জেতবন

 জেতবন

দরিদ্রের বন্ধু পিতৃ মাতৃ হীনের প্রতি পালক অনাথপিণ্ডিক গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া যুব রাজ জেতের উদ্যান দেখিলেন।  ঐ উদ্যান হরিদ্বর্ণ কুঞ্জবন এবং স্বচ্ছ জলাশয় শোভিত।  অনাথপিণ্ডিক চিন্তা করিলেন, “বুদ্ধের সঙ্ঘের জন্য বিহার প্রতিষ্ঠার ইহাই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত স্থান। ”  তৎপরে তিনি রাজ পুত্রের নিকট গিয়া উদ্যানটি ক্রয় করিবার প্রার্থনা করিলেন।  রাজ কুমার উদ্যানটি বিক্রয় করিতে ইচ্ছুক ছিলেন না, তিনি উহা অতিশয় মূল্য বান বিবেচনা করিতেন।  প্রথমে বিক্রয় করিতে অস্বীকার করিয়া তিনি অবশেষে কহিলেন, “যদি তুমি উদ্যান স্বর্ণে আচ্ছাদিত করিতে পার, তাহা হইলে উহা পাইবে, অপর কোন মূল্য আমি গ্রহণ করিব না। ”

আরো দেখুন: রাহুলের সংক্ষিপ্ত জীবনী


জেতবন

 জেতবন

অনাথপিণ্ডিক সানন্দে স্বর্ণ বিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন; কিন্তু জেত কহিলেন, “আপনি আর কষ্ট করিবেন না, কারণ আমি বিক্রয় করিব না। ” কিন্তু অনাথপিণ্ডিক রাজ পুত্রকে অঙ্গীকার পালন করাইতে দৃঢ় সংকল্প।  এই রূপে তাহাদের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইলে উভয়ে বিচারকের নিকট গমন করিলেন।  ইত্যবসরে প্রজাবর্গ এই অসাধারণ বিরোধের বিষয়ে আন্দোলন আরম্ভ করিল।  রাজ কুমার সবিশেষ অবগত হইয়া যখন জানিলেন যে, অনাথপিণ্ডিক প্রভূত ধন শালী এবং সরল চিত্ত ও সাধু, তখন তিনি অনাথপিণ্ডিকের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিলেন।  বুদ্ধের নাম শ্রবণ করিয়া বিহার প্রতিষ্ঠায় স্বয়ং যোগ দিরার জন্য তিনি ব্যস্ত হইলেন। রাজ কুমার অর্ধেক স্বর্ণমাত্র গ্রহণ করিয়া কহিলেন, “ভূমি তোমার, কিন্তু বৃক্ষ সমূহ আমার। 

 

 

আমার নিজের অংশের বৃক্ষ গুলিকে আমি বুদ্ধের নিকট উৎসর্গ করিব। ” তদনন্তর অনাথপিণ্ডিক ভূমি ও জেত বৃক্ষ গ্রহণ করিলেন এবং উভয়ে ঐ সমুদয়।  শারিপুত্রের হস্তে রক্ষার ভার দিলেন।  ভিত্তি স্থাপিত হইলে, মন্দির নির্মাণ আরম্ভ হইল।  সুউচ্চ মন্দির বুদ্ধের নির্দেশানুসারে নির্মিত হইল; উহা যথোপযুক্ত অলঙ্কারে সুন্দর রূপে।  সজ্জিত হইল।  এই বিহারের নাম জেতবন হইল এবং অনাথপিণ্ডি বুদ্ধকে শ্রাবস্তিতে আসিয়া দান গ্রহণে আহবান করিলেন।  বুদ্ধ কপিলব ত্যাগ করিয়া শ্রাবন্তি আগমন করিলেন।  মহাপুরুষ যখন জেতবনে প্রবেশ করিলেন, তখন অনাথপিণ্ডিক পুষ্প নিক্ষেপ ও ধুপ ধুনাদি প্রজ্জ্বলিত করিলেন, এবং দানের চিহ্ন স্বরূপ স্বর্ণ কলস হইতে বারি সেক করিয়া কহিলেন, “সঘ ভুক্ত সর্ব জগতের ভ্রাতৃগণকে এই জেতবন বিহার আমি উৎসর্গ করিলাম। ”

 

বুদ্ধ দান গ্রহণ করিয়া কহিলেশ, “সর্ব প্রকার অমঙ্গল দূর হউক, এই দান হইতে পুণ্য রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হউক, ইহা মানব সাধারণের এবং বিশেষতঃ দাতার চিরন্তন মঙ্গল স্বরূপ হউক।” তৎপরে রাজা এসেনজিৎ বুদ্ধের আগমন বার্তা শ্রবণ করিয়া রাজকীয় যানারোহণে জেতবন বিহারে গমন পূর্বক যুক্ত করে বুকে অভিবাদনান্তে কহিলেন: “আমার অযোগ্য ও অজ্ঞাত রাজ্য ঈদৃশ সৌভাগ্যে আজ ধন্য হইল।  কারণ জগত পতি, ধর্ম রাজ, সত্য পতি বর্ত মানে এই রাজ্যের কোন অশুভ ঘটিতে পারে না।  “আপনার পবিত্র বদন দর্শন করিলাম, এই বার আপনার উপদেশের সঞ্জীবনী বারি পান করিব।  “পার্থিব সম্পদ ক্ষণ স্থায়ী ও ক্ষণবিধ্বংসী, ধর্ম সম্পদ অনন্ত ও অক্ষয়।  গৃহী নৃপতি হইয়াও ক্লিষ্ট, কিন্তু সদাচারী সাধারণ মানুষও মানসিক শান্তি সম্পন্ন। ”

 

নৃপতির লোভ ও ভোগাসক্ত হৃদয়ের ভাব অবগত হইয়া এবঃ উপযুক্ত অবসর বুঝিয়া বুদ্ধ কহিলেন: “যাহারা কুকর্মের দ্বারা হীন জন্ম প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহারাও ধর্মানুর মনুষ্য দেখিয়া তাহাকে সম্মান করে।  এক জন স্বাধীন নৃপতি, যিনি পূর্ব জন্মে বহু পুণ্য সঞ্চয় করিয়াছেন, তিনি বুদ্ধের সম্মুখীন হইলে, অবশ্যই অধিকতর সম্মান পরবশ হইবেন।  “এক্ষণে আমি সংক্ষেপে ধৰ্মার্থ প্রকাশ করিব। মহারাজ, আমার বাক্য মনো যোগ পূর্বক শ্রবণ ও পরীক্ষা করুন। “আমাদিগের কুকর্ম ও সুকর্ম অবিন্ত ভাবে ছায়ার ন্যায় আমাদের অনুসরণ করে।  “প্রেমাদ্ৰ হৃদয় সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়।  “পিতা এক মাত্র পুত্রকে যে চক্ষে দেখিয়া থাকে, আপনি প্রজা বৰ্গকেও সেই চক্ষে দেখিবেন।  

 

তাহাদিগকে উৎপীড়ন অথবা বিনাশ করিবেন না; দেহের প্রত্যেক অঙ্গকে সংযত রাখিবেন, ভ্রান্তমত পরি ত্যাগ করিবেন, সরল মার্গে বিচরণ করিবেন; অপরকে পদদলিত করিয়া নিজের গৌরব বৃদ্ধি করিবেন না।  ক্লিষ্টের স্বস্তি দায়ক ও মিত্ত হইবেন।  “জ্যৈশ্বর্যের উপর অযথা মনো নিবেশ করিবেন না, তোষামোদ কারীর মিষ্ট বাক্যে কর্ণপাত করিবেন না।  “আমাদিগের চতুর্দিকে জন্ম, বার্ধক্য, ব্যাধি ও মৃত্যুর শৈল প্রাচীর, সত্য ধর্মের আচরণ করিয়াই আমরা এই দুঃখের পর্বত উল্লম্বন করিতে পারি।  “অতএব অন্যায় আচরণে কি লাভ? “জ্ঞানী মাত্রেই দেহ জনিত ভোগ সুখকে ঘৃণা করেন।  তাহারা কামনায় বিতৃষ্ণ হইয়া আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রার্থী হন।

 

“বৃক্ষ যখন জলন্ত অগ্নিতে দগ্ধ হইতেছে, তখন পক্ষিগণ কি প্রকারে তথায় অবস্থান করিতে পারে? যেখানে বিপু সমূহের আতিশয্য, সেখানে সত্যের অবস্থিতি অসম্ভব।  যাঁহার এই জ্ঞান নাই, তিনি বিদ্বান এবং জ্ঞানী বলিয়া প্রশংসিত হইলেও অজ্ঞানী।  “যিনি এই জ্ঞান সম্পন্ন, যথার্থ প্রজ্ঞা তাহাতে প্রতি ভাত হয়।  এই জ্ঞানের প্রাপ্তি এক মাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।  এই জ্ঞানকে অবহেলা করিলে জীবন বৃথা।  “সর্ব সম্প্রদায়ের উপদেশ ইহাতেই কেন্দ্রী ভূত হইবে, কারণ ইহা ব্যতীত বিচার শক্তি অসম্ভব।  “এই সত্য কেবল মাত্র সন্ন্যাসীর জন্য নয়; ইহা ভিক্ষু ও গৃহী সমভাবে সকল মনুষ্যের জন্য।  সংঘ ভুক্ত ভিক্ষু এবং পরিজন বেষ্টিত গৃহীর মধ্যে কোন প্রভেদ নাই।  ভিক্ষু হইয়াও নিগামী হওয়া যেমন সম্ভব, সামান্য গৃহস্থের পক্ষেও সেই রূপ ঋষিত্ব প্রাপ্তি সম্ভব।

 

“কামনার স্রোত সকলের পক্ষে সমান বিপজ্জনক; ইহাতে সমস্ত জগৎ ভাসিয়া যায়।  ইহার আবর্তে যে পড়িবে, তাহার আর উদ্ধার নাই।  কিন্তু জ্ঞান ঐ আবর্তে তরণী স্বরূপ, বিচারণ ঐ তরণীর কর্ণ।  শত্রু  মারের আক্রমণ হইতে অত্মাকে রক্ষা করিবার জন্য ধর্ম মানুষকে আহ্বান করিতেছে।  “কর্ম ফল হইতে মুক্তি অসম্ভব, সুতরাং সুকর্মের আচরণই শ্রেয়।  “মন্দ হইতে দূরে থাকি বার জন্য চিন্তা সমুহকে সংযত করা আবশ্যক, কারণ যাহা রোপিত হয়, তাহাই সংগৃহীত হয়।  “আলোক হইতে অন্ধকারে এবং অন্ধকার হইতে আলোকে গমন সম্ভব। অন্ধকার হইতে অধিকতর অন্ধকারে এবং প্রত্যুষের আলোক হইতে দিবসের আলোকে প্রবেশ করাও সম্ভব।  

 

জ্ঞানী প্রাপ্ত আলোকের সাহায্যে অধিকতর আলোক লাভ করিবেন; তিনি অবিরত সত্যের নাভি মুখে অগ্রসর হইবেন।  “সাধু আচরণ ও বিচার শক্তির অনুশীলন দ্বারা যথার্থ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করুন; পার্থিব সম্পদের নিম্মলতা গভীর ভাবে চিন্তা করুন, জীবনের অনিশ্চয়তা অনুধাবন করুন।  “মনকে উন্নত করুন, দৃঢ় সংকল্পের সহিত সত্যের অনুগামী হউন; রাজোচিত আচরণ পালন করুন, বাহ বন্ধতে সুত্থান্বেষণ করিবেন না, নিজের মনে করিবেন।  এই রুপে যুগ যুগান্তরে আপনার নাম ব্যাপ্ত হইবে ও আপনি তথাগতের অনুগ্রহ লাভ করিবেন। ” নৃপতি ভক্তি সহকারে বুদ্ধের বাক্য শ্রবণ করিয়া উহা হৃদয়ে পোষণ করিলেন।  জেতবন সমাপ্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url