চুরি করা কর্ম ফল
চুরি করা কর্ম ফল
যাহা দেওয়া হয় নাই এমন বস্তুর আদান বা প্রহণকে অদিন্নাদানা বলে, তাহা পরস্বা পহরণ বা চুরির পর্যায় বিশেষ। পরের পরি গৃহীত বস্তুকে পর গৃহীত বলিয়া জানা আছে, তথাপি তাহা গ্রহণের যেই চেতনা তাহা পরস্বা পহরণ বা চৌর্য চেতনা। কম মূল্যের জিনিস চুরি করিলে অল্প দোষ, আর অধিক মূল্যের চুরি করিলে মহাদোষ। আবার মূল্য অনুসারে বস্তুর সাদৃশ্য থাকিলেও গুণ বান ব্যক্তির বস্তু চুরি করিলে পাপ গুরু তর হয়। বিশেষত বস্তুর স্বামীর গুণের তার তম্য অনুসারে চোরের পাপ বেশি বা কম হইয়া থাকে।
আরো দেখুন: ব্যভিচারের কর্ম ফল
আরো দেখুন: প্রাণীহত্যা কর্ম ফল
চুরি করা কর্ম ফল |
চুরি করি বার কুফল চুরি করি বার পাপের ফলে নরকে উৎপন্ন হইয়া বিশ কল্প কাল পর্যন্ত নরকা গ্নিতে দগ্ধ বিদগ্ধ হইতে হয়। দীর্ঘ কাল নরকে ভীষণ জ্বালা যন্ত্রণা ভোগ করি বার পর নাক হইতে মুক্ত হইয়া তির্যক যোনিতে জন্ম গ্রহণ করিতে হয়। অর্থাৎ গো, মহিষ, মৃগাদি পশু পক্ষী, কীট পতঙ্গ যোনিতে জন্ম হইয়া দুঃখ ভোগ করিতে হয়। তৎপর প্রেত যোনিতে জন্ম হইয়া অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়। প্রেত লোকে কল্প কাল দুঃখভোগ করি বার পর মনুষ্য লোকে জন্ম হইলেও অতি দরিদ্র কুলে জন্ম হয়। দীন হীন, বিরূপ ও বহু উপদ্রব বিশিষ্ট নীচ কুলে এমন কি অনাথ অথবা ভিখারি ইহয়া জীবন যাপন করিতে হয়।
যাচক হইয়া ‘আমাকে কিছু দাও, আমাকে কিছু দাও, বলিয়া যাচ্ঞা করিতে করিতে কিছুই লাভ না করিয়া শূন্য হাতে ফিরিয়া যাইতে হয়। এই ভাবে চণ্ডাল কুলে, নিষাদ কুলে, বেণু কুলে, চর্ম কার কুলে, ঝাড়ু দার কুলে, জেলে কুলে অর্থাৎ অন্ন পান ভোজনে অভাব ক্লিষ্ট, দরিদ্র ও নীচ কুলি জন্মিতে হয়, যে খানে অতিশয় দুঃখ কষ্টে গ্রাসাচ্ছা দন লাভ হয়। ইহার ফলে দুর্বর্ণ, দুর্দর্শ নীয়, কুৎসিত, বহু রোগ গ্রস্ত, দুর্বল অথবা পক্ষা ঘাত গ্রস্ত হইতে হয়। অল্পান্ন, পানী, বস্ত্র যান, মাল্য গন্ধ দ্রব্য, পেষণ, লেপন, শয্যাসন, আবাস ও তৈল বর্তিকা ইত্যাদি দ্রব্য সম্ভার লাভ করিতে পারে না। আর্থিক আয় উন্নতি করিলেও তাহা ঠিক ভাবে কাজে আসে না।
বিনা প্রয়োজনে অর্থ সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। অথি কষ্টে অর্জিত অর্থ এবং উৎপাদিতে সম্পত্তি অব্যবহৃত অবস্থায় বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অগ্নি, জল, রাজা, চোর এবং রোগের কারণে অর্থ সম্পদ বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অগ্নি আগুন সাধারণত আমাদের অনেক কাজে লাগে ও উপকার করে। অন্য দিকে আগুন আমাদের অনেক ক্ষতিও করিতে পারে। বহুধন সম্পত্তি বিনাশ করিতে পারে, এমন কি আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাইতে পারে।অনেক সময় দেখা যায়, কাহারও আড়িতে আগুন ধরিয়া সব কিছু পুড়িয়া নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে অথবা কোনো ঘন বসতি গ্রামে বা নগরে অগ্নি দগ্ধ হইয়া সমস্ত বস্তি গ্রাম নিঃশেষ হইয়াছে। বর্তমানেও আমরা লক্ষ করিয়া থাকি, কোনো কোনো হাট বাজারে আগুন ধরিয়া শত শত দোকান বাড়ি ঘর, কোটি কোটি টাকার মালা মাল এবং বহু সম্পত্তি পুড়িয়া যায়, বিনষ্ট হইয়া যায়।
এই
ভাবে আগুন মানুষকে নিঃস্ব করিতে পারে। প্রকৃত
পক্ষে আগুন সকলের বাড়ি ঘর দগ্ধ করে না। বুদ্ধ
বলিয়াছেন, “গৃহ অগ্নি দগ্ধ হইয়া সম্পত্তি ধ্বংস হইবার কারণ অতীতে চুরি করি বার পাপের
ফল। ” বলা যায়, অপরের সম্পত্তি চুরি করাতে নিজের সম্পত্তি অগ্নি দগ্ধ হয়। যদি আগুনে বিনাশ না হয় তাহা হইলে অন্য যে কোনো কারণেই
হউক নিজের সম্পত্তি বিনাশ হইয়া থাকে।
জল বন্যার কারণে বাড়ি গরের ক্ষতি হয়, সম্পত্তি নষ্ট
হয়, ফসলের ক্ষতি হয়, ঘূর্ণি ঝড়ের কারণে অথবা খরার কারণে ধান্য শস্য নষ্ট হয়। অনে সময় দেখা যায়, বহু অর্থ ব্যয় করিয়া পাঁচ একর
অথবা দশ একর ধান্য চাষ করা হইয়াছে, তখনই হঠাৎ জল প্লাবিত হইয়া (বন্যায়) সমস্ত পাকা
ধান নষ্ট হইয়া গিয়াছে। চুরি করি বার পাপের
ফলে এই রূপে সম্পদ বিনষ্ট হয়।
রাজা রাজা অধার্মিক হইলে প্রজাগণ অতি দুঃখে কাল যাপন
করে। রাজা কর্তক উচ্ছেদ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত
হয়। নির্দোষকে বন্দী সহ বহু নির পরাধ ব্যক্তি
বিভিন্ন ভাবে রাজা কৃর্তক ক্ষতি সাধিত হইয়া থাকে।অনেক সময় দেখাযায়, কোনো লোক নির্দোষ, তবুও রাজার আদেশে তাহাকে বন্দী করা হয়। পিতা মাতা তাহাকে মুক্ত করিতে গিয়া লক্ষ টাকাও ব্যয়
করে। আবার এমনও দেখা যায় নির্দোষ পিতাকেও মিথ্যা মামলায় দোষী না হইয়াও দোষী সাব্যস্ত
হয়, যাহার কারণে তাহাদের উদ্ধার করিতে দিয়া প্রচুর টাকা ব্যয় করিতে বাধ্য হয়। যে সব টাকা সঞ্চিত রহিয়াছে অথবা যে সমস্ত জায়গা
জমি সম্পত্তি স্থিত রহিয়াছে, সবই বিক্রি করিয়া মামলায় খরচ করিতে হয়।
ব্যাংকে
সঞ্চিত টাকা উত্তোলন করিয়া মামলায় ব্যয় করিতে হয়, সুতরাং ব্যাংকেও অর্থ জমা রাখা সম্ভব
পর হয় না। চুরি করি বার পাপের ফলে এই ভাবে
অর্থ সম্পদের বিনাশ ঘটিয়া থাকে। শত্রু চোর মানুষের শত্রু ।তাহার লোকের কষ্টে উপর্জিত টাকা, ধন সম্পত্তি হরণ
করিয়া নিজে আত্মা সাৎ করে। তাই চোর ডাকাতের
কারণে মানুষের অর্থ নাশ ও সম্পত্তি বিনাশ হইয়া থাকে। আমাদের দেশের জনগণ বেশির ভাগই দরিদ্র। সেই কারণে ভিনদেশে যাইয়া টাকা আয় করিতে হয়। শ্রদ্ধেয় বন ভন্তে বলেন, “বাংলা দেশের মানুষ বেশি
চুরি করে, সেই কারণে বাংলা দেশ দরিদ্র দেশ। ”
বুদ্ধও বলিয়াছেন, “যাহারা চুরি করে তাহারা জন্মে
জন্মে দরিদ্র কুলে জন্ম গ্রহণ করে। ” সম্পত্তি বিহীন পরিবারে জন্ম হিইয়া অতি কষ্টে
দিন যাপন করিতে হয়। অর্থ লাভ করিলেও সেই অর্থ
সম্পত্তি টিকে না। অনেক সময় লক্ষ করা যায়,
কেহ বিদেশে যাইয়া বহু কষ্টে বিনিময়ে কয়েক লক্ষ টাকা আয় করিয়াছে, তাহার আশা বাড়িতে আসিয়া
একটা বিল্ডিং নির্মাণ করিবে, ব্যবসা বাণিজ্য করিয়া উন্নতি করিবে। কিন্তু দেখা যায়,
বাড়িতে আসিবার দুই দিন পর তাহার বাড়িতে ডাকাত প্রবেশ করিয়া সমস্ত টাকা পয়সা ছিনাইয়া
লইয়া গিয়াছে।
অথবা
রাত্রে বাড়িতে চোর ঢুকিয়া সমস্ত টাকা হরণ করিয়াছে। অতীতে চুরি করিবার পাপের ফলে এই ভাবে চোর ডাকাত
বাড়িতে আসিয়া সহায় সম্পত্তি হরণ করে। সকলের
বাড়িতে চুরি ডাকাতি হয় এরূপ নহে। অনেরক সময়
চুরি ডাকাতি ব্যতীত এমনিতেও টাকা পয়সা হারিয়ে যায়। ইহাও চুরি করিবার পাপের ফল। আমরা সেই অতীতের পাপ দেখিতে পাই না বলিয়া চোরেরে
উপর রাগ করিয়া থাকি। পাপের ফল ভোগ করিবার সময়
যদি অতীতের সেই পাপ দর্শন করিতে পারিতাম, তবে বর্তমান দুঃখকে মানিয়া লইতে পারিতাম।
রোগ
ব্যাধি স্বভাবত মানুষ সুস্থ জীবন কামনা করে,
রোগ ব্যাধি হীন জীবন কামনা করে। কিন্তু রোগ
ব্যাধি নামক শত্রু মানুষকে আক্রমণ করিয়া থাকে। যাহারা কঠিন রোগ গ্রস্ত হয়, তাহাদের চিকিৎসার জন্য
নিজের জায়গা জমি পর্যন্ত বিক্রি করিতে হয়। অনেক কষ্টে অর্জিত অর্থ চিকিৎসায় ব্যয় করিতে হয়। অনেক পরিবারে সেই রকম রোগ ব্যাধি গ্রস্ত ব্যক্তি
রহিয়াছে যাহার পিছনে চিকিৎসার জন্য হাজার লক্ষ টাকা ব্যয় করা হইয়াছে। ইহাতে পরিবারের সব কিছু নিঃশেষ হইয়া নিঃস্ব হইতে
হয়। এভাবে হঠাৎ ব্যাধি গ্রস্ত হইয়া একটি পরিবারের
ধনসম্পত্তি বিনাশ হয়। ইহাও অতীতের চুরি করিবার
পাপের ফল।
ইহা
ব্যতীত চুরি কিরবার ফলে দুরিদ্র কুলে জন্ম হইয়া শোকে অভাব অনটনে নির্যাতিত হইয়া দুঃখে
কাল কাটাইতে হয়। তাহারা সতত পর কর্মে রত, পর
প্রেরক, পরদত্ত ভোজী হয়, সর্বত্র ‘নাই নাই’ শব্দ তাহাদের কর্ণ গোচর হয়, অনাহারে থাকিতে
হয়। তাহার যাহা চায় তাহা পায় না, অপরের কাছে
যাচঞাশীল হয়। মোট কথা, পরের অর্থ সম্পদ চুরি
(কিংবা ডাকাতি) করিলে এক দিকে যেমন সম্পত্তি বিহীন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করিয়া অতি দুঃখ
কষ্টে জীবন যাপন করিতে হয়, অন্য দিকে যৎকিঞ্চিৎ সম্পত্তি থাকিলেও তাহা অগ্নি, জল, রাজা,
শত্রু ও রোগ ব্যাধির কারণে বিনষ্ট হয়।
চুরির পাঁচটি অঙ্গ পর পরি গৃহীত বস্তু, পর পরি গৃহীত বস্তু বলিয়া ধারণা, চুরি করিবার চেতনা, চুরি করিবার উপক্রম এবং সেই উপক্রমে হরণ করা, এই পঞ্চ অঙ্গ পরি পূর্ণ থাকিলে তবেই চুরি কর্মের পাপ সম্পাদিত হয়। চুরি না করিবার সুফল যাহারা চুরি করে না তাহারা জন্মে জন্মে ধনী কুলে জন্ম লাভ হইয়া মনোজ্ঞ ভোগ সম্পত্তি লাভ করে, তাহাদের লব্দ সম্পত্তি চির কাল স্থিত থাকে, ঈস্পিত বস্তু শীঘ্রই লাভ হয়, অর্থাৎ যাহা কামনা করে তাহা শীঘ্রই লাভ করে, তাহাদের কামনা বাসনা অপূর্ণ থাকে না, অভাবের কষ্ট তাহাদের হয় না, ‘নাই’ শব্দ তাহাদের কর্ণ গোচর হয় না। তাহারা যাহা করেন ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি বা চাষা বাদ সব কিছুতেই উন্নতি লাভ করেন।
অগ্নিতে, বন্যায় তাহাদের সম্পত্তি ও বাড়ি ঘর ক্ষতি গ্রস্ত হয় না, রাজা কর্তৃক ধন বিনাশ অথবা মিথ্যা মামলায় জড়িত হইতে হয় না, শত্রু চোর ডাকাতের কারণে অর্থ সম্পত্তি বিনাশ হয় না, রোগ ব্যাধির কারণে টাকা ও সম্পত্তি নষ্ট হয় না। জ্ঞাতি মিত্র ও প্রিয় জনের বিচ্ছেদ জনিত শোক করিতে হয় না, পর কর্মে রত হইতে হয় না, পরদত্ত ভোজী হইতে হয় না, যাচক হইতে হয় না, সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতি বাহিত হয়, মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ হয়; মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গ লোকে গমন করে। চুরি করা কর্ম ফল সমাপ্ত।