নৃপতি বিম্বিসার

 নৃপতি বিম্বিসার

সিদ্ধার্থ তাহার দীর্ঘ কেশ রাশি কাটিয়া ফেলিয়া ছিলেন এবং রাজকীয় বেশ ভূষা পরিত্যাগ পূর্বক মৃত্তিকা বর্ণ সামান্য পরিচ্ছদ গ্রহণ করিয়া ছিলেন। স্বীয় সংসার ত্যাগের সংবাদ শুদ্ধোদনের নিকট বহন করিবার জন্য তিনি বিশ্বস্ত অশ্ব কন্টকের সহিত সারথী ছন্নকে প্রেরণ করিলেন এবং স্বয়ং ভিক্ষা পাত্র হন্তে রাজ পথে বিচরণ করিতে লাগিলেন। 


তথাপি বাহ্নিক দারিদ্র্য তাহার উন্নত চিত্তকে লুক্কায়িত করিতে পারে নাই। তিনি যে রাজ বংশ প্রসূত, তাহার উন্নত চলন ভঙ্গী তাহা ঘোষণা করিতে ছিল, তাহার উজ্জ্বল চক্ষু সত্যান্বেষণের দৃঢ় কামনা প্রকাশ করিতে ছিল। পবিত্র তা জ্যোতির্মগুলের ন্যায় তাহার মস্তককে বেষ্টন করিয়া তাহার যৌবনের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করিয়া ছিল। জনগণ এই অসাধারণ দেবোপম মুর্তি দেখিয়া বিস্ময়ে এক দৃষ্টে তাহার দিকে চাহিতে লাগিল।


আরো দেখুন: বোধি সন্ধের অন্বেষণ


আরো দেখুন: বোধিসত্বের সংসার ত্যাগ


নৃপতি বিম্বিসার

 নৃপতি বিম্বিসার

যাহারা দ্রুত গতিতে চলিতে ছিল তাহারা গতি মন্দ করিয়া পশ্চান্দিকে চাহিল; সর্ব জন তাঁহার পূজা করিল। রাজ গৃহ নগরে প্রবেশ করিয়া রাজ পুত্র দ্বারে দ্বারে আহার্যের জন্য নীরবে অপেক্ষা করিলেন। মহা পুরুষ যেখানেই গমন করিলেন সেই খানেই নাগরিক গণ। 


তাহাকে যথা সম্ভব দান করিল; তাহারা বিনীত হইয়া তাহার সম্মুখে মস্তক নত করিল ও তিনি যে ক্বপা করিয়া তাহাদের গৃহে আগমন করিয়াছেন তজ্জন্য কৃতজ্ঞতায় অভি ভূত হইল। বৃদ্ধ ও তরুণ সকলেই বিচলিত হইয়া কহিল, “ইনি মহা মুনী! ইহার আগমন শুভ সূচক, আমাদের কি আনন্দ!” নৃপতি বিশ্বসার নগরে আন্দোলন অবলোকনে অনুসন্ধানে কারণ অবগত হইয়া জনৈক রাজ ভৃত্যকে নবাগতের সেবায় নিযুক্ত করিলেন।


মুনি উচ্চবংশসত শাক্য এবং ভিক্ষা পাত্রে আহার করি বার জন্য তিনি নদী তীরস্থ অরণ্যে প্রবেশ করিয়া ছিলেন শুনিয়া রাজার হৃদয় বিচলিত হইল। তিনি রাজ বেশ পরি ধান এবং শিরে স্বর্ণ মুকুট স্থাপন করিয়া জ্ঞানী ও বয়ো বৃদ্ধ মল্লি গণের সমভিব্যাহারে গভীর রহস্য জনক আগন্তুককে দর্শন করিতে চলিলেন। নৃপতি দেখিলেন শাক্য বংশোদ্ভুত মুনি বৃক্ষ তলে উপবিষ্ট। 


তাহার প্রশান্ত মুখ মণ্ডল এবং বিনয়া বনত আচরণ অবলোকন করিয়া বিম্বিসার সম্মান সহকারে তাহার অভ্যর্থনা করিয়া কহিলেন: “শ্ৰমণ, তোমার হস্ত সাম্রাজ্যের রশ্মি গ্ৰাস করি বার উপ যুক্ত, উহা ভিক্ষু কের ভিক্ষা পাত্র বহন করি বার জন্য নয়, তোমার তারুণ্য হেতু আমার মনে করুণার সঞ্চার হইতেছে।

  


তুমি রাজ বংশ সস্তৃত বোধ হইতেছে, যদি তাহা না হইত তাহা হইলে আমার রাজ্য শাসনে তোমাকে আমার প্রতি নিধি হইতে অনুরোধ করিতাম। যাহারা উচ্চ অন্তঃকরণ শালী, শক্তির প্রয়াসী হওয়া তাহাদের পক্ষে গৌরব জনক; ধন সম্পদ ঘৃণ্য বস্তু নহে। ধর্ম ভ্রষ্ট হইয়া ধন শালী হওয়া যথার্থ লাভ নহে, কিন্তু যিনি শক্তি, ধন ও ধর্ম তিনেরই অধিকারী এবং এই ত্রিবিধ সম্পদকে যিনি বিমৃশ্যকারিতা ও প্রজ্ঞা সহকারে উপভোগ করেন আমি তাহাকে মহৎ শিক্ষক বলিব।” 


মহামান্য শাক্য মুনি চক্ষু উত্তোলন করিয়া উত্তর করিলেন, “রাজন, উদার ও ধর্মজ্ঞ বলিয়া আপনার খ্যাতি আছে, আপনার বাক্য জ্ঞান গর্ভ। যে দয়া পরবশ ব্যক্তি ধনের সদ ব্যবহার করে সেই ধন ভাণ্ডারের অধিকারী; কিন্তু যে কৃপণ কেবল মাত্র ধন সঞ্চয় করে, সে লাভ বান হইবে না।


“দানের যথেষ্ট পুরস্কার আছে; দান সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ধন, যে হেতু যদিও বিতরণই ইহার কাজ তথাপি ইহা অনুতাপ আনয়ন করে না। “আমি মুক্তি প্রার্থী হইয়া সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়াছি সংসারে পুনঃ প্রবেশ আমার পক্ষে কি প্রকারে সম্ভব? যিনি সর্বোত্তম ধন সত্যানুসন্ধানে রত, তিনি সর্ব প্রকার চিত্ত বিচলিত কারী উদ্বেগ বিসর্জন দিয়া ঐ এক মাত্র লক্ষ্য অনুসরণ করিবেন।


তিনি লোভ, কাম ও প্রভুত্বের বাসনা হইতে নিজেকে মুক্ত করিবেন। “বাসনাকে বিন্দু মাত্র প্রশ্রয় দিলেই শিশুর ন্যায় তাহার কলেবর বর্ধিত হইবে। পার্থিব ক্ষম তার ব্যবহার উদ্বেগ আনয়ন করে।  “অন্তরের পবিত্র তা রাজ্য সম্পদ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, স্বর্গবাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, এবং সর্ব জগন্তের উপর প্রভুত্বের অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। 


“বোধিসত্ত্ব পার্থিব সম্পদের ক্ষণ স্থায়িত্ব উপলব্ধি করিয়াছেন। তিনি খাদ্য বলিয়া বিষ ভোজন করিবেন না। “জল বদ্ধ মৎস্যের নিকট জাল কি স্পৃহনীয় হইতে পারে? ধৃত পক্ষীর নিকট পাশ কি কাম্য বস্তু হইতে পারে? “সর্পের গ্রাস মুক্ত শশক কি পুনর্বার সর্পের মুখে গমনোৎসুক হইবে?  যাহার হস্ত অগ্নি দগ্ধ হইয়াছে সে কি পুনরায় ভূমিতে নিক্ষিপ্ত অগ্নি হস্ত সাহায্যে উত্তোলন করিবে?  অন্ধ পুর্ন দৃষ্টি পাইয়া কি পুনরায় উহা হারাই বার বাসনা করিবে। 


“জর পীড়িত মনুষ্য শৈত্য প্রদায়ী ঔষধের প্রার্থী। শরীরের উত্তাপ বর্ধক দ্রব্য পান করিতে কি সে উপদিষ্ট হইবে? অগ্নি নির্বাপিত করি বার জন্য কি আমরা তাহার উপর কাষ্ঠ নিক্ষেপ করিব? “আমার প্রতি করুণা প্রকাশ করিবেন না, ইহাই আমার প্রার্থনা। যাহারা রাজ্যও অর্থ সম্পদের ভার গ্রস্ত, তাহাদের প্রতি করুণা প্রদর্শন করুন। 


তাহারা কম্পিত হৃদয়ে তাহাদের সম্পদ উপভোগ করে, কারণ অতিশয় প্রিয় বস্তু হৃত হইবার আশঙ্কায় তাহারা সর্বদা পীড়িত, অতএব মৃত্যু কালে তাহারা। তাহাদের বহু মুল্য রত্নাদি সঙ্গে লইয়া যাইতে পারে না। মৃত রাজা ও মৃত ভিক্ষু কের মধ্যে প্রভেদ কি? “অসার লাভের জন্য আমার আকাঙ্ক্ষা নাই তজ্জন্য আমি রাজ মুকুট পরি ত্যাগ করিয়া জীবন ভার হইতে মুক্ত হইবার প্রয়াসী। 


“এই হেতু নূতন সম্বন্ধ ও নূতন কর্তব্যের জালে আমাকে আর আবদ্ধ করিবেন না। আমি যে কর্ম আরম্ভ করিয়াছি, তাহার সাধনে বিঘ্ন হইবেন না। “আপনার নিকট বিদায় লইতে আমার দুঃখ হইতেছে, কিন্তু যে সকল জ্ঞানীগণ আমাকে মুক্তির পথ প্রদর্শন কারী ধর্ম শিক্ষা দিতে পারেন আমি তাহাদের নিকট যাইব।


“আপনার রাজ্যশান্তি ও সম্পদে পূর্ণহউক, এবং আপনার শাসনের উপর জ্ঞানের আলোক মধ্যাহ্ন সূর্যের জ্যোতির ন্যায় বর্ষিত হইক। আপনার রাজশক্তি প্রবল হউক এবং ন্যায় ধর্ম পরায়ণতা যেন আপনার হস্তে রাজ দণ্ড স্বরূপ হয়।”


নৃপতি সসম্মানে যুক্ত কর হইলেন এবং শাক্যমুনিকে প্রণাম করিয়া কহিলেন, “তুমি কাম বস্তু লাভে সভল হও, এবং আমার প্রার্থনা, সিদ্ধি লাভান্তে প্রত্যা গমন পূর্বক আমাকে শিষ রূপে গ্রহণ কর।” বোধিসত্ব নৃপতির মিত্রতা ও শুভেচ্ছার সহিত তাহার নিকট বিদায় লইলেন। বিদায় কালে নৃপতির প্রার্থনা পূর্ণ করিতে তিনি সঙ্কল্প করিলেন। নৃপতি বিম্বিসার সমাপ্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url