প্রাণী হত্যা কর্ম ফল

প্রাণী হত্যা কর্ম ফল

ক্ষ্রদ্র হউক, বৃহৎ হউক, দূরে অথবা নিকটে হউক, দৃশ্য ও অদৃশ্য হউক, যে কোনো প্রাণীকে বধ বা হত্যা করিলে প্রাণিহত্যা অপরাধে অপরাধী হইতে হয়।  পাণাতিপাত অর্থাৎ প্রাণিহত্যা বা প্রাণিবধ এর পর্যায় বচনবিশেষ।  প্রাণী বলিলে ব্যবহারিক হিসাবে সত্ত্ব, আর পরমার্থ হিসাবে জীবিতেন্দ্রিয় বুঝায়।  সে প্রাণীতে যাহার প্রাণী বলিয়া সংজ্ঞা (ধারণ) আছে, তাহার নিকট উৎপন্ন জীবিতেন্দ্রিয় উপচ্ছেদের (হত্যা) উপক্রমের দ্বারা উত্থাপিত, কায় বাক্যের দ্বারা প্রবর্তিত হত্যার চেতনাকে বলে পাণাতিপাত।  সেই চেতনা গুণবিরহিত তির্যক জাতীয় ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রতি উৎপন্ন হইলে অল্প দোষযুক্ত, বৃহৎ শরীরধারীর ক্ষেত্রে মহাদোষ যুক্ত। তাহা মারি বার তাঁর তম্যের দরুন ফলও ইতর বিশেষ হইয়া থাকে।  হত্যায় অধিক বল প্রয়োগ করিতে না হইলেও মনুষ্যাদি গুণবান প্রাণিহত্যায় অধিক দোষ, অল্পমাত্র গুণ থাকিলে সেই প্রাণিহত্যায় দোষও কম হয়।  আবার শারীরিক গুণ সমান সমান হইলেও ক্লেশ (লোভ, দ্বেষ, মোহানুসারে) এবং হত্যার উপক্রমের তারতম্য অনুসারে পাপেরও তারতম্য ঘটিয়া থাকে। 


আরো দেখুন: চুরি করা কর্ম ফল



প্রাণী হত্যা কর্ম ফল

প্রাণী হত্যা কর্ম ফল

প্রাণি হত্যার কুফল প্রাণি হত্যাকারী মনুষ্যগণ মৃত্যুর পর দুর্গতি নরকে উৎপন্ন হয়। আশি কল্প নরকাগ্নিতে দগ্ধ বিদগ্ধ হইয়া ভীষণ দুঃখযন্ত্রণা ভোগকরিয়া থাকে।  নরক হইতে মুক্ত ইহয়া পাঁচশতবার প্রেতযোনিতে জন্ম লইতে হয়।  প্রেতলোকে উৎপন্ন হইলে শত, সহস্র, অযুত, লক্ষ কিংবা কোটি বৎসর, এমনকি এক বুদ্ধান্তর কল্পকাল পর্যন্ত কোনো আহার বা এক বিন্দু জলও খাইতে পায় না।  নিরন্তর ক্ষুৎপিপাসার যন্ত্রণায় জর্জরিত হইয়া তাহাদে রক্তমাংস বিশুষ্ক হয়, দেহ ভীতিজনক কঙ্কালময় কিম্ভূতকিমাকারে পরিণত হয়, দেহের বড় বড় স্নায়ুগুলি ভাসিয়া ওঠে।  পৃষ্ঠকণ্টকের সহিত উদরচর্ম লাগিয়া যায়।  


দেহে ফাটল ধরে, এলো মেলো কেশে মুখখানি ঢাকিয়া যায়।  উলঙ্গ দুর্বল বিশ্রী বিরাট দেহপঞ্জর ভয়ংকর রূপে পরিণত হয়, পূর্বার্জিত পাপ স্মরণ করিয়া অনুতাপ ও রোদন করিতে করিতে দিগবিদিক ছুটাছুটি করে, পরে অনন্যোপায় হইয়া শ্রান্ত দেহে কোনো এক দুর্গন্ধময় নিভৃত স্থানে এলোমেলো ভাবে বিশ্রী অবস্থায় পড়িয়া থাকে।  বহু বৎসরান্তর এক একবার দৈববাণী শ্রুতিপথে ধ্বনিত হয়, “আসো, আসো, ভোজন করো, জল পান করে।” এই প্রকারে শব্দ শুনামাত্র আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও উঠিতে না পারিয়া গড়াগড়ি ও হামাগুড়ি দিতে দিতে বহু যোজন অগ্রসর হয় বটে, কিন্তু কোথাও আহার ও জল খুঁজিয়া পায় না।  দুঃখের উপর দুঃখে জর্জরিত হওয়ার পর প্রেত তখন বিকট চিৎকার করিয়াবলে, দাও, দাও, আহারদাও, জলদাও।  তখন দৈববাণী ধ্বনিত হয়, “নাই, নাই নাই।” এই অসার বাণী প্রেতের অন্তরে বিষদগ্ধ শেলেরে ন্যায় বিদ্ধ হয়।অতঃপর ক্ষুধা যন্ত্রণায় কাতর হইয়া প্রেত ছিন্ন তরুর ন্যায় ভূমি তলে ভাঙ্গিয়া পড়ে।  প্রেতলোকে দীর্ঘকাল এভাবেই ক্ষুধার দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়।


প্রেতলোক হইতে মুক্ত হইয়া মৎস্য, সর্প, গো মহিষ, কুক্কুর, শৃগাল ও মৃগাদি তির্যকযোতে পাঁচশতবার করিয়া জন্ম লইতে হয়।  তির্যক কুলে জন্ম হইলে শত্রু র দ্বারা ও হিংস্র প্রাণী সিংহ ব্যাঘ্রাদির আক্রমণে কিংবা অন্য কাহারও আক্রমণে মৃত্যুবরণ করিতে হয়।  এজন্য তির্যক প্রাণী সকল উদ্বিগ্ন অবস্থায় আমাকে মারিতে আসিতেছি কি না, শত্রু রা কখন মারিয়া ফেলে, হিংস্র প্রাণীরা কখন আমাকে ধরিয়া খায়’ এই ভাবে মরণ ভয়ে আজীবন আতঙ্কিত থাকে।  যেমন মৎস্য, কচ্ছপাদি জেলে কর্তৃক; মৃগ, শূকরাদি মনুষ্য ও সিংহ ব্যাঘ্রাদি কর্তৃক; গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি মনুষ্য কর্তৃক নিহত হইয়া থাকে।  প্রাণিহত্যা পাপের ফলে এই রূপে অকালে মরিতে হয়।  প্রাণিহত্যা পাপের ফলে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হাঁস, মুরগি প্রভৃতি তির্যক যোনিতে জন্ম হইয়া কসাইয়ের হস্তগত হয় এবং শিরশ্ছেদ হইয়া অকাল মৃত্যু দুঃখ ভোগ করে।  কসাই মাংস, চামড়া বিক্রির জন্য ইহাদের বধ করিয়া থাকে। 


প্রাণিহত্যা জনিত পাপের ফল এরূপে ভোগমকরিতে হয়।  মবাড়িতে অতিথি আসিলে তাহাদের জন্য হাঁস মুরগি জবাই করা হয়, পূজা বা ধর্মের উদ্দেশ্যে পশু পক্ষী বলি দেওয়া হয়।  আমাদের দেশে কিংবা অন্যান্য দেশে বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশে বা এলাকায় প্রতি বৎসর কোরবানের সময় লক্ষ লক্ষ গুরু ও অন্যান্য প্রাণী বধ হইয়া থাকে।  এইভাবে তির্যক প্রাণীরা বধ জনিত অকালে যে মৃত্যু বরণ করে, ইহা তাহাদের অতীতের প্রাণিহত্যা জনিত পাপের ফল।  অতীতে এই প্রাণী সকল মনুষ্যলোকে জন্ম নিয়া প্রাণিহত্যা করিয়াছিল, ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।  আর সেই পাপের ফলেই তির্যক যোনিতে জন্ম হইয়া কৃত পাপের বিপাক ভোগ করিতে হইতেছে।  অজ্ঞতা এবং ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে বর্তমানে বৌদ্ধ সমাজে ও দেখা যায়, অতিথি আপ্যায়নের খাতিরে নির্দ্বিধায় প্রাণিহত্যাকরা হয়া।  প্রাচীন কালে ও লোকেরা মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে পশু বলি দিয়া মহা ‍দুঃখের ভাগী হইয়াছিল, এমন বহু ঘটনা বলী প্রমাণ স্বরূপ বুদ্ধ দেশনা করিয়াছেন।

 

এই প্রসঙ্গে অতীতের এক বাস্তব কাহিনি এখানে উল্লেখ করা হইতেছে। শাস্তা জেতবনে মৃতক ভক্ত (মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে পশু বলী দেওয়া) সম্বন্ধে এই কাহিনি বলিয়া ছিলেন।  তখন লোকে বিস্তর ছাগ, মেষ প্রভৃতি পশু বধ করিয়া পরলোক গত জ্ঞাতি বন্ধু দিগেরে উদ্দেশে মৃতক ভক্ত দিত।  তাহা দেখিয়া একদিন ভিক্ষুগণ শাস্তাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভান্তে, এই যে লোকে বহু প্রাণী বধ করিয়া মৃতক ভক্ত দিয়া থাকে, ইহাতে কি কোনো সুফল হয়?” শাস্তা বলিলেন “ভিক্ষুগণ, মৃতক ভক্তে কোনো সুফল নাই, ইহার জন্য প্রাণী বধ করিলেও কোনো সুফল নাই। বরঞ্চ হত্যা জনিত পাপের ফল হত্যা কারীকে ভোগ করিতে হয়।  পূর্বে ও পণ্ডিতেরা আকাশে উবেশন করিয়া দোষ কীর্তন পূর্বক এই কুপ্রথা সমস্ত জম্বুদ্বীপ হইতে উঠাইয়া দিয়া ছিলেন।  কিন্তু পুনর্জন্ম গ্রহণ করিয়া লোকের অতীত স্মৃতি লোপ পাইয়াছে।  সেই কারণে ইহা পুনর্বার প্রাদুর্ভূত হইয়াছে। ” 


অনন্তর তিনি সেই অতীত কথা বলিতে লাগিলেন পুর কালে বারাসীরাজ ব্রহ্মত্তের সময় কোনো এক লোক বিখ্যাত ত্রিবেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ অধ্যাপক মৃতক ভক্ত (পশু বলি) দেওয়ার অভি প্রায়ে একটি ছাগ আনয়ন করিয়া শিষ্য দিগকে বলিলেন, “বৎসগণ, ইহাকে লইয়া নদীতে স্নান করাও এবং গলায় মালা পরাইয়া পঞ্চাঙ্গুলিক দিয়া ও সাজাইয়া লইয়া আসো।  তাহার “যে আজ্ঞা” বলিয়া ছাগটিকে লইয়া নদীতে গেল এবং স্নান করাইয়া ও সাজাইয়া তীরে রাখিল।  ঠিক সেই সময় অতীত জন্ম সমূহের বৃত্তান্ত ছাগের মনে পড়িল এবং ‘আজই আমার দুঃখের অবসান হইবে’ ভাবিয়া সে অতীব হর্ষের সহিত অট্টহাস্য করিয়া উঠিল।  কিন্তু পরক্ষণেই ‘আহা, আমি এতদিন যে দুঃখ ভোগ করিলাম, আমার প্রাণ বধ করিয়া এই ব্রাহ্মণও আমার ন্যায় দুঃখ ভোগ করিবে’ ইহা ভাবিয়া সে করুণা পরবশ হইয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল।  তখন ব্রাহ্মণের শিষ্যগণ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ভাই ছাগ, তুমি হাসিবার সময়েও বিকট শব্দ করিলে, আবার কাঁদিবার সময়েও বিকট শব্দ করিলে! বলো তো, তুমি হাসিলেই বা কেন, কাঁদিলেই বা কেন?” ছাগ বলিল, “তোমাদের অধ্যাপকের নিকট গিয়া আমাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিও, আমি সেখানেই এই উত্তর দিব। ”

 

শিষ্যেরা ছাগটি লইয়া অধ্যাপকের নিকট ফিরিয়া গেল এবং যাহা যাহা ঘটিয়াছিল সমস্তই নিবেদন করিল। তাহা শুনিয়া ব্রাহ্মণ নিজেই ছাগকে হাসিবার ও কাঁদিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। ছাগ তখন জাতিস্মর হইয়াছিল অর্থাৎ নিজের অতীত জন্মের কথা স্মরণ করিতে পারিতেছিল। সে বলিল, “দ্বিজবর, একসময়ে আমিও আপনার মতো ত্রিবেদ পারদর্শী ব্রাহ্মণ ছিলাম। তখন একবার একটা ছাগ বধ করিয়া মৃতক ভক্ত দিয়া ছিলাম বলিয়া সেই পাপে চারিশত নিরানব্বইবার ছাগ জন্ম গ্রহণ করিয়া শিরশ্ছেদ জনিত যন্ত্রণা ভোগ করিয়া ছিলাম। ইহাই আমার পঞ্চশত তম ও কৃত পাপ কর্মের ফল ভোগ করিবার শেষ জন্ম।  এখনই চিরকালে মতো দুঃখের হাত হইতে পরিত্রাণ পাইব ভাবিয়া আমি হাসিয়াছি।  আবার যখন দেখিলাম, আমি তো পাঁচশত বার শিরশ্ছেদ জনিত দুঃখ ভোগ করিয়া মুক্ত হইতে চলিলাম; কিন্তু আপনাকে আমার প্রাণ বধ জনিত পাপে ঠিক এইরূপে পাঁচশত বার শিরশ্ছেদ দণ্ড পাইতে হইবে।  কাজেই আপনার প্রতি করুণা পরবশ হইয়া আমি কাঁদিয়াছি। ”

 

এই কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণের মনে ভীষণ ভয়ের সঞ্চার হইল।  তখন ব্রাহ্মণ বলিলেন, “তোমার কোনো ভয় নাই, আমি কথা দিতেছি তোমার প্রাণ নাশ করিব না” ছাগ বলিল, “আপনি মারুন, আর নাই মারুন, আজ আমার নিস্তার নাই, আজই আমার প্রাণ নাশ হইবে। ” “কোনো চিন্ত করিও না, আমি সঙ্গে থাকিয়া তোমার জীবন রক্ষা করিব। ” “দ্বিজবর, আপনি যে রক্ষার চেষ্টা করিবেন তাহা অতি দুর্বল, আর আমার কৃত পাপের শক্তি অতি প্রবল।” এইরূপ কথোপকথনের পর ব্রাহ্মণ ছাগকে বন্ধন মুক্ত করিয়া দিলেন এবং ‘আজা দেখিব, কে এই ছাগকে মারে’ এই সংকল্প করিয়া শিষ্যগণের সহিত উহার সঙ্গে সঙ্গে রহিলেন।  ছাগ বন্ধন মুক্ত হওয়া মাত্র এক খণ্ড প্রকাণ্ড প্রস্তরের উপর আরোহণ পূর্বক গ্রীবা প্রসারিত করিয়া গুল্ম পত্র খাইতে আরম্ভ করিল। ঠিক সেই সময় পাষাণের উপর বজ্রপাত হইল।  ইহাতে পাষাণ বিদীর্ণ হইয়া গেল এবং উহার এক খণ্ড এমন বেগে ছাগের প্রসারিত গ্রীবায় লাগিল যে তৎক্ষণাৎ তাহার দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল।

 

এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়া সেখানে বিস্তর লোক সমবেত হইল।  তখন বোধিসত্ত্ব বৃক্ষ দেবতা হইয়া সেই স্থানে বাস করিতে ছিলেন।  দৈবশক্তি প্রভাবে তিনি আকাশে বীরাসনে উপবেশন করিলেন; সকলে সবিস্ময়ে তাহা দেখিতে লাগিল। বোধিসত্ত্ব ভাবিলেন, ‘আহা, এই হত ভাগ্যেরা যদি দুষ্ক্রিয়ার ফল বা প্রাণিহত্যার বিপাক জানিতে পারে, তাহা হইলে বোধ হয় কখনো প্র্রাণি হিংসা করিবে না। ’ অনন্তর তিনি অতি মধুর স্বরে এই সত্য শিক্ষা দিলেন জানে যদি জীব, কী কঠোর দণ্ড জন্মে জন্মে ভোগ করে হিংসার কারণ, তবে কি সে কভু জীবের জীবন হরে? এই রূপে বোধিসত্ত্ব শ্রোতাদিগের মনে নরক ভয় জন্মাইয়া ধর্মো পদেশ দিতে লাগিলেন।  তাহা শুনিয়া সকলে এত ভীত হইল যে তদবধি তাহারা প্রাণিহত্যা পরিত্যাগ করিল এবং বোধিসত্ত্বের শিক্ষা বলে সকলে দশ বিধ শীল সম্পন্ন হইল।  অন্তর বোধিসত্ত্ব কর্মানুরূপ ফল বোঘ করিয়া লোকন্তর প্রস্থান করিলেন, তেমনই সেই সকল লোকও আমরণ দান ধর্মাদি সৎকার্যের অনুষ্ঠান করিয়া অবশেষে ব্রহ্মলোকে প্রস্থান করিলেন।  প্রাণিহত্যার বিপাক সম্বন্ধে অতীতের আরও তিনটি বাস্তব ঘটনা বলী এই খানে উল্লেখ করা হইল।

 

শাস্তা জেতবনে অবস্থান কালে বহু সংখ্যক ভিক্ষু শাস্তাকে দর্শন করিতে আসিবার সময় এক গ্রামে পিণ্ডপাতের জন্য প্রবেশ করিয়া ছিলেন। গ্রাম বাসীরা তাঁহাদের পাত্র গ্রহণ করিয়া  আসনশালায় বসাইয়া যাগু খাদ্যাদি দিয়া পিণ্ডপাতবেলা না আসা পর্যন্ত বসিয়া ধর্ম শ্রবণ করিতে ছিলেন।  সেই মুহূর্তে ভাত পক্ব করিয়া সূপ ব্যঞ্জনাদি তৈল মশলাদি দ্বারা সাঁতলানর (গরম তৈলে ভাহা) সময় এক মহিলার ভাজন হইতে অগ্নি জ্বালা উঠিয়া ঘরের ছাদে আগুন ধরিয়া গেল।  গৃহটি জ্বলিতে জ্বলিতে তাহা হইতে এক গুচ্ছখড় অগ্নিদগ্ধাবস্থায় আকাশে দিকে উঠিল।  তখন আকাশ পথে গমনরত একটি কাক সেই জ্বলন্ত খড়েরে গুচ্ছে গলা আটকাইয়া দগ্ধাবস্থায় গ্রামের মাঝ খানে পতিত হইয়া মারা গেল। ভিক্ষুগণ তাহা দেখিয়া ‘অহো, কী ভয়ংকর! বন্ধুগণ, দেখুন কাকটির কী দুরবস্থা হইয়াছে! এই কাক পূর্ব জন্মে কী পাপ করিয়াছে তাহা শাস্থা ব্যতীত আর কেই বা বলিতে পারেন! চলুন যাই, শাস্তাকে ইহার পূর্ব জন্ম বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিব’ বলিয়া প্রস্থান করিলেন।  পরে বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হইয়া তাহারা ঘটনাটি আনু পূর্বিক ভাবে বলিলেন। অতঃপর বুদ্ধ কাকের অতীত পাপ কর্মের কাহিনি ব্যাখ্যা করিলেন।

 

হে ভিক্ষুগণ, সেই কাক নিজ কৃত কর্মেরই ফল ভোগ করিয়াছে।  অতীত কালে বারাণসীতে এক কৃষক নিজের একটি গরুকে কিছুতেই দমন করিতে পারিতে ছিল না।  ইহার দ্বারা কোনো কাজই করাতে পারিতেন না।  সেই গরুটি কিছু দুর যাইয়া শুইয়া পড়িত।  মারিয়া তুলিলেও কিছু দুর যাইয়া আবার শুইয়া পড়িত।  শতচেষ্টা করিয়াও উহাকে দমাইতে না পারিয়া কৃষক ক্রোধাভিভূত হইয়া ‘এখন হইতে তুমি সুখেই শুইয়া থাকিবে’ বলিয়া পলালপিণ্ড (শুষ্ক তৃণগুচ্ছ) করিয়া তদ্দ্বারা উহার গ্রীবাদেশ মোড়াইয়া আগুন লাগাইয়া দিল।  গরুটি দগ্ধ হইয়া সেখানে মরিয়া গেল।  হে ভিক্ষুগণ, এ অগ্নিদগ্ধ কাক ছিল অতীতর সেই গরুটির স্বামী বা কর্তা, সে ঐ পাপ কর্ম করিয়া ছিল।  কৃত পাপের ফল স্বরূপ অনেক কাল নরকে পক্ব হইয়া।  বিপাকাব শেষে সাত বার কাক যোনিতে জন্ম লইয়া এই প্রকারে আকাশে দগ্ধ হইয়াই মরিয়াছে। প্রাণিহত্যা জনিত পাপের ফলে জন্মে জন্মে এভাবেই অকালে মৃত্যু বরণ করিতে হয়।  মনুষ্য হউক বা পশু পক্ষী হউক পাপের ফল সকল কেই ভোগ করিতে হইবে।

 

অন্য আর এক দল ভিক্ষু শাস্তাকে দর্শন করিবার জন্য নৌকায় আরোহণ করিয়া যাই বার সময় তাঁহাদের নৌকা হঠাৎ সমুদ্রে অচল হইয়া গেল। যাত্রীরা ‘নিশ্চয়ই নৌকায় কোনো কাল কর্ণী (পাপী) আছ’ বলিয়া শলাকা চালনা করিল।  নাবিকের অল্প বয়স্কা একসুন্দরী স্ত্রী ছিল নৌকাতে। শলাকা যাইয়া তাহাকে স্পর্শ করিল।  ‘শলাকা পুনরায় চালনা করুন’ বলিয়া পর পর তিন বার চালনা করা হইল এবং তিন বারই সেই নারীকে স্পর্শ করিল।  যাত্রীগণ ‘কী মহাশয়!’ বলিয়া নাবিকের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।  নাবিক বলিল, এক জনের জন্য এত গুলি লোকের প্রাণ যাইতে তাহা হইতে পারে না।  


ইহাকে জলে ফেলিয়া দাও। তাহাকে ধরিয়া জলে ফেলিয়া দেওয়ার সময়  সে মরণ ভয়ে ভীত হইয়া উচ্চস্বরে কাঁদিয়া উঠিল।  ইহা শুনিয়া নাবিক বলিল, “ইহার আভরণ গুলি নষ্ট হইবে কেন, সেই গুলি খুলিয়া লইয়া সামান্য বস্ত্র খণ্ড পরাইয়া জলে ফেলিয়া দাও।  আর আমি তাহাকে জলে ভাসিতে দেখিলে কিছু তেই সহ্য করিতে পারিব না। অত এব যাহাতে আমি না দেখিতে পাই একটি বালুকা পূর্ণ কলসি তাহার গলায় বাঁধিয়া সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। ” যাত্রীরা তাহাই করিল।  পতিত স্থানে মৎস্য কচ্ছপেরা তাহাকে খাইয়া ফেলিল। ভিক্ষগণ এই দৃশ্য দেখিয়া চিন্তা করিলেন, ‘শাস্তা ব্যতীত কে এই নারীর পূর্ব জন্মের কথা কৃত কর্মের কথা জানিবে! চলুন যাই, আমরা শাস্তাকে তাহার পূর্ব জন্মের কথা জিজ্ঞাসা করিব’। অতঃপর ভিক্ষুগণ গন্তব্য স্থলে পৌঁছিয়া নৌকা হইতে অবতরণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

 

পরে ভিক্ষুগণ শাস্তার নিকট উপস্থিত হইয়া আনু পূর্বিক ভাবে ঘটনাটি বলিলেন।  তখন শাস্তা বলিলেন, “হে ভিক্ষগণ, সেই স্ত্রীলোকটিও নিজের কৃত পাপ কর্মেরই ফল ভোগ করিয়াছে।  সে অতীতে বারণসীতে একজন গৃহপতির ভার্যা ছিল।  জল আনা, ধান ভাঙ্গা, মশলাদি কুটা, রান্না বান্না সমস্ত গৃহস্থালীর কাজ কর্ম নিজের হাতেই করিত।  তাহার একটি কুকুর ছিল, যে বসিয়া বসিয়া ঐ স্ত্রীলোকের সমস্ত কাজ কর্ম দেখিত।  খেত এ (ক্ষেতে) ভাত লইয়া যাই বার সময়, কাঠ পাতা আহরণের জন্য অরণ্যে যাওয়ার সময় কুকুরটিও তাহার সঙ্গে যাইত। একদিন তরুণ বালকেরা তাহাকে যাইতে দেখিয়া ঠাট্টা করিয়া বলিল, ওহে, শুনক লুব্ধক তাহার শুনক (কুকুর) লইয়া বাহির হইয়াছে, অদ্য আমরা কিছু মাংস খাইতে পাইব।  


তাহাদের কথা লজ্জিত হইয়া সে তাহার কুকুর টিকে ঢিল, লাঠি দ্বারা তাড়াইয়া দিলেও ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় তাহাকে অনুসরণ করিল। এই কুকুরটি এখন হইতে পূর্বে তৃতীয় জন্মে তাহার ভর্তা (স্বামী) ছিল।কাজেই স্নেহের বন্ধন সহজেই ছিন্ন করিতে পারিতেছিল না।  অনাদি সংসারে এমন কেহ নাই, যে ব্যক্তি কোনো না কোনো সময়ে কাহারও পতি বা পত্নী হয় নাই।  নিকটবর্তী জন্মের স্নেহ আরও প্রগাঢ় হইয়া থাকে।  সে জন্য সেই কুকুরটি তাহাকে ছাড়িতে পারিতেছে না।  কোনো এক দিন স্ত্রীলোকটি ক্রদ্ধ হইয়া স্বাসীর জন্য খেত এ যাগু লইয়া যাই বার সময় কোলের মধ্যে একটি দড়ি লুকাইয়া লইয়া গেল।  কুকুরটিও তাহার সঙ্গে গেল।  সে স্বামীকে যাগু দিয়া একটা শূন্য কলসি লইয়া একটি জলাশয়ের নিকট যাইয়া কলসিতে বালুকা পূর্ণ করিয়া নিকটে অবলোকন রত কুকুরটিকে কাছে ডাকিল। কুকুটি ‘বহু কাল পরে আজ মধুর বাক্য শুনিলাম’ বলিয়া লেজ নাড়াইতে নাড়াইতে আসিয়া উস্থিত হইল।  


সে তাহার গলা দৃঢ় ভাবে ধরিয়া রজ্জুর এক পাশ দিয়া কলসি বাঁধিয়া এবং অন্য পাশ দিয়া কুকুরের গলা বাঁধিয়া কলসিটি জলের দিকে ছুড়িয়া দিল।  রজ্জুর টানে কুকুরটিও জলে পড়িয়া গেল।  বালুকা পূর্ণ কলসি জলে ডুবিয়া গেলে কুকুরটিও জলে ডুবিয়া মরিয়া গেল।  সেই কর্মের বিপাকে সেই নারী বহু কাল নরকে পক্ব হইয়া বিপাকা শেষে এক শত জন্ম বালুকা কলসি গলায় বাঁধিয়া জলে নিক্ষিপ্ত হইয়া মৃত্যু বরণ করিয়াছে। আহা! পাপের কী যে শাস্তি, কী কষ্টময় বিপাক! এক জন্ম নহে, দুই জন্ম নহে, একশত জন্ম গলায় বালুকা কলসি বাঁধিয়া জলে ডুবিয়া মরিতে হইল, এক বার মাত্র কুকুর হত্যার পাপের ফলে! বাস্তরিক, মেয়েটি যদি সেই পাপের সম্বন্ধে জানিত তাহা ইহলে কখনো কুকুরটিকে হত্যা করিত না।  তেমনই বর্তমানে যাহারা পাপ করিয়া জীবন যাপন করিতেছে তাহাদের অবস্থা কী হইবে যদি তাহারা জানিতে পারিত কখনো পাপ কর্ম সম্পাদন করিত না, তাহারা পাপ অকুশল হইতে বিরত থাকিত, পাপকে ভয় ও ঘৃণা করিত।

 

এদিকে অন্য সাতজন ভিক্ষু শাস্তাকে দর্শন করিবার জন্য যাইবার সময় সন্ধ্যা কালে একটি বিহারে প্রবেশ করিয়া বাস্থান জিজ্ঞাসা করিলেন। একটি পর্বতের গুহায় প্রস্তর নির্মিত প্রকোষ্ঠে সাতটি মঞ্চ (খাট) ছিল। তাঁহারা তাহা লাভ করিয়া সেখানে শয়ন করিলে রাত্রি বেলায় কূটা গার প্রমাণ পাষাণ গড়াইয়া আসিয়া প্রকোষ্ঠের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।আবাসিক ভিক্ষুগণ ‘আমরা আগন্তুক ভিক্ষুগণকে এই প্রস্তর প্রকোষ্ঠে থাকিতে দিয়াছিলাম, কিন্তু এখন বিশাল পাষাণ খণ্ড আসিয়া প্রকোষ্ঠের দ্বার রুদ্ধ করিয়াছে।  চলুন, আমরা ঐ পাষাণ খণ্ডকে অপসারিত করি’ বলিয়া সাতটি গ্রামের লোকদের একত্রি করিয়া চেষ্টা করিয়া পাষাণ খণ্ডটিকে অপসারণ করিত পারিলেন না।  


আস্তে প্রবিষ্ট ভিক্ষুগণও আপ্রাণ চেষ্টা করিলেন, তৎসত্ত্বেও এক সপ্তাহ ধরিয়া পাষাণ খন্ঢটি অপসারণ করা সম্ভব হয় নাই।  ইহাতে আগন্তুক ভিক্ষুগণ ক্ষুৎপিাসায় কাতর হইয়া মহা দুঃখ অনুভব করিলেন, মুমূর্ষু হইয়া কোনোপ্রকারে বাঁচিয়া রহিলেন।  সপ্তম দিবসে পাষাণ খণ্ডটি নিজে নিজেই পুনরাবর্তিত হইয়া অপগত হইল।  তখন ভিক্ষুগণ দুর্বল অবস্থায় বাহির হইয়া আসিলেন এবং ‘কোন পাপের ফলে আমরা এই মহা দুঃখ ভোগ করিলাম, তাহা শাস্তা ব্যতীত  আর কেই বা বলিতে পারিবেন! চলুন যাই, আমরা শাস্তাকে জিজ্ঞাসা করি’ এই চিন্তা করিয়া প্রস্থান করিলেন।  অতঃপর তাঁহার শাস্তার নিকট উপস্থিত হইয়া বন্দনা করিয়া এক পাশে উপবেশন করিয়া শাস্তার অনুমতি প্রাপ্ত ইহয়া নিজেদের দৃষ্ট অনুভূত কর্মের কথা শাস্তাকে বলিলেন।  তখন শাস্তা ভিক্ষু দিগকে বলিলেন

 

হে ভিক্ষুগণ, তোমরাও নিজেদের পূর্ব জন্মের পাপ কর্মের ফল ভোগ করিয়াছ। অতীতে বারাণসীবাসী সাতজন গোপালক ছেলে একটি অটবিপ্রদেশে সপ্তাহ ধরিয়া গাভি চরাইয়া ফিরিবার সময় একটি বৃহৎ গোসাপ দেখিয়া তাহার পশ্চাতে ছুটিল।  গোসাপটি পলাইয়া একটি বল্মীকে (গর্তে) প্রবেশ করিল।  সেই বল্মীকের সাতটি মুখ ছিল।  ছেলেরা ‘এখন আর ধরিতে পারিব না, আগামী কাল আসিয়া ধরিব’ বলিয়া সাত জনের প্রত্যোক ডাল পালা ভাঙ্গিয়া বল্মীকের সাতটি মুখে গুজিয়া ইহার মুখ গুলি বন্ধ করিয়া দিল।  পরর দিন তাহারা গোসাপটির কথা ভুলিয়াই গেল। অন্য অস্থানে গাভিদের চড়াইয়া সপ্তম দিবসে ফিরিবার সময় সেই বল্মীকটিকে দেখিয়া তাহাদের স্মৃতি জাগ্রত হইল।  তাহারা ভাবিল ‘জানি না, সেই গোসাপের এখন কী অবস্থা! বলিয়া নিজ নিজ বন্ধ করা ছিদ্র গুলি খুলিয়া ফেলিল।  


গোসাপটি অস্থির্মসার ইহয়া ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে জীবনকে তুচ্ছ করিয়া বল্মীক হইতে বাহিরে আসিল। তাহাকে দেখিয়া তাহাদের করুণা হইল।  ‘ইহাকে মারিও না সাতদিন অনাহারে ছিল’ বলিয়া তাহার পিঠে হাত বুলাইয়া দিয়া ‘তুমি নির্ভয়ে চলিয়া যাও’ বলিয়া তাহাকে যাইতে দিল।  গোসাপটিকে হত্যা না করিবার ফলে তাহাদের নরকে পচিতে হয় নাই।  কিন্তু সেই সাতজন একত্রে চৌদ্ধ জন্ম পর্যন্ত সাতদিন করিয়া অনাহারে ক্ষুৎপিপাসার যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল। হে ভিক্ষগণ, “তোমরাই সাতজন গোপালক হইয়া সেই পাপ কর্ম সম্পাদন করিয়াছিলে।” এই ভাবে শাস্তা তাঁহাদের অতীতে সম্পাদিত পাপ কর্ম ব্যাখ্যা করিলেন।

 

তখন একজন ভিক্ষু শাস্তাকে বলিলেন, “ভন্তে, পাপ কর্ম করিয়া আকাশে উড়িয়া, সমুদ্রে ডুবিয়া বা পর্বত গুহায় প্রবিষ্ট হইয়া সেই পাপ কর্মে হইতে রক্ষা পাইতে পারা যায় কি?” শাস্তা বলিলেন, “হে ভিক্ষুগণ, ঠিক তাহাই, আকাশাদিতে এমন কোনো স্থান নাই যেখানে যাইয়া পাপ কর্ম হইতে ‍মুক্তহইতে পারে।  অন্তরিক্ষে, সমৃদ্র মধ্যে কিংবা পর্বত গহ্বরে, জগতে এমন কোনো স্থান বর্তনাম নাই, যেখানে অবস্থান করিলে পাপ কর্মের ফল হইতে রক্ষা পাওয়া যায়।  যদি কোনো ব্যক্তি ‘এই উপায়ে পাপ কর্ম হইতে মুক্ত হইব’ ভাবিয়া অন্তরিক্ষে বসিয়া থাকে, চুরাশি হাজার যোজন গভীর মহা সমুদ্রে প্রবেশ করে, পর্বত কন্দরে অবস্থান করে, তথাপি সে পাপ কর্ম হইতে মুক্ত হইতে পারিবে না।  পূর্বদি দিক সমূহে জগতে যত প্রদেশ আছে, পৃথিবীতে যত স্থান আছে কোথাও কেশা গ্রমাত্র অবকাশ নাই, যেখানে অবস্থান করিয়া পাপ কর্ম হইতে মুক্তি পাওয়া যাইতে পারে। ”

 

যেমন পাপ তেমন ফল ভোগ করাই হইল কর্মের নিয়ম।  কর্ম নিয়মের বাহিরে কেহ নাই, ইহাই জগতের ধর্ম।  আমরা লক্ষ করিলে দেখিতে পাই, আমাদের চারি পাশে কত প্রাণী যে এই ভাবে পাপের ফল ভোগ করিতেছে, কিন্তু লোক তাহা জ্ঞাত নহে।  নির্বোধ ব্যক্তিরা পাপানুষ্ঠান কালে উহার ফল প্রাণীকে মারিয়া ফেলিবার নানা বিধ কর্ম বিপাক নিম্নে বর্ণনা করা হইল:

 

১।  এই জগতে যেই ব্যক্তি অন্যকে উপবাস রাখিয়া মরে, সে বহু লক্ষ বৎসর ক্ষুধা যন্ত্রণা ভোগা করে, ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়, শুল্ক ম্লান হৃদয় হয়।  তাহার দেহাভ্যন্তর শুষ্ক বিশুষ্ক, দগ্ধ হয় এবং বহু জন্ম অবধি বাল্য কালে, যৌবন কালে ও বৃদ্ধ কালে ক্ষুধা রোগেই মৃত্যু বরণ করে।

 

২।  যেই ব্যক্তি অপরকে পিপাসা যন্ত্রণায় মারে, সে বহু লক্ষ বৎসর নিধ্মামতৃষ্ণিক প্রেত হইয়া হীন, কৃশ, পরিশুষ্ক হৃদয়ে পিপাসারোগে মৃত্যু বরণ করে এবং বহু জন্ম পর্যন্ত মনুষ্য হইয়া পিপাসায় বাল্য কালে, যৌবন কালে ও বৃদ্ধাবস্থায় মারা যায়।

 

৩।  যেই ব্যক্তি অপরকে সর্প দ্বারা দংশন করাইয়া মারে, সে বহু লক্ষ বৎসর অজগরে মুখ হইতে অজগরের মুখে, কৃষ্ণ সর্পের মুখ হইতে কৃষ্ণ সর্পের মুখে পরিবর্তিত হইয়া বহু জন্ম পর্যন্ত সর্পাঘাতেই বাল্য কালে, যৌবন কালে, বৃদ্ধাবস্থায় মরিয়া থাকে।

 

৪।  যেই ব্যক্তি পূর্ব জন্মে অপরকে বিষ দিয়া মারে, সে বহু লক্ষ বৎসর শারীকি যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দগ্ধ হয়, ভাঙ্গিয়া যায়, শারীর হইতে পচা দুর্গন্ধ বায়ু প্রবাহিত হয় এবং বহু জন্ম অবদি বাল্য কালে, যৌবন কালে ও বৃদ্ধাবাস্থায় বিষক্রিয়া হইয়া প্রাণত্যাগ করে।

 

৫।  যেই ব্যক্তি পূর্ব জন্মে অপরকে অগ্নি দ্বারা জ্বালাইয়া মারে, সে বহু লক্ষ বৎসর অঙ্গার পর্বত হইতে অঙ্গার পর্বতে, যমালয় হইতে যমায়ে পরিবর্তিত হইয়া বহু  জন্ম অবধি বাল্য কালে, যৌবন কালে ও বৃদ্ধাবস্থায় অগ্নিতে দগ্ধ হইয়া মারা যায়।

 

৬।  যেই ব্যক্তি অপরকে জলে ডুবাইয়া মারে, সে বহু লক্ষ বৎসর পর্যন্ত হত, বিলুপ্ত, ভগ্ন, দুর্বল দেহ ও ক্ষোভিতচিত্ত হইয়া জলে ডুবিয়া বাল্য কালে যৌবন কালে বা বৃদ্ধ কালে মৃত্যু বরণ করে।

 

৭।  যেই ব্যক্তি শেল বা অস্ত্র দ্বারা অপরকে মারিয়া ফেলে, সে বহু লক্ষ বৎসর অস্ত্র দ্বারা ছিন্ন ভগ্ন কর্তিত বিকুটিত গাত্র হইয়া দুঃখ ভোগ করে এবং বহু জন্ম অবধি বাল্য কালে, যৌবন কালে ও বৃদ্ধাবস্থায় অস্ত্র দ্বারা মৃত্যু হয়।  অজ্ঞ, মূর্খ ব্যক্তি না জানিয়া প্রাণিহত্যা করিয়া নিজেকে জন্ম জন্মান্তরে কী ভীষণ দুঃখের মধ্যে নিক্ষেপ করে, তাহা ভাবিলেই ভয় উৎপন্ন হয়।  যত ক্ষণ পাপ কর্ম পরিপক্ব না হয় ততক্ষণ পাপী শুভ ও মঙ্গল দর্শন করে, কিন্ত পাপ কর্ম যখন পরিপক্ব হয় তখন পাপী অশুভ ও অমঙ্গল দেখিতে পায়।  অর্থাৎ পাপ কর্ম করিবার সময় পাপীরা পাপকে মধুর বলিয়া মনে করে, কিন্তু পাপ যখন বিপাক প্রদান করে তখন পাপীরা অসহ্য দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে।  তীক্ষ্ন ক্ষুরের ধারে মধুলেহন করিলে যেমন তাহা দুঃখের কারণ হয়, তেমনই প্রমত্ত ব্যক্তি আসাক্তির কারণে পাপ চরণকে মধুর মনে করে, যাহার কারণে জন্ম জন্মান্তরে দুঃখ ভোগ করে।  স্বকৃত পাপ কর্ম সদ্য দুগ্ধের ন্যায় সহসা বিনষ্ট হয় না, ভস্মাচ্ছন্ন অগ্নির ন্যায় উহা মূর্খকে দহন করিতে করিতে তাহার অনুসরণ করে।  অধর্মের দ্বারা মানুষ আপাতত সমৃদ্ধ হয়, কল্যাণের দেখা যায়, শত্রু দেরও জয় করে বটে, কিন্তু পরিণামে সমূলে বিনষ্ট হয়।

 

প্রাণিহত্যার পাঁচটি অঙ্গ প্রাণী হওয়া, প্রাণী বলিয়া জানা, হত্যার চেতনা, মারিবার উপত্রু ম ও সেই উপক্রমে মৃত্যু হওয়া এই পাঁচটি অঙ্গ পরি পূর্ণ থাকিলে প্রাণিহত্যা অপরাধে অপরাধী হইতে হয় বা প্রাণীহত্যার পাপ সম্পাদিত হয়। এই পাঁচটি অঙ্গের কোনো একটি কম হইলে তাহা প্রাণিহত্যার পর্যায়ে পড়ে না।  প্রাণিহত্যা না করিবার সুফল  দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুন্দর, সাবলীল, সুশ্রী, সৌষ্ঠবময়, মৃদু কোমল শুচি সুর বা মধুর ভাষী, মহাবল সম্পন্ন, বেগ শালী এবং সুলক্ষণ হয়।  রোগ ব্যাধি হীন জীবন ও জন্মে দীর্ঘায়ু লাভ হয়।  জলে ডুবে, দুর্ঘটনার কারণে, রোগের কারণে, হিংস্র প্রাণীর আক্রমণে কিংবা অন্য কাহারও দ্বারা কখনো মৃত্যু হয় না।  


অর্থাৎ অতীতে প্রাণিহত্যা না করাতে তাহাদের অকাল মৃত্যু হয় না এবং কেহ হত্যার চেষ্টা করিলেও হত্যা করিতে পারিবে না।  সকলেই তাহাদের প্রতি মৈত্রী ভাব পোষণ করে।  ইহা ব্যতীত তাহারা জন্ম জন্মান্তরে শোক হীন জীবন যাপন করেন, প্রিয় বিয়োগ দুঃখ ভোগ করিতে হয় না।  স্বামী স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ও বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে ভালোবাসা আজীবন ভঙ্গ হয় না, অটুট থাকে।  প্রভূত জ্ঞাতি মিত্র, বন্ধু বান্ধব ও মহৎ পরিবার সম্পন্ন হয়।  অন্ধ, খোঁড়া, বিকলাঙ্গ হয় না, দেহ খর্ব, বেঁটে খাটো কিংবা বামন প্রকৃতির হয় না, শরীর কৃশ চর্মসার অস্থিতুল্য না হইয়া সুস্বাস্থের অধিকারী হয়।  সকল বিষয়ে দক্ষ, সুশিক্ষিত ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয়।  প্রাণিহত্যা হইতে বিরতির এই রূপ সুফল জন্মে জন্মে লাভ হইয়া থাকে।  প্রাণী হত্যা কর্ম ফল সমাপ্ত।

 

Next Post
2 Comments
  • Udondi
    Udondi 9 March 2022 at 17:29

    shadu shadu

  • ab
    ab 9 March 2022 at 18:10

    sadhu sadhu sadhu

Add Comment
comment url