যশোধরা
যশোধরা
পর দিন প্রাতে বুদ্ধ ভিক্ষা পাত্র হস্তে ভিক্ষায় বহির্গত হইলেন। চতুর্দিকে সংবাদ প্রচারিত হইল: “যে রাজ কুমার সিদ্ধার্থ রক্ষী বর্গ পরিবেষ্টিত হইয়া রথা রোহণে নগরে ভ্রমণ করিতেন, তিনিই নগরের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা সংগ্রহ করিতেছেন। তাঁহার পরি ধানে গৈরিক বসন, হস্তে মৃণায় ভিক্ষা পাত্র। ”
আরো দেখুন: রাহুলের সংক্ষিপ্ত জীবনী
আরো দেখুন: বুদ্ধের পিতা
![]() |
যশোধরা |
বিস্ময়কর জনরব শ্রবণ করিয়া নৃপতি
অতি ত্বরায় বুদ্ধের নিকট আসিয়া কহিলেন: “তুমি কেন আমায় এই রূপে কলঙ্কিত করিতেছ?
তুমি কি জান না যে, আমি অতি সহজেই তোমার ও তোমার ভিক্ষু দিগের আহারের সংস্থান
করিতে পারি?” বুদ্ধ উত্তর দিলেন, “ইহা আমার বংশ গত প্রথা। ” নৃপতি কহিলেন: “তাহা
কি প্রকারে সম্ভব? তুমি রাজ বংশ সস্তৃত, তোমার পূর্ব পুরুষদের কেহই খাদ্যের জন্য
ভিক্ষা করেন নাই। ”
“মহা রাজ” বুদ্ধ উত্তর করিলেন, “আপনি ও আপনার বংশ রাজ কুলোৎপন্ন; পূর্বতন বুদ্ধ গণ হইতে আমার উৎপত্তি, তাহারা ভিক্ষা লব্ধ খাদ্যে জীবন ধারণ করিতেন। ” নৃপতি কোন উত্তর করিলেন না। বুদ্ধ পুন রপি কহিলেন, “রাজন, কেহ লুক্কাষিত ধন ভাণ্ডার আবিষ্কার করিলে, সর্বাপেক্ষা মূল্য বান রত্ন স্বীয় পিতাকে উপহার দিবার প্রথা আছে।
তজ্জন্য, ধর্ম রূপ আমার এই
রত্ন ভাণ্ডার আপনার নিকট উন্মুক্ত করিতে অনুমতি দিন এবং এই রত্নটি আমার নিকট হইতে
গ্রহণ করুন। তদনন্তর বুদ্ধ নিম্ন লিখিত কথা গুলি শ্লোকে আবৃতি করিলেন: “অবিলম্বে
জাগরিত হইয়া সত্যের সম্মুখে মনের দ্বার
উদঘাটন কর। পবিত্র তার আচরণে অনন্ত আনন্দ
লাভ করিবে। ”
তৎপরে নৃপতি রাজ কুমারকে লইয়া প্রাসাদে গমন করিলে মন্ত্রী বর্গ ও রাজ পরিবারস্থ সকলে প্রভূত সম্মানের সহিত তাহার অভ্যর্থনা করিলেন কিন্তু রাহুলের মাতা যশো ধরা আসিলেন না। নৃপতি যশো ধরাকে আসিতে অনুরোধ করিলেন, কিন্তু যশো ধরা উত্তর করিলেন, “যদি আমি শ্রদ্ধার পাত্রী হই, সিদ্ধার্থ নিশ্চয়ই আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। ”
পুণ্যাত্মা আত্মীয় ও মিত্র বর্গের সম্ভাষণান্তে জিজ্ঞাসা
করিলেন, “যশো ধরা কোথায়?” যশো ধরা আসিতে অস্বীকার করিয়াছেন শুনিবামাত্র তিনি
পত্নীর কক্ষে গমন করিলেন। বুদ্ধ শিষ্যদ্বয় শারি পুত্র ও মৌদগল্যায়ণকে রাজ পুত্রীর
কক্ষে লইয়া গিয়াছিলেন। তিনি তাহাদিগকে
কহিলেন, “আমি মুক্ত, কিন্তু রাজ পুত্রী এখনও মুক্ত হন নাই।
বহু দিন আমার দর্শনা ভাবে তিনি অতিশয় শোকাকুলা। তাঁহার শোককে স্বাভাবিক গতির অনুবর্তী হইতে বাধা প্রদান করিলে তাহার অন্তঃকরণ আসক্তি মুক্ত হইবে না। যদি তিনি তথাগত কে স্পর্শ করেন, তাহাকে বাধা দিও না। ” যশো ধরা স্বীয় কক্ষে বসিয়া ছিলেন। তাঁহার পরি ধানে সামান্য পরিচ্ছদ, তাহার কেশ কতত।
সিদ্ধার্থ প্রবেশ করিলে, রাজ পুত্রীর গভীর প্রেম
উচ্ছ্বসিত হইয়া তাহাকে অধীর করিল। তাহার দয়িত যে সত্যের প্রচারক জগত পতি বুদ্ধ,
ইহা বিস্মৃত হইয়া তিনি বুদ্ধের পাদ স্পৰ্শ করিয়া অগণ্য অশ্রু ধারা মোচন করিলেন। কিন্তু শুদ্ধোদনের উপস্থিতি স্মরণ করিয়া তিনি
লজ্জিত হইলেন, পরে উত্থান করিয়া নিকটে বিনীত ভাবে উপবেশন করিলেন।
নৃপতি রাজ কুমারীর সমর্থনে কহিলেন, “যশো ধরার গভীর প্রেমই ইহার কারণ, ইহা অস্থায়ী উচ্চাস মাত্র নহে। সাত বৎসর হইল সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগ করিয়াছেন, এই সাত বৎসর যাবৎ সিদ্ধার্থের মস্তক মুণ্ডনের সংবাদ পাইয়া তিনিও স্বীয় মস্তক মুণ্ডন করিয়াছেন।
সিদ্ধার্থ সুগন্ধি দ্রব্য
ও অলঙ্কারাদি পরি ত্যাগ করিয়াছেন শুনিয়া তিনিও ঐ সমূদয় বৰ্জন করিয়াছেন। স্বামীর ন্যায় তিনিও নির্দিষ্ট সময়ে সামান্য মৃণয়
পাত্রে আহার করিয়াছেন। সিদ্ধার্থের ন্যায় তিনিও উত্তম বস্ত্রাচ্ছাদিত উচ্চাসন পরিহার
করিয়াছেন, এবং অপরা পর রাজ কুমার গণ তাহার পাণি প্রার্থী হইলে তিনি উত্তর দিয়াছেন,
যে, তিনি সিদ্ধার্থেরই! অত এব, তাহাকে ক্ষমা কর। ”
তৎপরে বুদ্ধ প্রেমে যশো ধরার সহিত বাক্যা লাপ করিলেন। কথোপ কথন কালে যশো ধর যে তাঁহার পূর্ব পূর্ব জন্ম হইতে পুণ্য রাশি সঞ্চয় করিয়া ছিলেন তাহাও তিনি বিবৃত করিলেন। এমন কি অতীত জীবনে তিনি যশো ধরা কর্তৃক প্রভূত রূপে উপকৃত হইয়াছেন। বোধিসত্ত্ব যখন মানবের উচ্চতম লক্ষ্য বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির চেষ্টায় নিরত ছিলেন, সেই সময় যশো ধরার পবিত্র তা, তাহার বিনয়, তাহার ধর্মানু রাগ রোধি সত্বের নিকট অমূল্য প্রতীয় মান হইয়াছিল।
যশো ধরার ধর্মানু রাগ এত প্রবল ছিল যে, তিনি বুদ্ধের পত্নী হইবার বাসনা করিয়া ছিলেন। ইহা তাহার কর্ম এবং বহু পুণ্যের ফল। তাঁহার শোক বর্ণনাতীত; কিন্তু তাহার পূর্ব অর্জিত সুকৃতির পরিমা এবং ইহ জন্মের পবিত্র জীবন অমোঘ ওষধির ন্যায় সমস্ত সস্তাপকে স্বর্গীয় আনন্দে পরিণত করিবে। যশোধরা সমাপ্ত।