ব্যভিচারের কর্ম ফল

 ব্যভিচার করা কর্ম ফল

ব্যভিচার বা মিথ্যা কামাচার (অবৈধ যৌন সংসর্গ) বলিতে, দুই জন ব্যক্তি কর্তৃক সম্প্রযুক্ত হইয়া মৈথুন সেবন করাকে বুঝায়।  মৈথুনের বস্তুতে মিথ্যাচার বা নিন্দিত আচার চুঝায়।  ইহা লক্ষণানুসারে কায় দ্বারে প্রবর্তিত অগমনীয় (অগম্য) স্থানে মৈথুন সেবনের চেতনা।  মাতৃরক্ষিতা, জ্ঞাতি রক্ষিতা, গোত্র রক্ষিতা, ধর্মরক্ষিতা, সারক্ষা ও সপরিদণ্ডা এই দশজন এবং ধনক্রীতা, ছন্দবাসিনী, ভোগবাসিনী, পট্টবাসিনী, উদক পাত্রকিনী, অদ্ভুদ চুম্বটা দাসী ভার্যা, কর্ম কারিণী ভার্যা, দ্বজাহুতা ভার্যা ও মুহূর্তিকা ভার্যা এই দন জন সহ মোট বিশ জন স্ত্রী পুরুষের অগমনীয় স্থান অর্থাৎ এই বিশ জন স্ত্রীর সহিত মৈথুন সেবন করিলে মিথ্যা কামাচার অরাধে অপরাধী হইতে হয়।


আরো দেখুন: চুরি করা কর্ম ফল


আরো দেখুন: মিথ্যা বলার কর্ম ফল



ব্যভিচারের কর্ম ফল

ব্যভিচারের কর্ম ফল

এখানে মৃতরক্ষিতা বলিতে যাহারা পিতার মরণের পর মাতার ভরণ পোষণের দ্বারা প্রতি পালিত হয় এবং ‘ইহা করা, ইহা করিও না’ বলিয়া পর পুরুষ সংস্রব হইতে রক্ষা করে, তাহাদিগকে মাতৃরক্ষিতা বলে। পিতৃরক্ষিতাদির ক্ষেত্রেও এই প্রকারে জ্ঞাতব্য। সারক্ষা, সস্বামিকা ভূমিষ্ঠ হইবার পূর্ব পর্যন্ত যদি প্রতিজ্ঞা করে যে, ‘যদি আমার পুত্র স্থান হয়, তাহা হইলে তোমার কন্যা অন্যত্র বিবাহ দিতে পারিবো না, আমার পুত্রকে দিতে হইবে। ’ এই প্রকারে যাহারা রক্ষিতা হয় তাহারাও সস্বামিকা।  যেইব্যক্তি অমুক স্ত্রীর নিকট যাইবে, তাহার এত পরিমাণ দণ্ড দিতে হইবে, এই প্রকারে নির্ধারণ করিয়া রক্ষা করিলে সেই স্ত্রী সপরিদণ্ডা।  

 

নিজের ইচ্ছানুযাযী স্বামী বরণ করিলে তাহাকে ছন্দবাসিনী বলে।  সম্পত্তি ভোগের জন্য স্ত্রী রূপে বাস করিলে পট্টবাসিনী জল পূর্ণ মঙ্গলঘট স্পর্শ করিয়া স্ত্রী রূপে গ্রহণ করিলে তাহাকে উদক পাত্রকিনী বলে।  মাথার মুকুট নামাইয়া স্ত্রীত্বে বরণ করা হইলে তাকে অদ্ভুত চুম্বটা স্ত্রী বলে।  ধ্বজাহৃতা বলিলে অন্য দেশ হইতে বল পূর্বক লণ্ঠন করিয়া আনিয়া স্ত্রী রূপে গৃহী তাকে বুঝায়। মুহূর্তিকা অর্থাৎ অল্প কালের জন্য গৃহীতা স্ত্রী। ইহাদের মধ্যে মাতৃরক্ষিতা, পিতৃরক্ষিতা, মাতাপিতা উভয়ের রক্ষিতা, ভ্রাতা রক্ষিতা, ভগ্নি রক্ষিতা, জ্ঞাতি রক্ষিতা, গোত্র রক্ষিতা, ধর্মরক্ষিতা এই আট জন স্ত্রী লোক ধর্মত নিয়মে স্বামী গ্রহণ করিতে পারে, যেহেতু তাহারা এখনো স্বামী হীনা। কারণ মাতা পিতাদি তাহাদের স্পর্শ সুখের কর্তা নহে।  অথচ মাতা পিতারা কন্যার স্পর্শ সুখ অনুভব করিবার জন্যও লালন পালন করে না। 

 

কেবল তাহাদের অনাচার করিতে নিষেধ করে এবং পর পুরুষের সংসর্গ হইতে রক্ষা করে মাত্র।  উক্ত আটজন স্ত্রীলোক পর পুরুষের সহিত মৈথুন সেবন করিলে কাম মিথ্যাচার অপরাধে অপরাধিনী হইয়া থাকে।  তেমনই অবশিষ্ট সারক্ষা ও সপরিদণ্ডা এই দুইজন এবং ধন ক্রীতাদি দশজন এই বারোজন স্ত্রীও পর পুরুষের সহিত সংসর্গ করিলে কাম মিথ্যাচার অপরাধে  অপরাধিনী হইয়া থাকে।  যেহেতু তাহারা সস্বামিকা, যে কোনো একজন কর্তা তাহাদিগকে রক্ষা করিতেছি।  কাজেই যেই স্ত্রীগণ স্বামী স্পর্শ সুখরূপ সম্পত্তি চুরি করিয়া পর পুরুষের অভিরতি উৎপাদন করে তাহাদের মিথ্যা চারজনিত দোষ হইয়া থাকে।  আর পুরুষেরা এই বিশজন স্ত্রীর মধ্যে যে কোনো স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সংসর্গ করিলে কাম মিথ্যাচার দোষে অভি যুক্ত হইতে হয়।  কারণ, স্ত্রীলোকের মাতাপিতারা পর পুরুষের সঙ্গে যেই রূপে সংস্রব না হয়, সেই ভাবেই রক্ষা করিয়া থাকে। 

 

কাজেই পরের রক্ষিত স্পর্শ সুখ চুরি করে বলিয়া তাহারা একান্তই মিথ্যাচার দোষে হইয়া থাকে।সেই কাম মিথ্যাচার শীলাদি গুণ বিরহিতার সঙ্গে আচরণ করিলে অল্প দোষ, আর শীলাদি গুণবতীর সঙ্গে হইলে মহা দোষ ‍যুক্ত হইয়া থাকে।  স্বামী স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে মৈথুন সেবনে অল্প দোষ অপায়ে জন্ম গ্রহণ করাইতে পারে না; কাম মিথ্যাচার হয় না, শীলও ভঙ্গ হয় না।  তবে অমাবস্যা, পূর্ণিমা, অষ্টমী ও চতুর্দশীতে এবং রজঃস্বলা ঋতুমতী অবস্থায় সহবাস নিষিদ্ধ।  গর্ভাবস্থায় এবং পীড়িত সময়েও অবৈধ। ব্যভিচার বা পরদার লঙ্ঘনের কুফল ব্যভিচারী পাপী নরনারীগণ মৃত্যুর পর দুর্গতি নরকে উপন্ন হইয়া থাকে।  বিশ কল্প কাল পর্যন্ত নরকাগ্নিতে পক্ব হইয়া মহা দুঃখ ভোগ করে।  নরক হইতে মুক্ত হইলে প্রেত কুলে জন্ম গ্রহণ করে।  প্রেত লোক হইতে চ্যুত হইয়া আবার পাঁচশত বার নারী জন্ম হয়, পাঁচশত বার নপুংসক জন্ম হয়।  নপুংসক বলিতে  যাহারা নারীও নহে, পুরুষও নহে, ক্লীব বা হিজড়া কিংবা পুরুষত্বহীন ব্যক্তিকে বুঝায়। 

 

ইহাদের কাম তৃষ্ণা অত্যধিক।  কিন্তু অতীতের পাপের ফলে কাহারও সহিত কাম ভোগ করা সম্ভব পর হয় না, যেহেতু তাহারা স্ত্রীও নহে, পুরুষ নহে।  তজ্জন্য ইহ জীবেন কাম সেবন করা কিংবা স্বামী স্ত্রী হইয়া একত্রে বসবাস করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব পর হইয়া ওঠে না।  শুধু মিথ্যা কাম রাগে জর্জরিত হয় এবং সর্বদা কামানলে জ্বলিতে থাকে। আজীবন এই ভাবে দিন যাপন করিতে হয়।  পরদার লঙ্ঘনের ফলে এই রূপে বিপাক দুঃখ ভোগ করিতে হয়।  বর্তমানে আমরা লক্ষ করিয়া থাকি, কোনো পরিবারে স্বামী-স্ত্রী আজীবন মতো বিচ্ছেদ হইয়া যায়।ইহাও ব্যভিচার জনিত পাপের ফলে হইয়া থাকে।  তাহাছাড়া ব্যভিচারের কারণে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা আজীবন থাকে না।  আর স্বামী স্ত্রী সংসার করিলেও পুত্র সন্তান লাভ হয় না (অপুত্রক হয়)।  অনেক পরিবারে দেখা যায়, স্বামী স্ত্রীর সংসার জীবনে কোনো সন্তান নাই, আজীবন নিঃসন্তান হইয়া জীবন যাপন করিতে হয়।  ইহাও পরদার লঙ্ঘনের ফল। 

 

পরদার লঙ্ঘনের ফলে নারীরা বন্ধ্যা হয় (যে নারীর পুত্র সন্তান হয় না, তাহাকে বন্ধ্যা নারী বলে), সপত্নী বা সতিন লাভ করিতে হয় (এক স্বামীর দুই বা ততোধিক স্ত্রী)।  সপত্নী লাভ হইলে নারীদের মহা দুঃখের কারণ হয়।  কারণ সপত্নীর প্রতি ঈর্ষান্বিত হইয়া তাহারা আজীবন অমানুষিক মনো বেদনায় কাল যাপন করে। ইহা অতীতেরর পরদার লঙ্ঘনের ফল।  জন্মে জন্মে তাহাদের দেহ কৃশ, অস্থি চর্ম সার ও প্রেত তুল্য কুদর্শনীয় হয় এবং ঘৃণিত চিকিৎসার অযোগ্য কুষ্ঠ, শ্বেত কুষ্ঠ, গণ্ড, কাশ, হাঁপানি ও অপস্মার ইত্যাদি কর্মজ ও পাপজ রোগে পীড়িত হইত হয়।  কুষ্ঠরোগ  অনুভূতি হীন দাগ কুষ্ঠ রোগের প্রধান লক্ষণ।  মানুষের শরীরের কোনো স্থান কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হইলে সেই স্থানটিসাদা হইয়া যায়।  সেখানে পচন ধরিয়া আস্তে আস্তে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।  কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হইয়া হস্ত পদের আঙ্গুল ছিন্ন হইয়াছে এমন অনেক ব্যক্তি আমরা দেখিয়া থাকি। 

 

বুদ্ধ বলিয়াছেন, “ব্রভিচার জনিক পাপের ফলে মানুষের এই প্রকার কুষ্ঠ রোগ হইয়া থাকে। ” শ্বেতকুষ্ঠ  এই রোগ হইলে দেহের চর্ম শ্বেত বর্ণ হইয়া দেহকে বিশ্রী করিয়া ফেলে, পরে সমস্ত শরীরে তাহা বিস্তাবর করিয়া পশ্চিমা দেশের সাদা মানুষের ন্যায় দেখায়।  এই ধরনের রোগী আমরা নানা স্থানে দেখিয়া থাকি, এই রোগের চিকিৎসা নাই বলিলেও চলে। ইহা এক প্রকার চর্ম রোগ ইহাও অতীতের ব্যভিচারর পাপে উৎপন্ন হইয়া থাকে।  গণ্ড ইহা আব, ফোড়া, স্ফোটক, মাংস স্ফীতি বা ফোলা রোগ বিশেষ। অতীতের ব্যভিচার জনিত পাপের ফলে এই জাতীয় রোগ উৎপন্ন হইয়া থাকে।  কোনো লোকের শরীরে এক প্রকার চর্ম রোগ হইয়া থাকে, যাহাকে আমরা দাদ কলিয়া থাকি। এই রোগের চিকিৎসা না করিলে সর্ব শরীরে বিস্তার করিয়া থাকে; রোগাক্রান্ত স্থানটি চুলকায়, আজীবন ভুগিতে হয়। ইহাও অতীতের ব্যভিচার করিবার পাপের ফল।  কদমা নামে আরও এক প্রকার চর্ম রোগ আছে।

 

এই রোগ হইলেও আক্রান্ত স্থানটি চুলকায়। ইহাও পরদার লঙ্ঘনের পাপের বিপাক। কোনো কোনো লোকের মুখে ব্রণাদি হইয়া মুখ মণ্ডল কুশ্রী (কুদর্শনীয়) হয় এবং সেই ব্রণাদি আজীবন থাকে। ইহাও পূর্ব জন্মের ব্যভিচার জনিত পাপের ফল। পরদার লঙ্ঘনে জন্মে জন্মে মানুষ হইলেও এই ভাবে নানা প্রকার চর্ম রোগে আক্রান্ত হইয়া লজ্জাকর দুঃখ ভোগ করিতে হয়।  এই প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তের নিকট থেকে শ্রবণ করা একটি বাস্তব কাহিনির অব তারণা করিতেছি। উল্লেখ্য যে, অনেক বৎসর আগে শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে দীঘিনালা হইতে তিনটিলায় চলিয় আসেন। কিন্তু সেই খানে কুটির নির্মাণাধীন থাকায় ঝামেলা এড়াতে শদ্ধেয় ভন্তে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থানার অন্তর্গত দুরছড়ি নামক গ্রামে চলিয়া যান এবং সেখানে মাস খানেক সময় অবস্থান করেন।  তখন কোনো এক দিন শ্রদ্ধেয় ভন্তে কিছু সংখ্যক দায়ক দায়িকা দের উদ্দেশ করিয়া ধর্ম দেশনা করিতে ছিলেন।

 

তাহাদের মধ্যে এক বিবাহিতা মহিলা ঘোমটায় মাথা ঢাকিয়া মুখ আচ্ছাদন করিয়া ধর্ম দেশনা শ্রবণ করিতে ছিল।  তাহাকে দেখিয়া শ্রদ্ধেয় ভন্তে বলিলেন, “হে উপাসিকা, তোমার ঘোমটা সরাইয়া ফেলো, নতুবা আমি ধর্ম দেশনা করিব না।  এই ভাবে ধর্ম দেশনা করা আমাদের বিনয় বিরুদ্ধ। ” ভন্তের সেই নির্দেশ শুনিয়া মহিলাটি তৎক্ষণাৎ কাঁদিয়া ফেলিল এবং বলিল, “ভন্তে, আমি কী পাপ করিয়াছি! কেন আমার এই অবস্থা? আমি কখন মুক্ত হইতে পারিব?” এই ভাবে দুঃখ বেগে কাদিতে ঘোমটা সরাইয়া নিল।  তখনই দেখা গেলো, তাহার মুখ মণ্ডল কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত; তাহা কুৎসিত ও বিশ্রী হইয়া মুখের চেহারা একদম অন্য ধরনের হইয়াছে।  এই রূপ বিশ্রী মুখ মণ্ডল সে কাহাকেও দেখাইতে চাহিতেছে না।  এখন ভন্তের আদেশে তাহার মুখ মণ্ডল প্রকাশ পাওয়াতে সে সংকোচ ও লজ্জা বোধ করিতেছে।

 

এর পর ভন্তে মেয়েটির মুখ দেখিয়া বলিলেন, “আহা, তুমি অতীত জীবনে পাপ করিয়াছ, তাই তোমার এই রোগ ভোগ করিতে হইতেছে।  এই রোগ তোমার লজ্জার কারণ হইয়াছে, যাহার কারণে তুমি কাপড় ঢাকিয়া রোগাক্রান্ত বিশ্রী মুখটি লুকাইয়া রাখিয়াছ।  এই রোগই তোমাকে দুঃখ দিতেছে, লজ্জা দিতেছে, যাহার কারণে তুমি এখন কাঁদিতেছ।  আহা, পাপ কর্মের ফল কী যে দুঃখ দায়ক তাহা চিন্তা করিয়া দেখ। ” অতঃপর মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, “ভন্তে, আমি কী পাপ করিয়াছি যাহার জন্য আমার এই অবস্থা!” তখন শ্রদ্ধেয় ভন্তে বলিলেন, “তুমি অতীত জন্মে পর পুরুষের সহিত কাম সম্ভোগ (ব্যভিচার) করিয়াছ।  তখন তুমি ব্যভিচার বা অবৈধ মৈথুন সেবন কে ভালো, সুখের ও আনন্দ ময় মনে করিয়া ছিলে।  তুমি যে এই রূপ কষ্ট পাইবে তাহা বিন্দু মাত্র ও চিন্তা কর নাই, কল্পনাও কর নাই। ” আসলেই, আপত দৃষ্টিতে কিংবা জ্ঞান না থাকিলে পাপ কাজ করাকে আরাম দায়ক ও মধুর বলিয়া মনে হয়, কিন্তু পাপ যখন বিপাক দিতে শুরু করে তখন আর দুঃখের অন্ত থাকে না।

 

পাপ চারী তখন দুঃখ ও লজ্জায় জর্জরিত অবস্থা হইতে মুক্তি প্রত্যাশা করে।  অথচ কর্ম বিপাক চিরাচরিত নিয়মে তাহার পিছু ধাওয়া করে, ফলে শিগ্গির তাহা হিইতে মুক্তি মেলে না।  সেই কথোপ কথনের এক পর্যায়ে মহিলা পুনরায় ভন্তেকে জিজ্ঞাসা করিল, “ভন্তে, আমি কখন এই রোগ থেকে মুক্ত হইতে পারিব?” তখন ভন্তে বলিলেন, “অতীতের সেই অকুশল বিপাকটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই রোগ কষ্ট দিবে, ভালো হইবে না। ” এখানে উল্লেখ্য যে, ঐ নারীটি প্রথমে বিবাহতা ছিল।  পরে রোগে আক্রান্ত হওয়াতে স্বামী কর্তৃক সে পরিত্যক্ত হইয়াছিল এবং পিতা মাতার নিকট আশ্রয় নিতে গেলে তাহারাও তাহাকে আশ্রয় না দিয়া আলাদা এক গৃহে অবস্থান করিতে বলিয়াছিল।  কেননা লোকে তখন মনে করিত, কুষ্ঠ এক প্রকার ছোঁয়াচে রোগ।  যাহার কারণে সেই সময়ে মানুষ কুষ্ঠ রোগকে ভীষণ ভয় করিত।  আর তখন চিকিৎসা সেবাও ছিল অপ্রতুল।

 

অধিকন্তু কুষ্ঠ রোগকে কেন্দ্র করিয়া অনেক অজ্ঞতা ও কুসংস্কার প্রচলি ছিল।  বুদ্ধ বলিয়াছেন ব্যভিচার বা পরদার লঙ্ঘনের ফলে নরকে দুঃখ ভোগ করিতে হয়।  ইহা ছাড়াও পরদার লঙ্ঘনের ফলে নারী জন্ম হয়, নপুংসক জন্ম হয়, স্বামী স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ হয়, সতিন লাভ হয় এবং পশু পক্ষী রূপে জন্ম ধারণ করিয়া অণ্ডকোষচ্ছেদন সহ নানা প্রকার পদাঘাত, দণ্ড ঘাত, প্রহার ও অকাল মৃত্যু দুঃখ ভোগ করিতে বাধ্য হয়।  এই প্রসঙ্গে বুদ্ধের সমকালীন ইসিদাসীর পূর্ব জন্মের কাহিনি বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য।  ঐ কাহিনিটি নিম্নে বর্ণনা করা হইল: দিবা দ্বি প্রহর।  নির্জন মনোরম স্থান।  সম্মুখে তরতর বাহিনী শৈল সুতা গঙ্গা।  বসন্তের মৃদুমন্দ পবন হিল্লোল, কুসুম সম্ভারে সুশোভিত, নিবিড় ছায়া সেবিত বিটপীমূল, বিবেক পূর্ণ পরিবেশ। গঙ্গা সৈকতে সুখা সীনা দুই জন ভিক্ষুণী।  

 

উভয়েই যুবতী, যৌবন সুষমায় সুরভিতা।  উভয়েই জ্যোতির্ময়ী।  সমুজ্জ্বল আনন, প্রসন্ন দৃষ্টি, সংযত বাক্য, সুসংযত কায় ও মন, ভাব গম্ভীর মুখ মণ্ডল।  তাঁহাদের দেখিলে শ্রদ্ধায় অন্তর আপ্লুত হয়, মস্তক নত হইয়া পড়ে।  ইহাদের এক জন ইসিবাসী, অপর জন বোধি।  তাঁহাদের মধ্যে খুব ভাব, পরস্পর পরস্পরের প্রতি মৈত্রীময় অন্তর।  তাঁহারা উভয়ে পাটলী পুত্র নগরে এক সঙ্গে অন্ন ভিক্ষায় নিরত হইয়া ছিলেন।  নদী সৈকতে উপবেশন করিয়া ভোজন কৃত সম্পন্ন করিলেন, পান করিলেন গঙ্গার স্বচ্ছ সুশীতল পরিস্রুত জল।  তৎপর নিবিড় ছায়া সম্পন্ন পাদ পমূলে বিশ্রাম মানসে সমাসীন হইলেন।  ভিক্ষুণী বোধি ইসিদাসীকে দেখিলেন অন্য দৃষ্টিতে, সমুৎসুক মনে।  বলিলেন স্মিত হাস্যে ইসিদাসী, তুমি এখন পূর্ণ যুবতী।

 

তোমার কান্তিময় দেহে উচ্ছল হইয়া পড়িতেছে যৌবন লালিত্য।  অভি রূপ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, কেমন সুন্দর মনো মোহন লক্ষণ বতী তুমি! আমি জানিতে চাই, যুবতীর স্পৃহণীয় মনিরময় বিলাস ব্যসনে কেন তুমি বীত শ্রদ্ধ হইয়াছে? কেন হইয়াছ কামিনী কাম্য সুখ ভোগের প্রতি বীত রাগ? সংসারের কোন অবিচারে নিপীড়িত হইয়া বিরাগিনী বেশে গৃহত্যাগ করিয়াছ? কেন তুমি প্রব্রজ্যার আশ্রয় নিয়াছ? প্রত্যুত্তরে ইসিদাসী বলিলেন  তরেব শোন বোদি, আমার সেই করুণ কাহিনি।  উজ্জয়িনী নগরে আমার পিত্রালয়।  পিতা আমার মহা ধন শালী।  তিনি সজ্জল ও ধর্ম পরায়ণ। 

 

তাই তিনি ‘ধার্মিক শ্রেষ্ঠী’ নামে সুপরিচিত।  আমি মাতা পিতার এক মাত্র কন্যা।  তাই আমি ছিলাম তাঁহাদের অতি প্রিয় ও আনন্দ দায়িনী।  আমার পরিণত বয়সে সাকেত নগর হইতে আমার বিবাহের প্রস্থাব আসিয়া ছিল।  বর বংশ মর্যাদা সম্পন্ন ধন বান শ্রেষ্ঠর পুত্র।  সমজাতি ও সম অস্থা দর্শনে পিতা সম্মত হইলেন।  আমি ধন বান শ্রেষ্ঠীর পুত্র বধু হইলাম।  স্বভাবতই আমি ছিলাম ভদ্র বিনীত।  শ্বশুর কুলের গৌবর রক্ষার প্র্রতি ও রীতি নীতি প্রতি পালনের প্রতি খুব যত্ন বান ছিলাম।  প্রাতঃকালে ও সন্ধ্যায় শ্বশুর শাশুড়িকে প্রণাম করিয়া তাঁহাদের পদ ধূলি মূলে মস্তকে ধারণ করিতাম। 

 

স্বামীর ভগ্নী, ভ্রাতা ও পরিজন বর্গের মধ্যে কাহাকেও দেখিলে শশব্যস্ত হইয়া আসন প্রদান করিতাম।  অন্ন পানীয়, খাদ্যভোজ্য ইত্যাদি সমভাগে পরিবেশন করিয়া তাঁহাদের সুখী করিতাম।সকলের পূর্বেই শয্যা ত্যাগ করিয়া সম্মর্জন ও প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনের পর কৃতাঞ্জলি হইয়া স্বামীর নিকট গমন করিতাম এবং চিরুন, দর্পণ, মুখ বিলেপন, অঞ্জন ইত্যাদি প্রসাধনী লইয়া সুবিনীতা পরিচারিকার মতোস্বীয় হস্তে স্বামীকে বিভূষিত করিতাম স্বহস্তে রন্ধন কার্য সম্পন্ন করিয়া পাত্রদি ধৌত করিতাম, মাতার এক মাত্র পুত্রের ন্যায় মমতা ময়ী অন্তরে স্বামীর সেবা যত্ন করিতাম।  স্বামী ভক্তি পরায়ণা ও স্বামী গত প্রাণা হইয়া সর্ব ক্ষণ স্বামীর সন্তোষ বিধানে তৎপর থাকিতাম, তবুও স্বামী আমার প্রতি বিমুখ হইলেন। 

 

আমার ন্যায় অনু পমা সেবিকা, নিরভিমানা, প্রত্যুষে সর্বাগ্রে শয্যা ত্যাগ শীল, পতি গত প্রাণা, অনলসা, ধর্ম শীলা, হিতৈষিণী পত্নী তাহার অসহ্য হইল।  এক দিন স্বামী জনক জননীকে বলিলেন, আমি গৃহত্যাগী হইব।আপনারা আমায় অনুমতি দিন, আমি সংসার ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইব। মাতা পিতা ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন পুত্র, গ্রহত্যাগ করিবে কেন?” তিনি বলিলেন “ইসিদাসী আমার অসহ্য হইয়াছে। ” মাতা পিতা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “পুত্র, এমন কথা বলিও না।  ইসিদাসী বিদূষী, বুদ্ধি মতী, অতি প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ শীলা, নিলসা।  তাহার প্রতি কেন বিরক্ত হইলে? সে কি কোনো অনিষ্ট করিয়াছে? তিনি স্থির কণ্ঠে বলিলেন, “সে অনিষ্ট না করিলেও আমার পক্ষে অসহ্য হইয়াছে। 

 

সে গুণবতী হইলেও তাহার সঙ্গে বাস করিতে পারিব না। ” তাঁহার মাতা পিতা উদ্বিগ্ন ইহয়া বলিলেন, “পুত্র, এমন বলিও না।  সে নির্দোষ হইলে তোমার অসহ্য হইবার কারণ কী? তোমার কি মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়াছে? এই রূপ গুণ শীলা মেয়ে পাওয়া দুষ্কর! এমন নির্দোষ লক্ষ্মী স্বরূপা বধু মাতাকে আমার ত্যাগ করিতে পারিবে না। ” স্বামী রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “তাহাকে তো ত্যাগ করিতে বলিতেছি না; বলিতেছি, আমিই গৃহ ত্যাগী হইব।  ইহাকে লইয়া আপনরা সুখে থাকুন। ” শাশুড়ি বিমর্ষ হইয়া আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি কোনো অপরাধ করিয়াছ? নিঃসংকোচে সত্য বলো। ”

 

আমি বাষ্পা কুল কণ্ঠে বলি লাম, “মা, আমি কোনো অপরাধ করি নাই, কোনো অনিষ্টও করি নাই, কোনো দিন কোনো কটু কথাও বলি নাই, তিনি কেন বিরূপ হইয়াছেন তাহও জানি না দাসী মতো সেবা করিয়াছি, পরিচর্যা করিয়াছি।  তাঁহার সন্তোষ বিধানের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছি, প্রাণাদিক ভালো বাসিয়াছি।  তবুও যদি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, আমার দুর্ভাগ্যই বলিতে হইবে। ” শ্বশুর শাশুড়ি মর্মান্তিক দুঃখে অভি ভূত হইয়া পড়িলেন, সেই সঙ্গে শ্বশুর কুলের সবাই।  তখন আমি দুঃখে ক্ষোভে অপমানে রোদন করিতে লাগি লাম।  পুত্র গৃহ ত্যাগী হইবেন মনে করিয়া তাঁহার ভীত হইয়া পড়িলেন আমার জন্য কি তাঁহার পুত্র হারাই বেন? শ্বশুর সজল নয়নে আমায় বলিলেন, “বৌমা, আমাদের কপাল মন্দ, ছেলের মতি গতি কেন এই রূপ হইল কিছুই বুঝি লাম না! কী করিব, তোমায় বিদায় দেওয়ার ইচ্ছা আমার মোটেও নাই, তবুও বিদায় দিতে হইতেছে! তুমি প্রস্তুত হও, আমি গিয়া পৌছাইয়া দিব। ”

 

শ্বশুরের আদেশ পাইয়া আমি প্রস্তুত হইলাম।  শাশুড়ি আমাকে সর্বালংকারে বিভূষিত করিবার ইচ্ছা করিলেন।  কিন্তু আমি রাজি হইলাম না।  বলি লাম, “ইহা আমার সুখের যাওয়া নয় মা। ” শাশুড়ির পায়ের উপর মস্তক রাখিয়া প্রণাম করিলাম।  শাশুড়ি আমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বহু ক্রন্দন করিলেন।  তার পর শ্বশুলালয়ের সকলের নিকট বিদায় লইয়া শ্বশুরের সঙ্গে পিত্রালয় অভি মুখে রওনা হইলাম।  পিতৃ ভবনে উপনীত হইলে শ্বশুর পিতাকে সকল কথা বলিলেন।  আর বলিলেন, “আজ হইতে আমরা লক্ষী হীনা হইলাম।” শ্বশুর সজল নেত্রে বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন।  বলা বাহুল্য, অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি আমার পিতাকে আমার সমস্ত লংকার ও বহু অর্থ দিয়া গেলন।

 

পিতা খুবই মর্মবেদনা অনুভব করিলেন।  কিন্তু তাহা বহিঃ প্রকাশ হইল না, অন্তঃ সলিরা ফল্লুর মতো।  তিনি আমাকে বহু উপদেশ ও আশ্বাস বাণী শোনাইলেন।  তবুও কিন্তু আমার অন্তরে সকল সময় একটা প্রশ্ন জাগিয়া উঠিত, ‘কেন এই রূপ হইল? নির্দোষ সেবা পরায়ণ হইয়াও স্বামীর অসহ্য ও অবজ্ঞার পাত্রী হইলাম কেন? এই প্রশ্নের সমাধান তখন আমি করিতে পারি নাই।  অবিদ্যার ঘনান্ধকারে তাহা আবৃত ছিল। আমার পিতা পুনরায় আমাকে পাত্রস্থ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।  তাঁহার প্রয়াস সফল হইল।  আমার ভূত পূর্ব শ্বশুরের প্রদত্ত অর্থের অর্ধ পরিমাণ ব্যয় করিয়া দ্বিতীয় বার এক ধনবানের পুত্রের সহিত আমার বিবাহ দিলেন।  মাত্র এক মাস সেখানে অবস্থান করিবার পর সেখান হইতেও বহিষ্কৃত হইলাম।  অথচ আমি ছিলাম নির্দোষ ও শীলবতী। 

 

ক্রীতদাসীর মতো স্বামী সেবায় নিরত ছিলাম।  তবুও এই রূপ মন্দ ভাগ্য আমার! অভাগা যেই দিকে যায় সাগরও নাকি শুকাইয়া যায়! আমিও যেই দিকে যাই সেই দিকেও বোধ হয় শুকাইয়া যায়।  যেই ডাল ধরি সেই ডাইল ভাঙ্গিয়া যায়।  এই রূপ দুর্ভোগ যে কোন দারুণ পাপের ফল, তখন তাহাতে অজ্ঞাত ছিলাম।  আমার ভাগ্য হত জীবন দুঃসহ হইয়া উঠিল।  এমন সময় দ্বারে দ্বারে ভিক্ষায় রত এক সন্ন্যাসীকে দেখিয়া পিতা তাঁহাকে বলিলেন, “তোমার চীবর ও ভিক্ষা পাত্র ত্যাগ করিয়া আমার গৃহে অবস্থান কর এবং আমার জামাত হও। ” বাবার কথায় সন্ন্যাসী সম্মত হইলেন।  তৃতীয় বার আমার বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হইল। 

 

পবিত্র সন্ন্যাস ধর্ম ত্যাগ করিয়া তিনি আমায় পত্নী রূপে বরণ করিয়া লইলেন।  আমি সুখী ও ‍কৃতার্থ হইলাম এবং নতুন স্বামীর চিত্ত বিনোদনের জন্য যত্ন পর হইলাম।  দেখ বোধি, সংসার কেমন বৈচিত্র্যময়! কামিনীর কামনা চরিতার্থের জন্য সন্ন্যাসীকেও স্বামী রূপে পাইতে ইচ্ছা করে, পাইলে সুখী হয়, কৃতার্থ হয়।  আমি ছিলাম এমন দুরাশয়া নারী, এমন দুর দৃষ্ট আমার! মাত্র এক পক্ষ কাল আমার অজ্ঞাত নিগূঢ় কর্মের তাড়নায় ইনিও বিরূপ হইলেন, আমার সংসর্গ তাঁহার অসহ্য হইল।  তিনি বিতৃষ্ণ মনে পিতাকে বলিলেন, শ্রেষ্ঠী প্রবর, আমার ছিন্ন বস্ত্র ও ভিক্ষা পাত্র ফিরাইয়া দিন, আমার ভিক্ষা বৃত্তিই শ্রেয়। 

 

হঠাৎ তাঁহার এই কথা শুনিয়া মাতা পিতা বিমর্ষ হইলেন।  মাতা ও জ্ঞতি বর্গ আমাদের ধন সম্পদ ও সুখ ভোগের কথা বলিয়া তাঁহাকে প্রলোভিত করিবার প্রয়াস করিলেন।  কিন্তু তিনি সব কিছুতেই উপেক্ষা ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করিলেন।  অগত্যা মাতা তাঁহাকে বলিলেন, “এই সুরম্য প্রসাদ এবং আমাদের যাহা সম্পদ সমস্তই তোমার, তুমিই হইবে ইহার সর্বে সর্বা, যে হেতু আমাদের এক মাত্র সন্তান ইসিদাসী।  তাই বলিতেছি, তুমি এই খানে অবস্থান কর।” তিনি রিক্তির স্বরে বলিলেন, “আমি সম্পদ চাই না, অট্টালিকা চাই না, আমি চাই বৃক্ষ মূল, চাই নির্জন পর্ণ কুটির।” মাতা অধীর হইয়া বলিলেন, “এই খানে অবস্থান তোমার অপ্রিয় হইতেছে কেন? আমরা কী করিলে, “আমি একাকী অবস্থানেই তৃপ্ত। 

 

ইসিদাসীর সংসর্গে আমি থাকিতে চাই না।  আমার সেই ছিন্ন বস্ত্র ও ভিক্ষা পাত্রটি ফিরিয়ে দিন, আমি চলিয়া যাই।” মা বলিলেন, “ইসিদাসী কোনো অপরাধ করিয়াছে কি?” “সে কোনো অপরাধ করে নাই বটে, কিন্তু আমারমন বলিতেছে ত্যাগই শান্তি।” আমি পায়ে পড়িয়া কাতর অনুরোধ করিলাম, কত রোদন করিলাম, বলি লাম কেঁদে কেঁদে, “আমি আপনার চরণ সেবিকা, দাসী: আমার ত্যাগ করিয়া যাই বেন না।  আপনার বিরহ ব্যথা আমার অসহ্য হইবে, বক্ষ বিদীর্ণ হইবে, আপনি যাই বেন না।” তবুও তিনি চলিয়া গেলেন, আমার কোনো কথা শুনিলেন না।  আমার প্রতি দৃকপাতও করিলেন না, তাঁর ছিন্ন বস্ত্র ও ভিক্ষা পাত্র নিয়া চলিয়া গেলেন।  তখন চিন্তা করিলাম, “আমিবড় মন্দ ভাগিনী।

 

আমার জন্য মাতা পিতা ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে ম্রিয়মান।  জ্ঞাতি বর্গও কত মর্ম পীড়া ভোগ করিতেছেন! আমার এই উপেক্ষিত লাঞ্ছিত ঘৃণ্য জীবনের কী প্রয়োজন? আমি আত্ম ঘাতিনী হইব, উদ্বন্ধনে (আত্মা হত্যা উদ্দেশ্যে গলায় দড়ি) প্রাণ ত্যাগ করি।” আবার চিন্তা করিলাম, “আত্ম হত্যা মহা পাপ, ইহা শাস্ত্রোক্ত কথা।” একাকিনী নিরালায় বসিয়া এই সব চিন্ত করিতেছি।এমন সময় আর্যা জিন দত্তা ভিক্ষুণী, যিনি বিশুদ্ধ শীল গুণ সম্পন্না, বহুশ্রুতা, তৃষ্ণা হীনা, অর্হৎ (অরহন্তী), তাঁহার শুভা গমন হইল আমাদের গৃহে। তাঁহাকে দেখিয়া আমি প্রসন্ন হইলাম এবংআসন হইতে উঠিয়া তাঁহাকে সম্মান প্রদর্শন করিলাম।  সত্বর সযত্নে আসনে বসিবার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম। 

 

তিনি উপবেশন করিলে বন্দনা করিবার পর অন্ন পানাদি খাদ্য দ্রব্য পরিবেশন করিয়া তাঁহাকে পরি তৃপ্ত করিলাম।  আর্যা জিনদত্তাকে দেখিয়া আমর অভি শপ্ত জীবনকে উৎকর্ষে পর্যবসিত করিবার শ্রেষ্ঠ, ঋজু, উত্তম ও সুন্দর পথের ইঙ্গিত পাইলাম।  তখন সরাসরি চিত্তে উদয় হইল, ‘ভগবান বুদ্ধের পবিত্র শাসনে আমি প্রব্রজ্যার আশ্রয় নিব।  তাহাই কল্যাণকর ও দুঃখ মুক্তির শ্রেষ্ঠতম উপায়।’ অন্ধকারে যেন দীপ্ত আলোকের সন্ধান পাইলাম।  আমার অন্তরে যে কী রূপ প্রীতির সঞ্চার হইয়াছিল তাহা অবর্ণনীয়।  তখন আমার মনো দুঃখ ও গ্লানি সবই মুছিয়া গেল।  জিন দত্তাকে বলিলাম, “আর্যে, আমি বুদ্ধ শাসনে আত্মোৎসর্গ করিতে চাই।  আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।” ভিক্ষুণী জিনদত্ত আমাকে উৎসাহিত করিলেন এবং বলিলেন, “ইসিদাসী, তাহা অতি উত্তম।  ইহাই দুঃখ মুক্তির শ্রেষ্ঠতম অয়ন। ”

 

পিতা এই কথা শুনিয়া আমাকে বলিলেন, “কন্যা প্রব্রজ্যা ধর্ম শ্রেষ্ঠ ও পরিত্র বটে, কিন্তু বড় কঠিন, বড় দুষ্কর।  তুমি সুকোমল, এই রূপ কষ্ট তোমার সহ্য হইবে না।  তুমি গৃহে থাকিয়া ধর্মা চরণ কর, যথেচ্ছা দান কর, শীল পালন কর। ” পিতা কথা শুনিয়া অসন্তুষ্ট হইলাম।  মনে মনে ভাবিলাম, ‘ইনি কি আমার ‍মুক্তি পথের অন্তরায় হইবেন?’ তখন আমি শঙ্কিত ও মনো দুঃখে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া বলিলাম, “বাবা, বাধা দিবেন না, আমার মুক্তি পথের সহায় হউন।  স্বকৃত পাপের ক্ষালন করিতে হইবে, আমায় যাইতে দিন।  সত্যধর্মের আশ্রয় নিয়া নির্জনে সাধনায় ব্রতী হইব।  অন্য থায় মৃত্যু আলিঙ্গন করিয়া এই অভিশপ্ত জীবনের অবসান ঘটাইব। ” আমার দৃঢ় সংকল্প দেখিয়া পিতা ক্ষান্ত হইলেন। 

 

সংবিগ্ন অন্তরে তিনি বলিলেন, “প্রাণাধিক কন্যা, যাও, প্রজ্ঞার অধিকারী হও।  শ্রেষ্ঠতম ধর্মেআত্ম নিয়োগ করিয়া শান্তিময় নির্বাণ সাক্ষাৎ কর।  মহা মানব বুদ্ধ সেই পরম পদ সম্প্রপ্ত হইয়াছেন।” সে দিনই মাতা পিতা ও জ্ঞাতিদের নিকট থেকে বিদায় নিয়া আর্যা জিনদত্তার অনুকম্পায় বুদ্ধ শাসনে প্রব্রজ্যা ধর্ম দীক্ষা লাভ করিলাম।  অতঃপর জন্ম নিরোধক আধ্যাত্নিক গভীর সাধনায় নিজেকে নিয়োজি করিলাম।  চতুরার্যসত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সাধনার মাধ্যমে অনিত্য দুঃখ অনাত্মের নিগূং তত্ত্ব সম্যক উপলব্ধি করিয়া সপ্তাহের মধ্যেই জাতিষ্মর জ্ঞান, চ্যুতি উৎপত্তি জ্ঞান ও তৃষ্ণাক্ষয় এই ঘরিষ্ঠ গুণযুক্ত ত্রিবিদ্যাসহ অর্হত্ত্বে পতিষ্ঠিত হইয়া পরমা শান্তির উৎস অমৃত নির্ঝর নির্বাণ সাক্ষাৎ করিলাম।

  

 

জাগতিক অত্যন্তিক দুঃখের আকর জন্ম মৃত্যু রুদ্ধ ইহয়া গেল।  তখন অনুপাম প্রীতিরসে আমার সর্ব শরীর স্নাত হইল।  আমি ইহলাম শান্ত, বিমুক্ত।  ইহার পর আমার জন্মন্তরের নিগূঢ় রহস্যের দ্বার উদ্‌ঘাট করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।  আমার অভি শপ্ত অবজ্ঞাত জীবনে উৎস কোথায়, কোন অপকর্মের প্রভাবে এত দুঃখ, এত মর্ম পীড়ায় জর্জরিত হইলাম, তাহা উপধারণে মনোযোগী হইলাম! পর পর অতীত সপ্ত জন্মের ইতিবৃত্ত আমার দিব্যদৃষ্টির গোচীভূত হইল।  প্রীতি ভাজন বোধি, সেই অসহ্য দুঃখময় করুণ কাহিনী প্রকাশ করিতেছি, মনোযাগ দিয়া শোন।

 

১।  অতীত এক জন্মে এরকচ্ছ নামক নগরে আমি প্রসিদ্ধ এক ধন শালী সুবর্ণকর (স্বর্ণকার) ছিলাম।  যৌবন মদে মত্ত হইয়া ধন বিতরণে বশী ভূত করিয়া পরস্ত্রীতে রত হইয়া ছিলাম।  এই ব্যভিচার পাপে নিজেকে সানন্দে আহুতি দিয়া ছিলাম বা ফল কখনো চিন্তা করি নাই।

 

২।  সেই জন্মের অবসানে নরকে উৎপন্ন হইয়া ভীষণ দুঃখ ভোগ করিয়া ছিলাম।  উঃ, সেই কী দুঃসহ দুঃখ! পরদার লঙ্ঘনের এমন দারুণ বিষময় ফল সুদীর্ঘকাল ভোগ করিয়া ছিলাম।

 

৩।  সুদীর্ঘকাল পরে এই মহা দুঃখের অবাসন হইলে নরক হইতে মুক্ত হইয়া কর্মের তাড়নায় মহাবনে বানরীর গর্ভে জন্ম নিয়া ছিলাম।  জন্মের সপ্তম দিবসে নিষ্ঠুর বানর যূথ পতি তীক্ষ্ন দন্তের দংশন আমার অগুচ্ছেদ করিয়া ছিল।  আহা, সেকী দুঃখ! অসহ্য যন্ত্রণায় সংজ্ঞাহারা হইয়া ছিলাম।  আমার কাতর চিৎকারে মাতা শোকা কুলা হইয়া ছিল।  নির্দোষ রিরীহ শিশু, তবুও অগুচ্ছেদ হইল।  পরদার লঙ্ঘনের এমনই দারুণ দগু!

 

৪।  বানর জন্মের অবসানে মৃত্যুর পর সিন্ধু প্রদেশে এক অরণ্যে কানা ও খঞ্জ এক ছাগীর গর্ভে জন্ম নিয়া ছিলাম।  মালিক আমার শৈশবেই মুষ্কচ্ছেদ করিয়া দিয়াছিল।  উহাতে কৃমিদষ্ট হইয়া দ্বদশ বর্ষ অসহ্য ব্যথা যন্ত্রণায় জীবন অতি বাহিত করিলাম।  উঃ, সেই কী যন্ত্রণা! কম্পিত দেহে মা মা বলিয়া কতই না রোদন করিয়া ছিলাম।  পরদার লঙ্ঘনের কী দারুণ দণ্ড! অতঃপর সারা জীবন আমার প্রষ্ঠোপরি প্রভু পুত্রদের বহন করিতে হইয়া ছিল।  সহ্য করিতে হইয়া ছিল কত বেত্রাঘাত পদাঘাত! ইহার পর মাংস লোলু পদের রসনা তৃপ্তির জন্য ঘটিল আমার অকাল মৃত্যু। আমাকে শিরশ্ছেদ করা হইল।  আহা! পরদার লঙ্ঘনের ফল কী দারুণ দুঃখ।

 

৫।  এই অপঘাত মৃত্যু তেই দুঃখ পূর্ণ ছাগ জন্ম হইতে মুক্ত ইহলাম বটে, কিন্তু কর্ম নিবন্ধনে আবার পশু কুলে গো ব্যবসায়ীর গাভির গর্ভে জন্ম হয়েছিলাম।  আমার দেহ ছিল সুন্দর লাক্ষারক্তবর্ণ।  আমার বসয় যখন মাত্র দ্বাদশ মাস তখনই কর্মের তীব্র তাড়নায় এখানেও আমার অগুচ্ছেদ হইয়াছিল।  ক্রমে বলীবর্দে পরিণত হইলাম।  দেহ হইল সুন্দর, হুষ্টপুষ্টও বলিষ্ঠ।  মালিকের প্রিয় হইলাম বটে, কিন্তু আমায় নিযুক্ত করিল রাঙ্গল ও শকট বহনে।  যত দিন দেহে শক্তি ছিল ততদিন এই দুঃখের মধ্য দিয়াই অতি বাহিত হইল।  যখন দুর্বল হইয়া পড়িলাম তখন অন্ধ হইয়া ম্রিয় মান হইয়া পড়িলাম।  ততোধিক দুঃখ হইল মক্ষিকা, মশক ও দংশকের দংশনে।  তীব্র শীতে, প্রখর গ্রীষ্মে ও মুষল ধারা বৃষ্টিতে কত যে দুঃখ পাইয়াছি তাহা অবর্ণনীয়! পরদার লঙ্ঘনের এমন দুঃখ পূর্ণ বিপাক ভোগ করিয়া ছিলাম। 

 

৬।  গো জন্মের অবসানে মানব কুলে গৃহহীনা ক্রীত দাসীর গর্ভে জন্ম নিয়াছিলাম।  ক্রীত দাসীর সন্তান, তদুপরি হইয়া ছিলাম নপুংসক।  আহা, নারীও নয়, পুরুষ নয়! কুকর্মের কী অলঙ্ঘ্য বিধান, অসহ্য রিপুর তাড়না! উঃ, সেই কী অসহ্য দুঃখ! ত্রিংশতি বৎসর ব্যাপী অহোরাত্র উগ্রতেজোময় কামাগ্নিতে দগ্ধ হইয়া দুঃখসহ যন্ত্রণায় অতৃপ্ত কামনা নিয়া অকালে মৃত্যু আলিঙ্গন করিয়া ছিলাম।  পরদার লঙ্ঘনের কী দারুণ দণ্ড!

 

৭।  নপুংসক দেহের অবসানে জন্ম নিয়াছিলাম নিরতিশয় দুরিদ্র বহু ঋণ গ্রস্ত জনৈক শকট চালকের কন্যা রূপে। ঋণ পরিশোধের জন্য পিতা এক বণিক হইতে অর্থ গ্রহণ করিয়া তদবিনিময়ে আমায় প্রদান করিলেন।  আমি রোদন ও বিলাপ করিতে করিতে পিতৃ গৃহ হইতে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হইলাম।  আমার যৌবন কালে বণিকের পুত্র গিরিদাস আমাকে স্ত্রীরূপে বরণ করিলেন।  তাঁহার অপর এক পত্মী ছিল।  সে ছিল পতিগত প্রাণা, শীলবতী ও যশোবতী।  সপত্নী ঈর্ষায় আমার অন্তর দিন রাত্রি দগ্ধ হইয়াছিল।  আজীবন মানসিক যাতনায় দিন যাপন করিয়া ছিলাম।

 

৮।  ইহার পর হইল আমার এই বর্তমান জন্ম।  ইহজন্মে দাসীর ন্যায় যাহাদের সেবা করিয়াছি, তাহাদের আমি অসহ্য হইয়াছি।  আমাকে ঘৃণাও উপেক্ষা করিয়াছে।  ইহার কারণ আমি ইতঃপূর্বে অজ্ঞাত ছিলাম। ইহা যে পরদার লজ্ঞানের প্রতিফল তাহা এখন সম্যকরূপে জ্ঞাত হইয়াছি।  এই ক্ষণে আমি সেই কর্মের বিপাক অতিক্রম করিয়াছি।  তৎসঙ্গে জাগতিক সকল দুঃখেরও নিরসন করিয়াছি।  এখন আমি বিমুক্ত।” ভিক্ষুণী বোধি প্রফুল্ল বদনে বলিলেন, “নির্বাণ প্রত্যক্ষ কারিণী ইসিদাসী, তোমায় অভিনন্দন জানাচ্ছি।” পরদার লঙ্ঘন করিয়া ইসিদাসীর জীবনে এইরূপে দুঃখময় বিপাক প্রতিফলিত হইয়াছিল। সুতরাং যাহারা পরদার লঙ্ঘন করিয়াছে, করিতেছে এবং করিবে তাহাদের বিপাকাবস্থা কীরূপ হইবে, তাহা চিন্তা করিয়া দেখা উচিত নয় কি?।

 

পুরুষেরা পরদার লঙ্ঘন করিয়া মরণের পর বহু শত সহস্র বৎসর ব্যাপী বিঘোর নরক যন্ত্রণা ভোগ করত মনুষ্য কুলে আসিলেও শত জন্মা বধি স্ত্রী রূপে জন্ম গ্রহণ করিয়া থাকে।  শত সহস্র কল্প কাল পর্যন্ত পূরিত পারমী আর্য শ্রাবক আনন্দ স্থবিরও সংসার পরিভ্রমণের সময় একবার কর্মকার কুলে জন্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিলেন।  তথায় পরদার লজ্জন করিয়া নরকে গিয়াছিলেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপরি সীম নরক দুঃখ ভোগের পর সেই পাপ কর্মের পরিণামে চৌদ্দবার পর পুরুষের পদ পরিচারিকা স্ত্রী রূপে জন্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন।  সাত জন্ম অবধি মুষ্কোৎপাটন (অণ্ডকোষ ছেদন) জনিত দুঃখ ভোগ করিয়া ছিলেন।

 

অতীতকালে তিনি মগধ রাজ্যের রাজ গৃহ নগরে সুবর্ণকারের পুত্ররূপে জন্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন।তথায় পাপ মিত্রের সংসর্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হইয়া ছিলেন।  সেই জন্ম হইতে চ্যুত হইয়া অপর পুণ্য ফল ভোগার্থ কৌশমী বাসী অশীতি কোটি বিভব সম্পন্ন জনৈক ধনীর এক মাত্র প্রিয় পুত্র রূপে জন্ম গ্রহণ পূর্বক সুখে লালিত পালিত হইতে ছিলেন।  তখন  এক জন সৎ বন্ধুর সং স্রবে থাকিয়া বহু বিধ পুণ্য সঞ্চয় করিলেন। অনন্তর অতীত কালীয় পরদার লঙ্ঘন পাপের ফল ভোগের জন্য মরণান্তে মহারোরুব নামক বিষম নরকে পড়িলেন। অনেক কাল নরক যন্ত্রণা ভোগের পর অব্যাহতি পাইয়া ফেন কণ্ঠে নামক জন পদে ছাগল যোনিতে জন্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন।  অনন্তর সেই গৃহ স্বামীর অমাত্যের পত্র ‘এই রূপ করিলে ছাগলটি শক্তি মান এবং বড় হইবে’ মনে করিয়া তাহার মুষ্কোৎপাটন।  করিয়া নিজের বাহনের কার্যে নিযুক্ত করিয় ছিল।

 

ছাগল জন্মে আয়ুষ্কাল অতি বাহিত করিয়া বানর যোনি গ্রহণ করিয়া ছিলেন।  যেই দিবস তিনি বানর জন্ম গ্রহণ করিলেন সেই দিন তাঁহার স্বজাতিগণ তাহাদের দল পতিকে দেখাইতে লইয়া গেল।  দল পতি আনন্দে বিভোর হইয়া ‘আমার পুত্রকে এই দিকে নিয়া আস’ বলিয়া সাদরে গ্রহণ করিল।  সে শাবকের কিচির মিচির ক্রন্দন সত্ত্বেও কামড়াইয়া মুষ্কোৎপাটন করিয়া দিল।  তথায়ও ভীষণ দুঃখ ভোগ করিয়া মরণান্তে দসন্ন রাষ্ট্রে গো জাতিতে জন্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন। সেই বাড়ির কর্তা ‘এমন করিলে বৎসতরটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান হইব’ মনে করিয়া তাহার মুষ্কোৎপাটন করিল।  তথায়ও নিদারুণ দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করিলেন। 

 

গো জন্ম হইতে চ্যুত হইয়া বৃজি রাজ্যে এক ধন কুবের কুলে নপুংসক রূপে জন্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন।  নপুংসক জন্ম হইতে কাল প্রাপ্ত হইয়া শ্রেষ্ঠপু ত্র পূর্ব কৃত পুণ্যের প্রভাবে তাবতিংস স্বর্গে শক্র দেবরাজ ইন্দ্রের পদ সেবিকা হইয়া ছিলেন।  দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থবার পর্যন্ত শক্রের পরিচারিকা হইয়া পঞ্চম বারে সেই দেবলোকে জবন দেব পুত্রের অগ্র মহিষীর স্থান অধিকার করিয়া ছিলেন।  যষ্ঠ জন্মে দেবলোক হইতে চ্যুত হইয় বিদেহ রাজ্যের মিথিলা নগরে অঙ্গতি রাজার অতিশয় রূপ বতী রুজা নাম্নী ধীতা হহয়া জনিয়া ছিলেন।  রাজা ‘আমার এই একটি মাত্র কন্য’ বলিয়া সাদরে ‘রতি বর্ধন’ নামক প্রাসাদ নির্মাণ করাইয়া অনেক ধাত্রী সহ বাস করিতে দিলেন।


নানা প্রকার পুষ্প, মহা মূল্য বস্ত্র ও নানা বিধ খাদ্য সামগ্রী দান দেওয়া জন্য কন্যাকে দিলেন।  রাজা কেবল কন্যার জন্য প্রতি অর্ধ মাসে সহস্র মুদ্রা ব্যয় করিতেন।  কন্যা স্বীয় জাতিষ্মর জ্ঞানের দ্বারা পর দারিক কর্মের বিষময় ফলের কথা স্মরণ করিতে ছিলেন।  কাজই সেই দুঃখ পূর্ণ স্ত্রী জন্ম পরি বর্জন করিয়া পুরুষ হইবার জন্য প্রার্থনা পূর্বক পিতার প্রদত্ত দানীয় বস্তু দান করিতেন এবং শীল পালন করিতেন।  এই কুশল কর্মের প্রভবে তাবতিংস ভবনে মহা ঋদ্ধিমান দেব পুত্র হইয়া জন্মান্ত গ্রহণ করিলেন।  এই পর দারিক পাপ দণ্ড হইতে এই বার প্রযুক্ত হইলেন।  রাজ কন্যা জন্মে অপরকে উপদেশচ্ছলে নিম্নলিখিত গাথা দ্বয় বলিতেন যেই স্ত্রী লোক জন্মে জন্মে পুনঃপুন পুরুষ হইবার অভিলাষ করে, দেব পরিচারিকারা যেমন দেব রাজ ইন্দ্রের সেবা করে, তাহাকেও তেমনি ভাবে স্বামী সেবা করিতে হইবে।

 

যেই ব্যক্তি জন্মে জন্মে পুনঃপুন পুরুষ হইতে ইচ্ছে কর, ধৌত পায়ে যেমন কর্দমাক্ত ভূমিতে নামিতে ইচ্ছে হয় না, সেই রূপ তাহাকেও পরদার লঙ্ঘন কর্ম সর্বতো ভাবে বর্জন করিতে হইবে।  পরদার লঙ্ঘন পাপের ফলে জন্মে জন্মে শরীর বিবর্ণ, রিবরূপ, বিকলাঙ্গ ও দুনিরীক্ষা হয়।  প্রিয়জন, আত্মীয় স্বজনেরা।  এমনকি আপন প্রিয় মাতা পিতা গণ পর্যন্ত তাহাদের দেখিতে ইচ্ছে করে না, তাহারা সর্বদা শত্রু  বহুল হইয়া বাস করে।  পুরুষ পরস্ত্রী গমনে জন্মে জন্মে নারী হয়ে জন্ম হয়, পুরুষত্ব হানি হয়।  অপুত্রক হয়।  স্ত্রী পরদার গমনে ক্লীব ক্লিষ্টতা ও অপুত্রক হয়, জন্মে জন্মে নারী হইয়া জন্ম হয়, নারী জন্ম হইতে মুক্ত হয় না, ধন বিনাশ, মান বিনাশ জনিত দুঃখ ভোগ করে, দেব মনুষ্যের অপ্রিয় ও অরক্ষিতা হয়।  দুঃশীল দুরাচার, ব্যভি চারী, লম্পট, বৃষল বলিয়া তাহাদের লোকে নিন্দা ও ঘৃণা করে।  

 

তাহার উদ্বেগ ও বিনিদ্র চিত্তে রজনী যাপন করে, অন্তর দুর্বল ভীত ও রতি হয় সামান্য, সভা সমিতিতে ও সৎপুরুষের সম্মুখে যাইতে সহাস পায় না।  কোনো পাপ অপরাধ না করিলেও মানুষের সামনে লজ্জিত হইতে হয়। পরদার লঙ্ঘনের পাপের বিপাক এই ভাবে দুঃখ প্রদান করিয়া থাকে। অতীত কালে পরদার লঙ্ঘন করিয়া লোকেরা কী রূপে পাপের ফল ভোগ করিয়া ছিল সেই সম্বন্ধে বুদ্ধের দেশিত আর একটি কাহিনী উল্লেখ করা হইতেছে শাস্তা জেতবনে অবস্থিতি কালে কোশল রাজকে উপলক্ষে করিয়া এই কথা বলিয়া ছিলেন।  প্রবাদ আছে কোশল রাজ একদা রাত্রি কালে নরক নিবাসী চারিটি প্রাণীর কণ্ঠ স্বর শুনিতে পাইয়া ছিলেন।  একজন ‘দু’  অক্ষর  উচ্চারণ করিতে ছিল, এক জন ‘ষা’ অক্ষর, এক জন না’ অক্ষর  এবং এক জন ‘সে’ অক্ষর।  এই প্রাণী চতুষ্টয় নাকি অতীত জন্মে শ্রাবন্তী নগরেই পরদার পরায়ণ রাজ পুত্র ছিল তাহারা অপরের রক্ষিত ও প্রতি পালিত রমণী গণের সহিত অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হইত এবং ইন্দ্রি সেবার জন্য বহু পাপ করিত।  

 

শেষে শ্রাবস্তীর নিকটেই মরণ চক্রে তাহাদের জীবন গ্রন্থি ছিন্ন হইয়া যায় এবং তাহারা চারটি লৌহ কুম্ভী নরকে পুনর্জন্ম লাভ করে।  এই  নরক চতুষ্টয়ে তাহারা ষাট হাজার বৎসর পচিতে ছিল, অগ্নিতে দগ্ধ বিদগ্ধ হইতেছিল।  ক্রমে তাহারা কুম্ভী গুলির তল দেশ হইতে উপরি ভাগে ওঠে এবং কুম্ভী মুখের কানা দেখিতে পায়।  তখন ‘অহে, কবে আমরা এই দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করিব’ বলিয়া চারি জনেই যথা ক্রমে মহা শব্দে বিলাপ করিতে থাকে। কোশল রাজ তাহাদের এই শব্দ শুনিয়া মরণ ভয়ে ভীত হইলেন এবং অরুণোদয় পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি বসিয়া বসিয়া কাটাইলেন।  অরুণোদয় কালে ব্রাহ্মণেরা আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজের কি সুন্দ্রিা হইয়াছে?” রাজা বলিলেন, “আচার্যগণ, আমার ভাগ্যে সুনিদ্রা হইবে কীরূপে? আমি আজ রাত্রে চারিটি অতি ভয়ংকর শব্দ শুনিয়াছি। ”

 

ইহা শুনিয়া ব্রাহ্মণেরা রাজার অপায় ভয় দূর করিবার জন্যই যেন কর (হাত) সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কর সঞ্চালন করিতেছেন কেন?” ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, “মহারাজ, শব্দ গুলি। অতি অনিষ্ট সূচক।” “ইহার কোনো প্রতিকার আছে, নাকি প্রতিকার নাই? “হউক না অপ্রতি বিধেয়, আমরা কিন্তু এই বিষয়ে সুশিক্ষিত।” “কী উপায়ে আপনারা প্রতি বিধান করিবেন?” “মহারাজ, আমরা ইহার মহা প্রতিকার করিতে সমর্থ; আমরা সর্ব চতুদ্ধ যজ্ঞ সম্পাদন করিয়া আপনার অমঙ্গল দূর করিব।” “তবে শীঘ্রই তাহার অনুষ্ঠান “মহারাজ, ইহাতে চারিটি হস্তী, চারিটি অশ্ব, চারিটি বৃষ, চারি জন মানুষ প্রভৃতি হইতে আরম্ভ করিয়া বর্তক ও অন্যান্য পক্ষী পর্যন্ত চারিটি করিয়া গ্রহণ করিতে হইবে। ”

 

“আচার্যগণ, তাহাই হউক, সর্ব চতুষ্ক যজ্ঞ সম্পাদন পূর্বক আমার জন্য স্বস্ত্যয়ন করুন।” ব্রাহ্মণেরা ‘যে আজ্ঞা, মহারাজ’ বলিয়া যজ্ঞের নিমিত্ত যাহা যাহা আবশ্যক, সমস্ত গ্রহণ করিলেন।  তাঁহারা যজ্ঞ স্থলী প্রস্তুত করিলেন; খুটা পুতিয়া তাহাতে বহু প্রাণী বান্ধিয়া রাখিলেন।  ‘বহু মৎস্য ও মাংস ভোজন করিব, বহু ধন লাভ করিব’ এই ভাবিয়া অতীব উৎসাহ যুক্ত হইলেন এবং ইহা চাই, উহা চাই বলি ইতস্তত ছুটা ছুটি করিতে লাগিলেন। রাণী মল্লিকা দেবী রাজার নিকট উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ, ব্রাহ্মণেরা আজ অতি স্ফূর্তির সহিত ছুটা ছুটি করিতেছেন কেন?” রাজা উত্তর দিলেন, “দেবী, তোমার সেই কথায় প্রয়োজন কী? তুমি নিজের ঐশ্বর্য গর্বে মত্ত হইয়া আছো, আমার যে কী দুঃখ, তাহা তো তুমি জান না।” “ব্যাপার খানা কী বলুন না!”

 

“দেবী, আমি এবং বিধ অশ্রোতব্য শব্দ শুনিয়াছি।  তাহার পর ব্রাহ্মণ দিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই রূপ শব্দ শুনিলে কী ফল হয়? ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, ইহাতে আমার রাজ্যের, ভাগের বা জীবনের অনিষ্ট সূচিত হইতেছে।  তাঁহারা সর্ব চতুষ্ক যজ্ঞ সম্পাদন দ্বারা স্বস্ত্যয়ন করিবার প্রস্তাব করিলেন; আমি ইহার অনুমোদন করিয়াছি।  তাঁহারা যজ্ঞ স্থলী প্রস্তুত করিয়াছেন এবং যজ্ঞার্থে যেই যেই সব উপরকণ আবশ্যক, তাহা লইবার জন্য যাতা য়াত করিতেছেন।” “এই শব্দের প্রকৃত তত্ত কী, তাহা জানি বার জন্য যিনি ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, যাঁহার সমকক্ষ ব্রাহ্মণ দেবলোকে ও ভূলোকে কোথাও নাই মহারাজ তাঁহাকে কিছু বলিয়াছেন কি?” “দেবলোকে ও ভূলোকে ব্রাহ্মণাগ্রগণ্য কে, দেবী?” “মহাগৌতম সম্যক সম্বুদ্ধ।” “দেবী, আমি তো সম্যক সমুদ্ধ কে জিজ্ঞাসা করি নাই।  

 

“তবে গিয়া জিজ্ঞাসা করুন।” মল্লিকার কথায় রাজা প্রাতরাশ গ্রহণান্তর উৎকৃষ্ট রথে আরোহণ পূর্বক জেতবনে গমন করিলেন এবং শান্তাকে প্রণি পাত পূর্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভদন্ত, আমি রাত্রি কালে চারিটি শব্দ শুনিয়া ব্রাহ্মণ দিগকে তাঁহার কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া ছিলাম।  তাঁহারা বলিলেন সর্ব চতুষ্ক যজ্ঞ দ্বারা স্বস্ত্যয়ন করিতে হইবে।  তাঁহারা এখন যজ্ঞের উদ্যোগ করিতেছেন।বলুন তো ভদন্ত, এই শব্দ শুনিয়াছি বলিয়া আমার ভাগ্যে কি অমঙ্গল ঘটিবে?” শাস্তা বলিলেন, “এই শব্দ আর কিছু নয় মহারাজ, নরক নিবাসী প্রাণীগণ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া এই রূপ আর্তনাদ করিয়াছিল।  আপনিই যে কেবল এখন এই শব্দ শুনিয়াছেন তাহা নহে; এই রূপ শব্দ প্রাচীন কালের রাজারাও শুনিয়া ছিলেন। তাঁহারাও ব্রাহ্মণ দিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া পশুঘাত যজ্ঞ সম্পাদন করিতে চাহিয়া ছিলেন, কিন্তু শেষে পণ্ডিত দিগের কথা শুনিয়া তাহা হইতে বিরত হইয়া ছিলেন। 

 

পণ্ডিতেরা তাঁহাদিগকে শব্দের প্রকৃত কারণ বলিয়া ছিলেন, বহু প্রাণীকে বন্ধন মুক্ত করাইয়া ছিলেন এবং স্বস্তি সম্পাদন করিয়া ছিলেন।” অনন্তর রাজার অনুরোধে শান্তা সেই অতীত কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন।  পুরাকালে বারাণসী রাজ ব্ৰহ্ম দত্তের সময়ে বোধিসত্ত্ব কাশী নয়, এক ব্রাহ্মণ কুলে জন্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন।  বয়ঃপ্রাপ্তির পর তিনি বিষয় বাসনা পরিহার পূর্বক ঋষি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং ধ্যান বল লাভ করিয়া ধ্যান সুখ ভোগ করিয়া হিম বন্ত প্রদেশে এক রমণীয় বন ভূমিতে বাস করিতে থাকেন।  ঐ সময় বারাণসী রাজ চারিজন নার কীর উক্ত রূপ চারিটি শব্দই শুনিতে পাইয়া মহা ভীত হইয়া ছিলেন।  ব্রাহ্মণেরাও তাঁহাকে এই রূপেই বলিয়া ছিলেন যে, চারিটি শব্দের একটি না একটি বিপদ ঘটিবেই ঘটিবে এবং সর্ব চতুষ্ক যজ্ঞ দ্বারাই তাঁহার উপশম করিতে হইবে। 

 

রাজা তাঁহাদের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়া ছিলেন এবং রাজ পুরোহিত ব্রাহ্মণ দিগকে লইয়া যজ্ঞ বাটি নির্মাণ করিয়া ছিলেন, যাহাতে বহু প্রাণী স্কুণায় (খুঁটিতে) নিবদ্ধ হইয় ছিল। সেই সময়ে বোধিসত্ত্ব মৈত্রী ভাবনা দ্বারা প্রণোদিত হইয়া দিব্য চক্ষুর সাহায্যে জগৎ পর্য বেক্ষণ করিতে ছিলেন।  তিনি বারাণসী রাজের এই কাণ্ড দেখিয়া ভাবিলেন, ‘আজ আমাকে যাইতে হইবে।  আমি গেলে অনেক প্রাণীর মঙ্গল ঘটিবে।’ অনন্তর তিনি ঋদ্ধি বলে আকাশে উত্থিত হইয়া বারাণসী রাজের উদ্যানে অবতরণ করিলেন এবং মঙ্গল শিলা পট্টে কাঞ্চন প্রতিমার ন্যায় উপবিষ্ট হইলেন।  ঠিক এই সময়েই পুরো হিতের প্রধান শিষ্য গুরুর নিকট গিয়া বলিলেন, “আচার্য! পরের প্রাণ নাশ দ্বারা স্বস্ত্যয়ন করিতে হইবে, আমাদের বেদে তো এই কথা নাই। ” পুরো হিত বলিলেন, “থাম বাপু, তোমার কাজ হইতেছে রাজার ধন লইয়া আসা।  দেখ না, আমরা কত মৎস্য, মাংস খাইতে পাইব! পাত করিল। 

 

বোধিসত্ত্ব তাহাকে মিষ্ট বচনে আপ্যায়িত করিলেন; সে একান্তে উপবেশন করিল। বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিলেন “মাণবক, তোমাদের রাজা যথা ধর্ম রাজ্য শাসন করেন তো?” “হ্যা প্রভু, রাজা ধর্মানু সারে রাজ্য শাসন করেন।  কিন্তু গত রাত্রিতে তিনি চারিটি মহা শব্দ শুনিয়া বাহ্মণ দিগকে তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন।  ব্রাহ্মণেরা বলিয়াছেন, সর্ব চতুদ্ধ যজ্ঞ দ্বারা আপনার জন্য স্বস্ত্যয়ন করিব।  সেই জন্য রাজা এখন পশু ঘাতন দ্বারা স্বস্তয়ন করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন, বহু প্রাণী স্থুণায় আবদ্ধ হইয়াছে।  তদন্ত, ঐ শব্দ ব্যাখ্যা করিয়া বহু প্রাণীকে যমের মুখ হইতে উদ্ধার করা কি ভাদৃশ শীল বান মহা পুরুষের কর্তব্য নহে?” “মাণবক, রাজা আমাকে জানেন না। আমিও রাজাকে জানি না, কিন্তু এই শব্দ গুলির কারণ জানি।  রাজা যদি এখানে আসিয়া জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে তাঁহার সন্দেহ নিরা করণ করিতে পারি।” “ভদন্ত, দয়া করিয়া এখানে।

 

মহূর্ত কাল অবস্থিতি করুন; আমি রাজাকে লইয়া আসিতেছি।” “বেশ, মাণিক; তুমি রাজাকে আনো।” শিষ্য গিয়া রাজাকে সমস্ত কথা জানাইল।ইহা শুনিয়া রাজা বোধি সত্ত্বের নিকট গেলেন এবং বোধি সত্ত্বকে প্রণাম করিয়া একান্তে উপবেশন করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি যে সকল শব্দ শুনিয়াছি, আপনি সেই গুলির প্রকৃত কারণ জানেন, এই কথা সত্য কি?” “আমি জানি মহা রাজ!” পাপে রত হইয়া ছিল।  তজ্জন্য তাহারা মৃত্যুর পর চারিটি লৌহ কুম্ভীতে পুন র্জন্ম প্রাপ্ত হয়।  সেখানে তাহারা অতি গাঢ় ও ক্ষার রস যুক্ত উত্তপ্ত জলে সিদ্ধ হইতে ছিল। 

 

কুম্ভী গুলির উপরি ভাগ হইতে তলদেশে যাইতে ত্রিশ হাজার বৎসর লাগিয়াছে।  আবার ত্রিশ হাজার বৎসরে তলদেশ হইতে উপরে উঠিয়াছে এবং কুম্ভী গুলির মুখ দেখিতে পাইয়াছে।  সেখান হইতে বাহিরে দৃষ্টি পাত পূর্বক চারি জনে চারিটি গাথায় স্ব স্ব দুঃখ জ্ঞাপন করিতে চাহিয়াছে, কিন্তু তাহা করিতে পারে নাই; কেবল স্ব স্ব গাথার প্রথম অক্ষরটি উচ্চারণ করিয়া পুনর্বার লৌহ কুম্ভীতে নিমগ্ন।  হইয়াছে তাহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ‘দু' এই অক্ষর উচ্চারণ করিয়া নিমগ্ন হইয়াছে, সে বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিল।

দুষ্কার্য অশেষ করি যাপিনু জীবন, হায়!

দান হেতু ছিল ধন, দান করি নাই তায়।

ভোগের বিবিধ বস্তু ছিল, সীমা নাই তার;

কিন্তু তাহে আত্ম তৃপ্তি না হইল অভা গার।

কিন্তু সেই পাপী গাথা শেষ করিতে পারে না। বোধিসত্ত্ব নিজের, জ্ঞান বলে এই গাথার পূরণ করিয়া ছিলেন।  অন্য শব্দ গুলির সম্বন্ধেও এই নিয়ম।  যে ব্যক্তি গাথা বলিতে গিয়া ‘ষা’ এই অক্ষর মাত্র উচ্চারণ করিয়া ছিল, তাহার গাথা এই

ষাট হাজার বর্ষ, এক দিন কম নয়,

দগ্ধ হইলাম আমি নিরয় মাঝারে, হায়!

কখন হইবে অন্ত বল এই যন্ত্রণার?

আর যে সহিতে নারি এ মহা দুঃখের ভার!

যে কেবল ‘না’ অক্ষরটি উচ্চারণ করিয়াছিল, তাহার গাথা এই

নাই অন্ত এ দুঃখের, অন্ত হবে কী প্রকারে?

ভাবিয়া কোথাও অন্ত নাহি পাই দেখি বারে।

করেছি তখন পাপ, কাণ্ডা কাণ্ড জ্ঞান হীন?

কাজেই দুঃখের অন্ত হবে নাকো কোনো দিন।

যে কেবল ‘সে’ অক্ষরটি উচ্চারণ করিয়া ছিল, তাহার গাথা এই

সেই আমি ত্যাজি যবে এ অতি ভীষণ স্থান।

নর জন্ম লভি পুনঃ নিশ্চয় পাইব ত্রাণ,

বদান্য শীলসম্পন্ন তখন হইব অতি;

নিয়ত কুশল কর্মে রহিবে আমার মতি।

বোধিসত্ত্ব এই রূপে একটি একটি করিয়া গাথা গুলি শুনাইলেন এবং বলিলেন, “মহারাজ, নরক বাসী প্রাণীরা এই সমস্ত গাথা বলিতে ইচ্ছা করিয়া ছিল; কিন্তু তাহাদের পাপের গুরুত্ববশত তাহা পারে নাই।  তাহারা স্ব স্ব কর্মের ফল অনুভব করিয়া আর্তনাদ করিতে ছিল।  এই শব্দ শ্রবণ হেতু আপনার কোনো অমঙ্গলের আশঙ্কা নাই; আপনার কোনো ভয় নাই।” বোধিসত্ত্ব এই রূপে রাজাকে আশ্বস্ত করিলেন।  রাজাও সুবর্ণ ভেরি বাজাইয়া সেই আবদ্ধ প্রাণী সমূহকে মুক্তি দেওয়া ইলেন এবং যজ্ঞ কুণ্ড ভগ্ন করাইলেন। বোধিসত্ত্বও বহু প্রাণীর কল্যাণ সাধন করিয়া সেখানে কযয়েক দিন যাপন করিলেন এবং স্বস্থানে প্রতিগমন পূর্বক ধ্যান বল লক্ষুণ্ণ।  রাখিয়া ব্ৰহ্মলোকে জন্ম লাভ করিলেন।  বুদ্ধের কথা শুনিয়া কোশল রাজ প্রসেনজিৎ অতি আনন্দিত হইলেন।  


ইহাতে তাহার মনের ভয় অন্তর্হিত হইয়া গেল।  ইহার পর আদেশ করিলেন আবদ্ধ সকল প্রাণী সমূহকে মুক্তি দিতে।  রাজার আদেশে প্রাণী সকল মুক্ত হইল।  বুদ্ধের এই উপদেশ শুনিয়া বহু লোকের উপকার হইল।  ব্যভিচারের চারি অঙ্গ  অগমনীয় বস্তু বা অলঙ্ঘ নীয় যোনিদ্বার (যে রমণী বা পুরুষের সহিত কামস ম্ভোগ করা নীতি বহির্ভূত বা ধর্ম বহির্ভূত), মৈথুন সেবনের চিত্ত, মার্গে মার্গে প্রতি পাদন (স্ত্রী যোনি মার্গ ও পুরুষাঙ্গের সংযোগ) এবং আস্বাদ বা সুখ অনুভব করা এই চারি অঙ্গ পরি পূর্ণ থাকিলে তবেই কাম মিথ্যাচার অপরাধে অপরাধী হইয়া থাকে।

 

ব্যভিচার না করিবার সুফল  যাহারা পরদার লঙ্ঘন করে না এবং অন্যের মা বোনের প্রতি অনাসক্ত হইয়া নিজের মা বোনের ন্যায় মনে।  করে, তাহারা জন্মে জন্মে পুরুষ হইয়া জন্ম গ্রহণ করে, নারী জন্ম হয় না, শত্রু বিহীন হয়, শত্রু তা জনিত দুঃখ ভোগ করে না। কেহ তাহাদের হিংসা, ঈর্ষা, নিন্দাদি দ্বারা কষ্ট দেয় না, সকলের প্রিয় ভাজন হয়। অন্ন পানীয়, বস্ত্র ও শয়নাসন লাভ করে; উৎকণ্ঠিত না হইয়া সুখে শয়ন করিয়া সুখে জাগ্রত হয়।  তাহারা নপুংসক (হিজড়া) হইয়া জন্ম গ্রহণ করে না।  প্রিয় জনদের সঙ্গে সম্পর্ক আজীবন অটুট থাকে; ভঙ্গ হয় না। 

 

 

স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা অটুট থাকে, তাহাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না, নারীরা বন্ধ্যা হয় না।  কুষ্ঠ, শ্বেত কুষ্ঠ, গণ্ড, কাশ, হাঁপানি, অপস্মার (মৃগীগো) প্রভৃতি।  রোগে আক্রান্ত হয়া না।  স্বামী স্ত্রী সংসার করিলে পুত্র সন্তান লাভ করে অর্থাৎ অপুত্রক হয় না, স্ত্রী জাতিরা সপত্নী (সতিন) লাভ করে না, অক্রোধী হয়, প্রত্যক্ষ কারিতা পরি পূর্ণ লক্ষণতা, শঙ্কা মুক্ত ও সুদর্শনীয় হয়, নির্ভীক ও নিঃসংকোচ চিত্তে সর্ব স্থানে গমন ও উপবেশন করে।  ব্যভিচারের কর্ম ফল সমাপ্ত।

Next Post Previous Post
1 Comments
  • Ripon
    Ripon 11 March 2022 at 03:44

    Sadhu aadhu

Add Comment
comment url