বোধি সন্ধের অন্বেষণ

 

বোধি সন্ধের অন্বেষণ

আলাড় এবং উদ্ৰক ব্রাহ্মণ দিগের মধ্যে অধ্যাপক বলিয়া খ্যাত ছিলেন।ঐ সময়ে বিদ্যাবত্তায় এবং দর্শনতত্ত্ব জ্ঞানে তাহাদের উচ্চে কেহই ছিল না।  বোধিসত্ত্ব তাঁহাদের নিকট গিয়া তাহাদের চরণ সমীপে উপবেশন করিলেন।  তাহাদের মতে আত্মা মনের চালক এবং সর্ব কর্মের কারক।  


আত্মার পুনর্জন্ম গ্রহণ এবং কর্ম ফল সম্বন্ধে তাহাদের মত তিনি শুনিলেন; আর শুনিলেন, কেমন করিয়া অসৎ মানুষের আত্মা নীচ জাতিতে কিম্বা জন্তু রূপে কিম্বা নরকে পুনর্জন্ম লইয়া কষ্ট পায়; তর্পণ, যজ্ঞাদি এবং আত্ম নিগ্রহ দ্বারা পবিত্র দেহ মানুষ উচ্চ হইতে উচ্চতর জন্ম লাভ করি বার জন্য কেমন করিয়া রাজ কুলে কিম্বা ব্রাহ্মণ কিম্বা দেব কুলে জন্ম গ্রহণ করে। 


আরো দেখুন: উরুবিল্ব


আরো দেখুন: নৃপতি বিম্বিসার

 

বোধি সন্ধের অন্বেষণ

বোধি সন্ধের অন্বেষণ

তিনি তাহাদিগের মন্ত্রাদির এবং দেবোদ্দেশে দেয় অর্ঘ্যদির ও যে প্রকারে প্রহর্ভাবস্থায় আত্মা পার্থিব জন্ম হইতে মুক্তি লাভ করে তাহার বিষয় আলোচনা করিলেন।  আরাদ কহিলেন, “স্পর্শ, ঘ্রাণ, আস্বাদ, দর্শন ও শ্রবণ শক্তি রূপ মনের পঞ্চমুলের ক্রিয়া কে যে অনুভব করে সে অনুভবক কি?  হস্তের গতি এবং পদের গতি এই দ্বিবিধ গতির যে প্রবর্তক সে কি? আমি কহিতেছি, ‘আমি জানি এবং অনুভব করি, আমি আসি’ এবং আমি যাই’ কিম্বা “'আমি এই খানে থাকিব এই সমস্ত বাক্যে আত্মার সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থিত হয়।  


তোমার আত্মা তোমার দেহ নয়; উহা তোমার চক্ষু নয়, তোমার কর্ণ নয়, নাসিকা নয়,  জিহ্বা নয়; উহা তোমার মনও নয়।  তোমার শরীরে যে স্পর্শ অনুভব করে, সেই ‘আমি।’ ঐ ‘আমি’ই নাসিকায় ঘ্রাণকর্তা, জিহ্বায় আস্বাদকর্তা, চক্ষুতে দর্শনকর্তা, কর্ণে শ্রবণ কর্তা এবং মনে চিন্তাকর্তা।  ঐ ‘আমি তোমার হস্ত ও পদ চালিত করে।  

 

ঐ ‘আমি তোমার আত্মা আত্মার অস্তিত্বে সন্দিহান হওয়া ধর্ম বিরুদ্ধ, এবং এই সত্য স্বীকার না করিলে মুক্তি নাই অতিশয় অনুধ্যানে সহজেই মন আচ্ছন্ন হয়; ইহার পরিণতি।  বুদ্ধি বিক্বতি ও অবিশ্বাস।  কিন্তু আত্মার শুদ্ধি মুক্তির মাৰ্গ।  লোকালয় হইতে দূরে সন্ন্যাসীর জীবন যাপনে এবং খাদ্যের জন্য সম্পূর্ণ রূপে ভিক্ষার উপর নির্ভর করিলে প্রকৃত মুক্তি লাভ হয়। সর্ব বসনা দূরে রাখিয়া এবং বাহ পদার্থের নাস্তিত্ব সর্বনা হৃদয়ঙ্গম করিয়া আমরা পূর্ণ শূন্যতায় উপনীত হই।  


এই অবস্থা আমরা অশরীরী জীবনের ধর্ম অবগত হই।  শৃঙ্খলময় আবরণ বইতে মুক্ত মুজা তৃণের স্থায়, কিম্বা বন্য পক্ষী যে রূপ পিঞ্জর হইতে পলায়নপর হয়, সেই রূপ আত্মাও সর্ব বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সর্বাঙ্গীন মুক্তি লাভ করে।  ইহাই প্রকৃত মুক্তি; কিন্তু যাহাদের বিশ্বাস আছে, মাত্র তাহারাই ইহা অনুভব করিবে। ”

 

বোধিসত্ত্ব এই উপদেশে সন্তুষ্টি লাভ করিলেন না।  তিনি উত্তর করিলেন, “মনুষ্য দাসত্বের অধীন, যে হেতু সে এখনও ‘আমি’র সংস্কার দূর করিতে পারে নাই।  “বস্তু এবং তাহার গুণ বিভিন্ন, আমরা এই রূপ মনে করি, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাহা নয়।  উত্তাপ অগ্নি হইতে বিভিন্ন, ইহা আমরা কল্পনা করি, কিন্তু বস্তুত: অগ্নি হইতে উত্তাপকে পৃথক করা যায় না।  আপনার মতে বস্তু হইতে তাহার গুণ সমূহ কে পৃথক করা সম্ভব, কিন্তু এই মত বাদ যদি শেষ পর্যন্ত বিচার করা যায়, তাহা হইলে ইহার অসত্য তা প্রমাণিত হইবে।  


“মানুষ কি বহু সমষ্টি সম্পন্ন জীব নহে? আমাদের ঋষিরা যে রূপ কহিয়া থাকেন, আমরা কি সেই রূপ বহু বিধ স্কন্ধ বিশিষ্ট নহি? মানুষ রূপ, সম্বিত্তি, মনন, প্রবৃত্তি, এবং সর্ব শেষে, বুদ্ধি সমন্বিত।  মানুষ যখন ‘আমি আছি’ এই কথা বলে, তখন সে যাহাকে আত্মা আখ্যা দিয়া থাকে, তাহা স্কন্ধ সমূহ হইতে বিভিন্ন কোন প্রকৃত পদার্থ নহে; স্কন্ধ সমূহের সহযোগিতায় ইহার উৎপত্তি।

 

মন রহিয়াছে; সম্বিক্তি এবং মনন রহিয়াছে, সত্য রহিয়াছে; মন যখন ন্যায় ধর্ম মার্গাবলখী হয় তখন সত্যে পরিণত হয়।  কিন্তু মন হইতে বিভিন্ন এবং স্বতন্ত্র কোন আত্মা নাই।  আত্মা একটি স্বতন্ত্র সন্তা, ইহা যিনি বিশ্বাস করেন, তিনি বস্তু সমূহের প্রকৃত স্বরূপ অবগত নহেন।  আত্মনের অনুসন্ধানই অযুক্ত।  


ইহা ভিত্তি হীন এবং ভ্রান্ত পথ প্রদর্শী।  আমাদের স্বার্থান্বেষণে এবং ‘আমি কত মহৎ’ কিম্বা ‘আমি এই অত্যাশ্চর্য কার্য সম্পন্ন করিয়াছি, এই সকল চিন্তাজনিত আত্ম গরিমায় কত না বুদ্ধি বিপর্যয় ঘটিয়া থাকে? তোমার বিবে কী মনুষ্য প্রকৃতি এবং সত্যের মধ্যে তোমার ‘আমি’র কল্পনা ব্যব ধান সৃষ্টি করিতেছে, এই কল্পনা দূর কর; তুমি বন্ধুর প্রকৃত স্বরূপ দেখিতে পাইবে।  


যিনি প্রকৃত প্রণালীতে চিন্তা করেন, তিনি অবিদ্যা দুর করিয়া জান লাভ করিবেন।  ‘আমি আছি’ এবং আমি থাকিব’ কিম্বা ‘আমি থাকিব না’ এই সকল কল্পনা তীক্ষ্ণ চিন্তা শীলের মনে উদয় হয় না।

 

“অধিকন্তু, যদি তোমার আত্মা অবশিষ্ট থাকে, তুমি কি প্রকারে যথার্থ মুক্তি লাত করিবে?  যদি আত্মাকে পুনর্জন্ম গ্রহণ করিতে হয় তাহা স্বর্গেই হউক, কিম্বা মর্তেই হউক, কিম্বা নরকেই হউক, তাহা হইলে আমাদিগকে সেই একই অনিবার্য নিয়তি সত্তার অধীন হইতে হইবে। আমরা অহঙ্কার এবং পাপে জড়িত হইব।  


“সংযোগ মাত্রই বিপ্রয়োগের অধীন; জন্ম, ব্যাধি, বার্ধক্য এবং মৃত্যু হইতে পরিত্রাণ নাই।  ইহা কি চরম মুক্তি?” উদ্ৰক কহিলেন, “তুমি কি সর্বত্র কর্ম ফল প্রত্যক্ষ করিতেছ না? মনুষ্য কি প্রকারে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র, পদ, অধিকার ও অদৃষ্ট লাভ করে? তাহারা স্বীয় কর্ম দ্বারা এ সমুদয় লাভ করে; সুকৃতি এবং দুস্কৃতি কর্মের অন্তর্ভূক্ত। 


আত্মার পুনর্জন্ম তাহার কর্মাধীন।  আমরা পূর্বজন্ম হইতে দুষ্কৃতির কুফল এবং সুকৃতির সুফল প্রাপ্ত হইয়া থাকি।যদি তাহা না হয়, তাহা হইলে মনুষ্য বিভিন্ন প্রকারের কেন হইবে?” তথাগত পুনর্জন্ম এবং কর্ম রহস্য গভীর ভাবে ধ্যানের বিষয়ী ভূত করিয়া উহাদের অন্তর্নিহিত সত্য আবিষ্কার করিলেন।

 

তিনি কহিলেন, “কর্ম বাদ অবশ্য স্বীকার্য, কিন্তু আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আপনার মত বাদের কোন ভিত্তি নাই।  “বিশ্বের সকল বস্তুর ন্যায়, মনুষ্য জীবনও কার্য কারণ রূপ নিয়মের অধীন। অতীতে যাহা রোপিত হয় বর্তমানে তাহাই সংগৃহীত হয়; ভবিষ্যৎ বর্তমান হইতে উদ্ভূত হয়। কিন্তু আত্মা রূপ কোন অপরিবর্তন শীল সত্তার, যে সত্তা চির কাল সম ভাবে থাকিয়া দেহ হইতে দেহান্তর আশ্রয় করে, সে রূপ সত্তার প্রমাণ নাই।  


“আমার যে ব্যক্তিত্ব তাহা কি ভৌতিক ও মানসিক সমবায় বিশেষ নহে? ইহা কি ক্রম বিবর্তন হইতে উদ্ভূত গুণ বিশেষের সমষ্টি নয়? মনুষ দেহে বাহ্নবস্তুর জ্ঞানের পঞ্চ মূল আমরা পূর্ব পুরুষ গণ হইতে প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহারা উহাদের ক্রিয়া সম্পাদন করিয়াছেন।  


যে সকল চিন্তা আমার মনে উদয় হয়, তাহাদের কিয় দংশ আমি অপরের নিকট হইতে পাইয়াছি, তাহাদের মনেও ঐ সকল চিন্তার উদয় হইয়াছিল; এবং কিয় দংশ আমার নিজের মনে ঐ সকল চিন্তার সংযোগে উৎপন্ন।  

 

আমার বর্তমান ব্যক্তিত্ব সৃষ্ট হইবার পূর্বে যাহারা আমার ন্যায় একই প্রকার ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার করিয়াছেন এবং একই প্রকার চিন্তা করিয়াছেন তাহারাই আমার পূর্বজন্ম; তাঁহারাই আমার পূর্ব পুরুষ, যেমন কল্যকার ‘আমি’ অদ্যকার ‘আমি’র জনক। 


আমার বর্তমান জন্মের অবস্থা অতীত কর্মের অধীন। “যদি মনে করা যায় আত্মই ইন্দ্রিয় সমূহের কর্ম সম্পাদন করেন, তাহা হইলে যদি দৃষ্টির কারক চক্ষু কে ছিন্ন ও উৎপাটিত করা যায়, আত্ম অপেক্ষা কৃত বৃহৎ ছিদ্র সাহায্যে চতুঃপার্শ্বস্থ বস্তু সমূহ আরও স্পষ্ট রূপে দেখিতে পাইবেন।  


যদি কৰ্ণ মূল বিনষ্ট করা যায়, তাহা হইলে তাহার শ্রবণ শক্তি আরও অধিকতর হইবে; যদি নাসিকা বিচ্ছিন্ন হয়, তাহার ঘ্রাণ শক্তি প্রখরতর হইবে; যদি জিহবা উৎপাটিত হয়, তাহার স্বাদ শক্তি বৃদ্ধি পাইবে; যদি দেহ বিনষ্ট হয়, তাহার অনুভব ক্ষম তা তীক্ষ্ণতর হইবে।

 

“মনুষ্য প্রকৃতির সংরক্ষণ এবং বংশ পরম্পরায় তাহার সঞ্চারণ আমি দর্শন করিতেছি, কিন্তু আপনার মত বাদ কর্ম সমূহের কারক বলিয়া যাহার প্রতিষ্ঠা করিতেছে, সে রূপ আত্মনের কোন সন্ধান আমি পাইতেছি না! পুনর্জন্ম আছে, কিন্তু তাহা আত্মার নয়।  


কারণ ‘আমি বলিতেছি” এবং “আমি কবিব’ ইহার মধ্যে যে আত্মা কল্পিত হয় তাহা অলীক।  যদি ইহা প্রকৃত বন্ধ হয়, তাহা হইলে কি প্রকারে এই আত্মত্ব হইতে মুক্তি লাভ হইবে? ইহাতে নরকের ত্রাস অনন্ত এবং মুক্তি অসম্ভব।  


ইহা সত্য হইলে সত্তাজনিত অহিত, অবিদ্যা ও পাপ সম্ভুত নয়, ঐ অহিত সমূহ সত্তার স্বরূপ।” তৎপরে বোধিসত্ত্ব দেব মন্দিরে পূজানিত পুরোহিত দিগের নিকট গমন করিলেন। কিন্তু দেবতা দিগের বেদীতে যে রূপ অনাবশ্যক নিষ্ঠুরতা সম্পাদিত হইতে ছিল, তাহা দেখিয়া তিনি ক্ষুন্ন হইলেন।  

 

তিনি কহিলেন: “যজ্ঞের জন্য এই উৎসব এবং বিশালজনতার সৃষ্টিরমূলে এক মাত্র অবিদ্যা।  রক্তপাত করিয়া দেবসমূহের প্রতি উৎপাদনের চেষ্টা অপেক্ষা সত্যের সম্মান সহস্র গুণে শ্রেয়। “যেমানুষ জীব হত্যার দ্বারা কুকর্মের ফল হইতে মুক্ত হইতে চায়, তাহার মধ্যে মৈত্রী কি প্রকারে থাকিতে পারে? এক দুস্কৃতি কি অন্যকে ক্ষালন করিতে পারে? নিরপরাধী প্রাণীর হত্যা সাধন করিয়া কি মানুষ পাপমুক্ত হইতে পারে ? ইহাধর্ম সাধন হইতে পারে, কিন্তু ইহাতে নৈতিক আচরণ অবহেলিত হয়। 


“অন্তঃকরণ বিশুদ্ধ কর, প্রাণনাশ করিও না; ইহাই সত্য ধর্ম।  “শাস্ত্রীর অনুষ্ঠান পদ্ধতি; প্রার্থনা বৃথা আবৃত্তি মাত্র; মন্ত্রোচ্চারণ কাহাকও রক্ষা করিতে পারে না।  লোভ ও লাল সার বর্জন, রিপু সমূহের পভাব হইতে মুক্তি এবং সর্ব প্রকার দ্বেষ ও হিংসার দূরী করণ, ইহাই প্রকৃত যজ্ঞ, ইহাই প্রকৃত পূজা। ” বোধিসন্ধের অন্বেষণ সমাপ্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url