক র্মের প্রতিফল

অনু তাপে অবিরল

দহিতেছে দুঃখিনীর হিয়া।  

কে আমায় শান্তি দেবে।  

অশ্রুবারি মুছে নেবে

দুঃখ হারী কে আছে ধরায়,

মাতা পিতা আদিগুরু

স্নেহ নিধি কল্পতরু

দিবে তারা সান্ত্বনা আমায়।

শোকাকুলা পটাচারা ধীরে ধীরে গিয়ে উপনীত হলো পিতৃ ভবনের কিছু দূরে।  পথে স্ব গ্রামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলো।  তাকে কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল “হ্যা গো, তুমি আমার মা বাপের খবর জান? তারা কেমন আছেন জান?” লোকটা বিস্ময় দৃষ্টিতে চে বল্ল “তোমার মা বাপ কে হন?” “জান না? এ দেশে যিনি ধন বান শ্রেষ্ঠী নামে পরিচিত, রাজ পথের ধারে যার প্রকান্ড বাড়ী, তার যে ছিল এক মেয়ে আদরের দুলালী মণি। ”

“তুমি মণি নাকি?”

“হ্যা গো, হ্যাঁ। ”

“তাঁদের খবর না শুনলেই ভাল হতো। ”

“কেন, অমন করে বলছো কেন?”

“তাদের কথা শুনে সুখী হতে পারবে না। ”

“তবুও বলো, তোমার পায়ে পড়ি,

তারা কেমন আছেন বলো। ”

গতকাল যে দুর্যোগ হয়ে গেল, তা জান?”

“জানি না? খুব ভালো করেই জানি।  

সে ভীষণ দুর্যোগের দুঃসহ দুঃখ যে,

আমিও সম্পূর্ণ ভোগ করেছি,

শুনবে? না না, আগে বলো আমার মা বাপের সংবাদ।

গতকাল যে খুব প্রবল ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেছে, তখন এক দারুণ বজ্র পাত হয়েছিল।  এসব দুর্যোগে তোমার বাবার প্রাসাদটা ধ্বসে পড়ল দেওয়াল চাপা পড়ে মারা গেল তোমার বাবা, মা, ভাই এ তিনজনই।  তিন জনকেই এক চিতায় সৎকার করা হচ্ছে; ওই দেখো চিতার ধূম। ”

“এ্যা, কি  শোনালে? তিনজনই মরেছে”

“হ্যাঁ, তিনজনই মরেছে। ” লোকটা চলে গেল।

তখন পটাচারার কি অবস্থা লো? তার মস্তকেও যেন একটা বজ্রপাত হলো।  চোখ অন্ধকার হয়ে মাথা ঘুরে সে পড়ে গেল।  সে যেন এ পৃথিবীতে নেই।  ভূমন্ডল যেন ঘুরছে কুলালচক্রের মতো।  স্মৃতি বিভ্রম ঘটল তার।  সে উন্মাদিনী হয়ে গেল।  অট্টহাস্য করে উঠে দাঁড়ালো। একবার এদিক ওদিক বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে পিতৃভবন অভি মুখে ছুটল। সে কখনো কাঁদে, কখনো হাসে, কখনো বিলাপ করে, কখনো গান করে, কখনো প্রলাপ বকে, কখনো থমকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায় বিহ্বল দৃষ্টিতে।  ছেলের দল তার পিছু নিল।

 

উন্মাদিনী এবার পিতৃ ভবনের প্রাঙ্গণে এসে থমকে দাঁড়ালো।  বিহ্বল দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখতে লাগল।  জন মানব শূন্য ভগ্ন প্রাসাদের দিকে কিছু ক্ষণ চেয়ে রইল বিলোল কটাক্ষে অথচ ভাব গম্ভীর দৃষ্টিতে। কি যেন স্মৃতি পথে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে।  কি যেন তার মনে পড়েছে।  তখন দৃষ্টি হলো তার করুণ ও দুঃখ মিশ্রিত, বিমর্ষ হয়ে গেল মুখ মন্ডল, জ্বলে উঠল শোকানল, গুমরে সে কেঁদে উঠল।

 

ক্ষণকাল সে নীরব থেকে এদিক ওদিক দেখতে লাগল।  তার পর বিড় বিড় করে কি বলতে লাগল।  ক্রমশঃ শব্দ স্পষ্ট হলো।  বললো সে কেঁদে কেঁদে “মা মা, বা বা, ভাই ভাই।  ঘর ভেঙ্গেছে, বা বা মরেছে মা মরেছে,

আর ভাই ম রে ছে,

সব গিয়েছে,

হয়েছে ছার খার,

হয়েছে ছার খার।  

একটা অট্টহাস্য করে উন্মাদিনী সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।  ছেলের দল ‘হৈ চৈ’ “পাগলী পাগলী” বলে তার পিছু নিল।

 

পাগলিনী পটাচার কখন যে কোথায় যায় ঠিক নেই।  সে এখন বস্ত্র হীনা। তার বসন কখন কোথা খসে পড়েছে সে খবর সে রাখে না; প্রয়োজনও মনে করে না।  কথা বলে সে অপ্রয়োজনে, হাসে অকারণে, রোদন করে, বিলাপ করে, যত্র তত্র ঘুরে বেড়ায়।  বালকেরা তার পেছনে হৈ চৈ করে, ধূলি মারে, ঢিল ছুঁড়ে।  আহা, ধনীর দুলালীর একি দুর্দশা! এ কি দুর্ভোগ! তার কর্মের একি নিমম পরিহাস!

 

শ্রাবস্তীর জেতবন বিহার।  ভগবান গৌতম বুদ্ধ ধর্মদেশনা করছেন।  মহাপরিষদে ভিক্ষু ভিক্ষুণী, উপাসক উপাসিকা, ধনী দরিদ্র, পন্ডিত মূখ, আপামর সর্ব সাধারণ সমবেত হয়ে ছেন। তথাগতের কম্বু কণ্ঠ মুখর হয়ে উঠল নৈর্বণিক ধর্ম বিশ্লেষণে।  শ্রোতৃ বৃন্দ অনন্য মনে শুনছেন অমিয় মধুর ধর্মোপদেশ।  সকলেই ভাবাবেশে তন্ময়।  সভা নীরব নিথর।  কেবল ধ্বনিত হচ্ছে সুগতের পীযুষবর্ষিনী বাণী।  এ সময় পটাচারা যাচ্ছিল আপন খেয়ালে বিহারের সম্মুখবর্তী রাজ পথ দিয়ে। মহাকারুণিকের করুণা দৃষ্টি পড়ল তার প্রতি।  সুগত তাকে লক্ষ্য করে এমন এক অপূর্ব শক্তি প্রয়োগ করলেন যার প্রভাব তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে লাগল সভাভিমুখে।  তখনি সে দাঁড়াল স্তব্ধ হয়ে।  ফিরল বিহারের দিকে।  ধীরে ধীরে অগ্রসর হলো। তার অনি মেষ দৃষ্টি বিন্যস্ত করল শাস্তার প্রতি।  গুঞ্জন উঠল মহাপরিষদে।  প্রধানেরা বলে উঠল “বাধা দাও পাগলিনীকে।  এদিকে আসতে দিও না, তাড়িয়ে দাও। ”

 

“বারণ করো না, আসুক পাগলিনী” সমুদ্ধের গম্ভীর কষ্ঠ ধ্বনিত হলো।  সকলে নিরস্ত হলো। শাস্ত্রী বল লেন, “ভগ্নি, পূর্ব স্মৃতি লাভ করো। ” একথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই স্মৃতি লাভ করল সে। পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো।  উন্মত্ততার নিরসন হলো।  তখনি তার উলঙ্গাবস্থা জানতে পারলে সে।  অসীম লজ্জায় সে বসে পড়ল।  সভা থেকে এক ভদ্রলোক নিজের গায়ের চার তার প্রতি নিক্ষেপ করলেন, সে তা পরিধান করল তাড়াতাড়ি। তার পর সে ধীরে ধীরে উপনীত হলো সুগতের নিকট, বন্দনা করল পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে।  বলল বিনীত বাক্যে “প্রভু, আমায় আশ্রয় দিন। আমি আপনার শরণাপন্ন হচ্ছি, আপনি আমার প্রতিষ্ঠা হোন। ভগবান, পথে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে সর্পদংশনে, এক পুত্রকে নিয়ে গেছে শ্যেনপক্ষী, অপর পুত্রটি অচিরাবতী জলে ডুবে মরেছে, মহাদুর্যোগে গৃহ ভেঙ্গে, তাতে চাপা পড়ে মাতা, পিতা ও ভ্রাতা তিন জনেরই মৃত্যু হয়েছে, তিন জনকেই এক চিতায় দাহ করা হয়েছে।  ভগবান, আমার দারুণ দুঃখ।  সর্ব হারা দিশা হারা হয়ে আমি কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াচ্ছি!”

 

তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ বললেন “পটাচারা, তোমার কোনো চিন্তা নেই।  তোমার ত্রাণ, শরণ ও আশ্রয় হবার মতো সামর্থ বানের নিকটই তুমি উপস্থিত হয়েছে।  কেবল এ জীবনে যে পতি পুত্র, মাতা পিতা ও ভ্রাতার মৃত্যুতে তোমাকে কাঁদতে হচ্ছে তা নয়, এর পূর্বেও অনন্ত জন্ম পুত্রাদি আত্মীয় স্বজনের জন্য যে কেঁদেছো, চোখের সে জল যদি একত্র করা হয়, চার মহা সমুদ্রের জলের চেয়েও অধিক হবে।  কখন থেকে তোমার যে, সংসার পরি ভ্রমণ আরম্ভ হয়েছে, তা নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য।  এর আদি সীমা রেখা দিব্য দৃষ্টিরও অগোচর।  কেন তুমি প্রমাদিত হচ্ছ?”

 

তথাগত ভাষিত এই একান্ত সত্য বাণীর মর্মার্থ উপলব্ধি করে পটাচারার মনো দুঃখ লাঘব হয়ে গেল।  সম্বুদ্ধ তার চিত্তের অবস্থা জ্ঞাত হায়ে উপদেশ পূর্ণ গাথা দেশনা করলেন

“পিতা পুত্র অবথা আত্মীয় বর্গ কেউই রক্ষা

করতে পারে না।  মৃত্যু গ্রাসে পতিত হলে,

তোমার রক্তের সম্বন্ধ জ্ঞাতিও তোমায় রক্ষা

করতে বা আশ্রয় দিতে পারবে না।  

এ সত্য জ্ঞাত হয়ে শীল ও সংযম পরায়ণ প্রান্ত ব্যক্তি

যথা সত্বর নির্বাণ পথ পরিস্কার করে নেন। 

সুগতের এ অমূল্য বাণী পটাচারার তৃষিত অন্তরে অমৃত বর্ষণ করল। তিনি হলেন স্রোতাপন্না। তাঁর চিত্ত গ্লানি হলো বিদূরিত।  দারুণ দুঃখের হলো নিরসন।  নৈর্বণিক চিরসত্যের রশ্মি সম্পাতে তাঁর আলোকোজ্জ্বল। জগতে এমন শান্তি, এমন প্রীতি সুখ যে বিদ্যমান আছে, এটা ছিল তাঁর ধারণার অতীত।  তাঁর আগ্রহ বেড়ে গেল, তিনি জানতে চান, দেখতে চান এশান্তি এ প্রতি সুখের উৎস কোথায়।  পেতে চান তিনি দুঃখের চির নিবৃত্তি।

 

প্রীতিময়ী পটাচারা প্রীত বাক্যে বললেন “শান্তি নিঝর ভগবান আমার নির্জন সাধনার উপায় করুন।  আমি জিন শাসনে প্রব্রজ্যা লাভের ইচ্ছা করি। ” শাস্তা প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন “সাধু, সাধু, পটাচারা সুগত শাসনে তোমায় প্রব্রজ্যা দেওয়া হবে।  সর্ব দুঃখান্ত কারক প্রব্রজ্যা ধর্মসম্যক প্রতি পালনে উৎসাহিত হও, তাতে আত্মনিয়োগ কর। ” তথাগত তাঁকে ভিক্ষুণীদের নিকট পাঠিয়ে দিলেন।  লব্ধ হলো পটাচারার প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা।  অনন্য মনে প্রতি পালন করতে লাগলেন তিনি ভিক্ষুণীর প্রতি পাল্য নিয়মাবলী, বিনয় শীল।  প্রব্রজ্যার অনাবিল সুখে তিনি এখন সুখিনী। সে সুখ অনুপমেয়।  সুখ দ্বিবিধ একটা গৃহী সুখ, অপরটা প্রব্রজ্যা সুখ! গৃহী সুখ তৃষ্ণা বিজড়িত, সন্তাপ বহুল।  প্ৰব্ৰজা সুখ নৈর্বণিক রসে রসিত, বিরাগের অমৃত ধারায় সিক্ত, পরাশক্তির স্নিগ্ধতায় ও শীতলতায় পরি পূর্ণ, শান্ত।  মুক্ত সমিত।

 

ভিক্ষুণী পটাচারা আধ্যাত্মিক চিন্তায় মগ্ন থাকেন।  অনিত্য দুঃখ অনাত্মা এ ত্রিলক্ষণ ভাবনায় তিনি আত্ম নিয়োগ করেছেন।  উদয় ব্যয় যা উদয় হয়, তা ব্যয় হয়, ধ্বংস হয়, এটা চির সত্য। প্রাণী কুল জন্ম মৃত্যুর অধীন।  জন্ম হলেই মৃত্যু অনিবার্য, এটা জাগতিক বিধান।  যা অনিত্য তাই দুঃখ পূর্ণ।  যেটা অনিত্য ও দুঃখ পূর্ণ সেটা আমার বা আমি মনে করা নিতান্তই ভুল, অজ্ঞানতা প্রসূত, মোহের পূর্ণ বিকাশ।  এসব চিন্তায় তিনি তন্ময় হয়ে যান।  তখন তাঁর বাহ্যিক জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। প্রব্রজ্যা জীবনে এই তো সুখ।  আধ্যাত্মিক চিন্তা বা ভাবনা অমৃতরসে ভরপুর।  বুদ্ধ বলেছেন “ত্রিলক্ষণ ভাবনায় অভিনিবিষ্ট যোগী অমৃত ভোগ করে, পরমা মৃতের আস্বাদ পায়। ” যোগিনী পটাচারা।  রাত্র দিন অমৃত ভোগই করছেন।

 

একদিন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে। ত্রিলক্ষণ ভাবনা নিরতা অভি রমিতা ভিক্ষুণী পটাচারা পাদ প্রক্ষালন করছেন।  তিনি পাত্র পূর্ণ জল নিয়ে প্রথম কিছু জল তাঁর পায়ে ঢাললেন।  সে জল মাটিতে পড়ে কিছু দূর গেলে মাটি তা শোষণ করে ফেলল।  দ্বিতীয়বার আর কিছু জল ঢাললেন, সে জল আরো কিছু অধিক দূর গেল এবং মৃত্তিকা সিক্ত করল।  তৃতীয় বার ঢাললেন অবশিষ্ট জল, সে জল আরো কিছু অধিক দূর গেল এবং তা মাটি শোষণ করল।  এ তিন বারের তিন প্রকার অবস্থা, এটাই তাঁর অনিত্য ভাবনাময় চিত্তে প্রবল ইন্ধন জোগাল।  তিনি চিন্তা করলেন তুলনা মূলক যা তাঁর আপন জীবনেও ঘটেছে, যা তাঁকে করেছিল পীড়িত, ব্যথিত, বিধ্বস্ত “আমার প্রথম সিঞ্চিত জলের মতো এ জগতে কারো কারো মৃত্যু হয় প্রথম বয়সে; দ্বিতীয় বারের দূরতর গত জলের মতো মধ্যম বয়সেও মৃত্যু হয়।  তৃতীয় বারের দূরতম গত জলের মতো অন্তিম বয়সেও মৃত্যু হয়। ” এরূপে অনিত্য ভাবনায় মন সংযোগ করে প্রদীপ হস্তে প্রবেশ করলেন আপন প্রকোষ্ঠে।  মঞ্চের উপর সমাসীন হয়ে প্রদীপ নির্বাপিত করলেন এবং ভাবনায় অভি নিবিষ্ট হলেন। ক্রমশঃ গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন তিনি।

 

তখন সর্বজ্ঞ বুদ্ধ আপন বাস স্থান গন্ধ কুঠিতে অবস্থান করি ছিলেন। তিনি দিব্য দৃষ্টিতে সন্দর্শন করলেন পটাচারার বর্তমান চিত্তাবস্থা। উপযুক্ত সময় মনে করে সম্বুদ্ধ আপন বাস স্থানে বসেই এমন এক স্নিগ্ধ সুন্দর অপূর্ব জ্যোতি পটাচারাকে লক্ষ্য করে বিকশিত ও প্রসারিত করলেন যে, তাঁর ধ্যান নিমীলিত চোখে মুখে সে আলো পড়তেই তিনি চোখ মেললেন।  দেখতে পেলেন সে জ্যোতি’র মধ্য দিয়ে জ্যোতির্ময় বুদ্ধ যেন তার সম্মুখে দিব্যাসনে সমাসীন হয়ে রয়েছেন।  তাকেই লক্ষ্য করে তিনি বলছেন “পটাচারা, রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এ পঞ্চ স্কন্ধের উদয় ব্যয় সম্বন্ধে যে জন অজ্ঞ, তার শত বৎসরের আয়ুষ্কাল অপেক্ষা উদয় ব্যয়ে অভিজ্ঞ এবং তা মনশ্চক্ষে সম্যক দর্শনকারী ব্যক্তির ক্ষণকালের জীবন অধিকতর শ্রেয়। ” শাস্তার এ একান্ত সত্য বাণী পটাচারার ভাবিত চিত্তে এমন এক আলোক সম্পাত করল যে দীপ নির্বাপিত হওয়ার মতো তাঁর তৃষ্ণাও নির্বাপিত হলো।পটাচারা অৰ্হৎ হলেন চিত্ত মুক্ত হলো, দারুণ দুঃখের অবসান ঘটলো।  তিনি সম্যক রূপে জ্ঞাত হলেন অবিদ্যাই দুঃখের মূল, নির্বাণই সুখের উৎস।


“নিব্বানং পরমং সুখং”

পটাচারা অহৎ হয়ে এ প্রীতি গাথা ভাষণ করলেন

“সন্ধ্যা কালে পাদ প্রক্ষালন সময়ে নিম্ন গামী

জল গতি নিরীক্ষণ করে আমার চিত্তকে আমি

শান্ত করলাম, আজানীয় অশু শান্ত হওয়ার মত।

দীপ হস্তে বিহারে প্রবেশ করে শয্যা অবলো

কনের পর মঞ্চোপরি উপবেশন করলাম।  

তৈল দীপ নির্বাপিত হওয়ায় ন্যায়

আমার চিত্ত ক্লেশও নির্বাপিত হলো,

এটা করুণা ঘন সম্বুদ্ধের মহাকরুণা।

 

পরিশিষ্ট

অহৎ পটাচারা ষড়বিধ অভিজ্ঞনে হলেন শক্তি শালিনী।  দিব্য চক্ষু, দিব্যকর্ণ, দিব্য ঋদ্ধি, পরচিত্ত বিজানন জ্ঞান, জাতি স্মর জ্ঞান ও আসক্ষয় জ্ঞান লাভ হলো তাঁর।  তখন তিনি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে। পেলেন সুদূর অতীতে তাঁর এক জন্মের অবিস্মরণীয় এক ইতিবৃত্ত।

 

তখন জগতে আবির্ভূত হয়ে ছিলেন ভগবান পদুমাত্তর বুদ্ধ।  সে সময়ে হংসবতী নগরে সম্রান্ত বংশের এক ধনাট্যের কন্যা ছিলেন।  পরম শ্রদ্ধাবতী ও ত্রিরত্নের শরণাপন্না উপাসিকা।  এক ধর্ম সভায় তিনি শাস্তার ধর্ম কথা শুনে খুবই প্রীত হলেন। সে সভায় দেখলেন ভগবান। এক ভিক্ষুণীকে গৌরবময় উপাধিতে বিভূষিত করলেন।  বিনয় ধারিণী ভিক্ষুণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন এ ভিক্ষুণী।  তাই ভগবান তাঁকে বিনয় ধারিণী ভিক্ষুণীদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্যা’ এ অভিধা মন্ডিত করলেন।

 

উক্ত উপাসিকা তা দেখে বড়ো আগ্রহী হয়ে উঠলেন।  জাগলো তাঁর স্পৃহাঃ তিনিও যেন হতে পারেন একদিন এরূপ গৌরবময় উপাধিতে বিভূষিতা।  সশিষ্য বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করলেন নিজ গৃহে। যথা সময়ে বুদ্ধ শিষ্যগণ সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন উপাসিকার গৃহে! আহার কৃত্যের অবসানে ভগবানকে বন্দনা করে উপাসিকা বলেন “প্রভু, গতকল্য এক ভিক্ষুণীকে ‘বিনয় ধারিণী ভিক্ষুণীদের অগ্র’ এ উপাধিতে বিমন্ডিত করলেন।  আমিও উপাধি মন্ডিত হতে চাই ভবিষ্যতে যে কোন একজন সম্যক সম্বুদ্ধের নিকট, এই আমার একান্ত প্রার্থনা।

 

সর্বজ্ঞ বুদ্ধ দিব্যদৃষ্টি প্রসারিত করে দেখতে পেলেন উপাসিকার প্রার্থনা সাফল্য মন্ডিত হবে। তখন সুগত প্রকাশ করে বললেন “উপাসিকে, তোমার প্রার্থনা ফলবতী হবে।  আমার পর অনুক্রমে জগতে আবির্ভূত হবেন সুমেধ, সুজাত, পিয়দস্সী, অথদস্সী, ধম্মদস্সী, সিদ্ধাথ, তিস্স, ফুস্স, বিপস্সী, সিখী, বেসস, ককুসন্ধ, কোণাগমন, ও কসপ, এ চৌদ্দজন সম্যক সম্বুদ্ধ অতীত হলে তার পর আসবেন গৌতম বুদ্ধ।  তার শাসনে হবে তুমি পটাচারা নামী ভিক্ষুণী। তুমিই হবে গৌতম বুদ্ধ প্রদত্ত উপাধি ভূষিত “বিনয় ধারিণী ভিক্ষুণীদের মধ্যে অগ্র শ্রেষ্ঠ।

 

এখন পটাচারার প্রার্থনা হয়েছে সিদ্ধ।  পদুমোত্তর বুদ্ধের বাণী ও আশীর্বাদ হয়েছে সার্থকে পরিণত।  অহৎ ভিক্ষুণী পটাচারা বিনয়।  পিটকে অসাধারণ জ্ঞানার্জন করলেন।  বিনয়ের সূক্ষ্ম বিচারে ভিক্ষুণীদের।  মধ্যে তিনিই ছিলেন সুদক্ষ।  বিনয় শীলের প্রতি গৌরব, পালনে দৃঢ়তা, ধারণে অসাধারণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণে গভীর জ্ঞান ইত্যাদি সবগুণে ছিলেন তিনি গরীয়সী।  তাই ভগবান গৌতম বুদ্ধ মহাপরিষদকে তাঁকে বিভূষিত করলেন এ অভিধায় “বিনয় ধারিণী ভিক্ষুণীদের মধ্যে পটাচারাই সর্বাগ্রগণ্যা।  পটাচারা জীবনী সমাপ্ত। 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url