কর্ম ফল অবিশ্বাসী রাজা পায়াসী

 কর্ম ফল অবিশ্বাসী রাজা পায়াসী

রাজা পায়াসী ছিলেন কোশল রাজ প্রসেনজিত কর্তৃক স্বীকৃত সে তব্য নামক রাজ্যের রাজা।  এক সময় তাঁর মনে এমন এক পাপ দৃষ্টি উৎপন্ন হয়ে ছিল যে, তিনি বলতে শুরু করলেন প্রাণী হত্যায় কোন পাপ হয়না। চুরি করলে পাপ হয় তাও তিনি মানেন।  মিথ্যা বলতে অপরাধ তা তিনি বিশ্বাস করেন না।  ব্যাভিচার, সুরা গাজা বা নেশা করা পাপ এগুলি তিনি মান তে নারাজ।  তিনি বলতে লাগলেন পরলোক নাই।  ঔপপাতিক (অলৌকিক ভাবে জন্ম নেওয়া জীব) সত্ত্ব নাই।  সুকর্ম ও কুকর্মের ফল নাই।  কর্ম ফলে অবিশ্বাসী হয়ে তিনি দিন যাপন করে ছিলেন। 


আরো দেখুন: বুদ্ধের ১২টি কর্ম বিপাক


আরো দেখুন: শুভা


কর্ম ফল অবিশ্বাসী রাজা পায়াসী

কর্ম ফল অবিশ্বাসী রাজা পায়াসী

সেই সময়ে অরহত “কুমার কস্যপ” তাঁর পাঁচ শত শিষ্য সহ কোশল দেশে ভ্রমণ করতে করতে রাজা পায়াসীর রাজ্য সেত বার উত্তরে সিংসপ নামক রাজ উদ্যানে এসে উপস্থিত হয়ে এক বৃক্ষ মূলে ধ্যানস্থ হলেন।  সশিষ্য কুমার কস্যপের অবস্থানে কয়েক জন করে করে বিপুল সংখ্যক লোক উপস্থিত হলেন এবং তাঁর কাছ থেকে ধর্ম বাণী শ্রবণ করে ছিলেন।  রাজা পায়াসী এই সংবাদ পেয়ে সপরিষদ সেখানে উপস্থিত হলেন।  যথা যোগ্য সম্মান প্রদর্শন পূর্বক অরহত কুমার কস্যপকে তাঁর বহু দিনের মনের মধ্যে উৎপন্ন বিষয় গুলি নিয়ে প্রশ্ন করে বললেন, হে সন্ন্যাসী আপনারা মানুষকে উপদেশ।

 

দিচ্ছেন যে পর কালের অস্থিত্ব আছে উপ পাতিক সত্ত্ব আছে, সুকর্ম ও দুষ্কর্মের ফল আছে কিন্তু আমি তাঁর কোনটা বিশ্বাস করিনা।  আমি যে দৃষ্টি পোষণ করে থাকি সেটা হল শুভ হোক বা অশুভ হোক কর্মের কোন ফল নাই।  পরলোক নাই ঔপপাতিক কোন সত্ত্ব নাই তখন কুমার কস্যপ রাজাকে বললেন, হে রাজন এরূপ মতও দৃষ্টি সম্পন্ন আমি তো কাউকেও দেখি নাই।  এগুলিতো জগতের সত্য।  এখন আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি এই যে চন্দ্র ও সূর্য ইহারা কি ইহলোকে অথবা পরলোকে? ইহারা দেব অথবা মনুষ্য? রাজা বললেন, হে সন্নাসী চন্দ্র ও সূৰ্য্য পরলোকে, ইহলোকে নয় তাহারা দেব, মনুষ্য নয়।

 

তা হলে হে রাজন ইহা হইতে আপনার সীদ্ধান্ত নেয়া উচিত পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, কর্মের ফল আছে, শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসী আপনি যাই বলুন আমি কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না। কুমার কস্যপ বললেন হে রাজন এমন কোন প্রমাণ আছে কি যার বলে আপনি বলিতে ছেন উহাদের অস্থিত্ব নাই? রাজা বলণেন প্রমাণ আছে।  সন্ন্যাসী প্রমাণ চাইলে রাজা বলতে লাগলেন আমার রক্তের সম্পর্কের মধ্যে আমর অত্যন্ত প্রিয় জন আত্মীয় ও জাতিৰ্গ ছিলেন যারা প্রাণী হত্যা, চুরি, মিথ্যা, ব্যাভিচার, সুরা পান ও পরুষ বাক্য।  উচ্চারণ করতেন।  

 

তুচ্ছ প্রলাপে রত, লোভ পরায়ণ ঘেষ যুক্ত চিত্ত ও মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন।  তাদের অনেকের মৃত্যু কালীন সময়ে আমি আমার এই জ্ঞাতিদের শয্যা পাশে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে বলে ছিলাম।  হে আমার প্রিয় জ্ঞাতিবর্গ সাধু সন্নাসীদের বচন যদি সত্য হয় তা হলে সেই অনুযায়ী আপনার জীবদ্দশায় সেই সমস্ত অপরাধ করেছেন।  আপনাদের নরক গমন অবশ্যম্ভাবী। আপনাদের কৃত কর্মের অপরাধে যদি আপনারা নরকে পতিত হন, আমি আপনাদের রক্তের সর্শকের উত্তরাধিকারী হিসাবে আমার মঙ্গলের জন্য আপনারা সেই নরকের যন্ত্রণা বা তাঁর দশ্যাবলী আমাকে নিজে এসে বা দূত মার ফত অবহিত করবেন। 

 

যাতে আমি আমার চরিত্র সংশোধনের মাধ্যমে অপ কর্ম থেকে বিরত থাকি।  তাহারা যদিও বা আমাকে জানাবেন বলে প্রতি শ্রুতি দিয়ে ছিলেন কিন্তু অদ্যা বদি কিছুই জানায়নি বা কোন দূত ও প্রেরণ করেননি।এতে করে আমি বুঝতে পারলাম যে, পরলোক নাই, ঔপপাতিক কোন সন্তু নাই, সুকর্ম ও কুকর্মের কোন ফল নাই।  কাজেই আমি কর্ম ফল বিশ্বাস করি না।  কুমার কস্যপ বললেন, হে রাজন আমি আপনাকে বিষয়টি একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝাতে চাই।  উপমা দ্বারা কোন কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি কথিত বাক্যের অর্থ বুঝতে সক্ষম হন।

 

ধরুন, আপনার রাজ্যে একজন ভয়ানক দুর্ধর্ষ অপরাধী ধরা পড়ল তাকে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করলেন।  আপনার কর্ম চারীরা তাকে হত্যার জন্য বধ্য ভূমিতে নিয়ে গেল।  ঘাতকেরা তাকে শিরচ্ছেদ করার পূর্ব মুহূর্তে সে যদি বলে হে ঘাতক বন্ধুরা আপনারা একটু অপেক্ষা করুন।  অমুক গ্রামে আমার এক রক্তের সম্পর্ক আত্মীয় আছে।  অমুক নিগমে আমার কিছু জ্ঞাতি আছে। আমি তাদের সাথে একটু দেখা করে আসী।  সেই পর্যন্ত আপনারা অপেক্ষা করুন।  আপনি কি অপরাধীকে সেই সুযোগ দিবেন?

 

না সন্ন্যাসী তাকে সেই অনুমতি দেওয়া হবে না কারণ সে এক বার যদি সেই সুযোগ পায় আর ফিরে আসবে না পলাতক হয়ে যাবে।  তাঁর শিরচ্ছেদ ঘাতকেরা করবেই। মহারাজ অপরাধী মনুষ্য হয়েও যদি মনুষ্য ভূত ঘাতকদের নিকট হইতে ঐরূপ অনুমতি লাভ না করে তাহলে আপনার জ্ঞাতি গণ নরকে উৎপন্ন হয়ে নরক পালগণের নিকট হইতে ঐরূপ অনুমতি কি রূপে প্রাপ্ত হবে।  নরক গমন হয়েছে এটা সত্য।  কিন্তু আপনাকে এসে নরকের বর্ণনা দেওয়ার যেই প্রতি শ্রুতি দিয়ে ছিলেন নরকের অসহ্য যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তারা আপনার কথা স্মরণ করার কোন সুযোগ মিলছেনা।

 

রাজা বললেন আপনি যাই বলুন না কেন এ বিষয়ে আমার এই মত পরলোক নাই, ঔপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকর্ম ও দুষ্কর্মের কোন ফল নাই।  হে রাজন এমন কোন কারণ আপনি দেখাতে পারবেন কি যার জন্য আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্থিত্ব নাই? রাজা আবার প্রমান করার চেষ্টা করলেন আমার জাতি গণের মধ্যে কেহ কেহ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক তাহারা প্রাণ বধ, অদত্তেয় বস্তু গ্রহণ, ব্যাভিচার, মিথ্যা ভাষণ পৌরুষ ও তুচ্ছ প্রলাপে রত হতেন না।  তাহারা ছিলেন লোভ দ্বেষ ও মোহ মুক্ত আপনাদের বাক্য যদি সত্য হয় তাহলে আমার ঐ জ্ঞাতি গণ নিশ্চয় স্বর্গ বাসী হবেন।

 

তাদের মৃত্যু কালীন সময়ে আমি অত্যন্ত বিনীত ভাবে তাদেরকে বলে ছিলাম আপনারা আমার মঙ্গল কামী জ্ঞাতি এবং পরম আত্মীয়।  সাধু সন্ন্যাসীদের বাক্য অনুযায়ী আপনারা কখনও প্রাণী বধ, চৌয্য বৃত্তি, মিথ্যা বাক্য, নেশা পান, ব্যাভিচার বা পৌরুষ বাক্য উচ্চারণ করেননি, লোভ দ্বেষ মোহ হয়ে জীবন ধারণ করেছেন, মিথ্যা দৃষ্টি সম্পন্ন হন নাই। মৃত্যুর পরে আপনারা সুগতি স্বর্গ লোকে উৎপন্ন হবেন এতে কোন সন্দেহ নেই।  

 

যদি আপনাদের স্বর্গে গমন হয় তাহলে আপনারা আমার প্রতি অনুকম্পা বশতঃ স্বর্গে অবস্থানের কথা আমাকে দূত মার ফত অথবা নিজেরা এসে জানালে আমিও সেই অনুযায়ী আমার জীবনকে পরিচালিত করব।  তারা আমাকে বলবেন বা জানাবেন বলে প্রতি শ্রুতি প্রদান করলেও অদ্যা বধি কোন সংবাদ প্রেরণ করেন নাই যার ফলে আমি বুঝতে পারলাম যে, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, কুশলা কুশল কর্মের কোন ফল নাই। 

 

মহা রাজ আমি একটি উপমা দিতেছি, আপনি বুঝবার চেষ্টা করুন, ধরুন আপনি রাজ দর বারে যাবার সময় পথি মধ্যে দেখলেন যে একজন লোক মল কুপে আশীর্ষ নিমজ্জিত, আপনি লোকটির প্রতি সহানুভূতি শীল হয়ে আপনার কর্ম চারীদের নির্দেশ দিলেন এই মূহুত্বে তাকে মল কুপ থেকে উদ্ধার করে সুগন্ধি জল ও সাবান দ্বারা ৩ বার ধৌত করে রাজকীয় সুগন্ধি দ্রব্যাদি তার গায়ে মুদ্রিত করে সূক্ষ্ম চর্ণ সহকারে উত্তম রূপে ৩ বার স্নাত করে কেশ ও শশ্রুর বিন্যাস সাধন করত মহার্ঘ মালা।

 

বিলেপন ও উত্তম বস্ত্রাদি দ্বারা ভূষিত করে শুভ্র বস্ত্র পরিধান করিয়ে প্রসাদস্থিত পঞ্চ ইন্দ্রিয় ভোগ্য পরিবেশন ও সেবা দান করে, এমতাবস্থায় লোকটি কি পুনরায় সেই মল কুপে নিমগ্ন হতে চাইবে? রাজা বললেন চাইবেন না।  কারণ মল কুপ অশুচি দুর্গন্ধ ময় ও ঘৃণিত। হে রাজন এই রূপে মনুষ্যগণ দেবগণের নিকট অশুচি দুর্গন্ধ ময় ও ঘৃণিত।  শত যোজন দূর হইতেও মনুষ্য গন্ধ দেবগণ কর্তৃক অনুভূত হয়। মহা রাজ আপনার জ্ঞাতি বর্গদের মধ্যে যারা শীল সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলন দ্বারা সর্বদা কুশল কর্ম সম্পাদন ও অকুশল কর্মকে বর্জন করে ছিলেন তারা অবশ্যই স্বর্গে গমন করেছেন। 

 

মনুষ্য ভূমি তাদের জন্য সুখকর নয় বিধায় আপনাকে সংবাদ দিতে আসতে চাইছে না।  এ ছাড়াও মনুষ্য গণের ১০০ বছরে তাবতিংস দেবগণের ১ দিন রাত।  তারা যদি মনে করে আমরা দুই এক দিন স্বর্গ সুখ ভোগ করে রাজা পায়াসীর নিকট আমাদের স্বর্গে অবস্থানের সংবাদটা প্রেরণ করব।  ২ দিন পরে মনুষ্য লোক ২০০ বছর হয়ে যাবে তখন আপনার বেঁচে থাকার কথা নয়।  রাজা পায়াসী অরহত কুমার কস্যপকে বললেন এয়োত্রিংশ দেবলোক আছে বা ঐ দেবতাগণ দীর্ঘায়ু আপনার সেই কথাও আমি বিশ্বাস করি না।

 

অরহত কস্যপ আরও অনেক উদাহরণ।  উপস্থাপন করে রাজাকে বললেন মহা রাজ আপনি যেরূপ মনে করিতেছেন সেরূপ মাংস চক্ষু দ্বারা পরলোক দর্শন সম্ভব নয়।  যে সকল শ্রমণ ব্রাহ্মণ অরণ্যে বৃক্ষ মূলে শব্দ হীন সুদূর বন প্রস্থে বাস করেন তাহারা অমানুষী বিশুদ্ধ দিবা চক্ষু দ্বারা ইহলোক পরলোক এবং ঔপপাতিক সত্ত্ব দর্শন করেন সুতারাং মহা রাজ পাপ দৃষ্টি পরিহার করুন।  উহা যেন দীর্ঘ কাল আপনার দুঃখ দুর্দশার কারণ না হয়।

 

রাজা পায়াসী অরহত কুমার কস্যপের পদ তলে পতিত হয়ে বললেন, হে প্রভূ আপনার প্রথম উপদেশেই আমি সব কিছু বুঝতে সক্ষম হয়েছি তবু আরও অধিক বিষয় জ্ঞাত হবার জন্য আপনাকে এত গুলি প্রশ্ন করে আপনার বিরক্তি উৎপাদন করেছি আমাকে ক্ষমা করুন।  আমি আজ থেকে আমার দৃষ্টি ভঙ্গির ও পূর্বের ধারণা মন থেকে মুছে ফেলে সঙ্কর্ম সম্পাদনে সচেষ্ট হব।  অতঃ পর সন্নাসী কুমার কস্যপকে শিষ্য সহ রাজার বাড়ীতে পর দিন আহার গ্রহণের জন্য ফাং করলেন।  পায়াসী রাজা মিথ্যাদৃষ্টি কথা সমাপ্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url