রাজ গৃহ নগরে ধর্ম উপদেশ
রাজ গৃহ নগরে ধর্ম উপদেশ
উরুবিবে কিছু দিন বাস করিয়া বুদ্ধ রাজ
গৃহ নগরে গমন করিলেন, সঙ্গে বহু সংখ্যক ভিক্ষু। তাহাদের মধ্যে অনেকেই পূর্বেজটিলছিলেন। মগধের নৃপতিবিম্বিসার গৌতম শাক্যমুনির আগমন
বার্তা শ্রবণ করিলেন। জনগণ কহিল, “গৌতম মূর্তি মান পবিত্রতা। শকট চালক যে রূপ বৃষকে দমন করে, সেই রূপ বুদ্ধও
মনুষ্যের চালক, উচ্চনীচ নির্বিশেষে মনুষ্যের শিক্ষক।” নৃপতি, মন্ত্রীবর্গ ও
সৈন্যগণ সমভিব্যাহারে যেখানে মহাপুরুষ অবস্থান করিতে ছিলেন, সেই খানে গমন করিলেন।
আরো দেখুন: নৃপতি বুদ্ধের শরণ
আরো দেখুন: ধর্ম প্রচার
![]() |
রাজ গৃহ নগরে ধর্ম উপদেশ |
সেখানে তাহার জটিল দিগের
ধর্মাচার্য খ্যাতনামা কাশ্যপের সহিত বুদ্ধকে দেখিলেন। বিশ্বিত হইয়া তাহারা চিন্তা করিলেন শাক্য মুনি কাশ্যপের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, অথবা কাপ গৌতমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন? তথাগত তাহাদের মনোগত ভাব বুঝিয়া কাশ্যপকে কহিলেন, “কাশ্যপ, তুমি কি জ্ঞান লাভ করিয়াছ?
কিসের প্রবোচনায় তুমি পবিত্র অগ্নি
বিসর্জন পূর্বক কঠোর ব্রত চার পরি ত্যাগ করিয়াছ?” কাশ্যপ কহিলেন, “অগ্নি পূজা হইতে
আমি এক মাত্র ফল প্রাপ্ত হইয়া ছিলাম, উহা সংসার চক্র এবং তদানুসঙ্গিক দুঃখ ও বৃথা
আত্ম অভিমান। ঐ পূজা আমি পরি ত্যাগ করিয়াছি, কঠোর ব্রত চার ও যজ্ঞ অনুষ্ঠানের
পরিবর্তে আমি সর্বোচ্চ নির্বাণের প্রার্থী হইয়াছি। ”
বুদ্ধ বুঝিলেন যে সমবেত জন মণ্ডলী এক যোগে ধর্ম গ্রহণে প্রস্তুত। তিনি নৃপতি বিম্বিসার কে কহিলেন যিনি নিজের আত্মার স্বরূপ অবগত হইয়াছেন এবং ইন্দ্রিয় সমূহ কি প্রকারে কর্ম শীল হয় তাহা বুঝিয়াছেন তিনি ‘আমি’র অস্তিত্ব স্বীকার করিবেন না, তিনি অনন্ত শান্তি অনুভব করিবেন। জগতে ‘আমি’র চিন্তার অস্তিত্ব বর্তমান, উহা হইতে মিথ্যা উপলব্ধির উৎপত্তি হয়।
কেহ কেহ কহিয়া থাকেন ‘আমি’র মৃত্যু নাই, কেহ
আবার কহেন ইহাও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। উভয়
পক্ষই ভ্রান্ত; এই ভ্রান্তি অতি গুরুতর। কারণ,
আমি যদি ধ্বংস হয় তাহা হইলে মনুষ্যের অনুসৃত কর্ম ফল ধ্বংস প্রাপ্ত হইবে এবং কাল
ক্রমে পরলোকের অস্তিত্ব থাকিবে না। পাপময় স্বার্থ পরতা হইতে এই প্রকার মুক্তির
মূল্য নাই।
অপর পক্ষে যদি ‘আমি’ নশ্বর না হয়, তাহা হইলে সমস্ত জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে মাত্র এক অনাদি ও অনন্ত সত্তা বিদ্যমান। ইহাই যদি ‘আমি’ হয়, তাহা হইলে ইহা পূর্ণতা প্রাপ্ত, কর্ম দ্বারা ইহার পূর্ণতা সাধন অসম্ভব। অনন্ত অবিনশ্বর ‘আমি’ কখনও পরিবর্তিত হইতে পারে না।
তাহা হইলে আত্মা সর্বজয়ী প্রভু,
সর্ণের পূর্ণতা সাধন নিষ প্রয়োজন নৈতিক আচরণ ও মুক্তির কোনও প্রয়োজন নাই। কিন্তু সুখ ও দুঃখ বিদ্যমান। নিত্যতা কোথায়? আমি যদি আমাদের কর্মের কারক না হয়, তাহা হইলে ‘আমি’ নাই;
কর্মের কোনও কারক নাই, জ্ঞানের অনু ভাবক নাই, জীবনের অধিকারী নাই।
মনো যোগ পূর্বক শ্রবণ কর: ইন্দ্রিয় সমূহ বন্ধুর সম্মুখীন হয় এবং উহাদের সংস্পর্শ হইতে চেতনার উৎপত্তি হয়। ফলে স্মৃতির বিকাশ। ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সংযোগে উৎপন্ন জ্ঞান হইতে যাহা আত্মা কথিত হয় তাহার জন্ম হয়। অঙ্কুর বীজ হইতে নির্গত হয়; বীজ অঙ্কুর নহে; উহারা একই পদার্থ নয়, তথাপি এক অন্য হইতে পৃথকও নয়। চেতন প্রাণীর জন্ম এই রূপ।
তোমরা
‘আমি’র দাস, অহর্নিশি আত্ম সেবায় ক্লান্ত, তোমরা সর্বদা জন্ম, বার্ধক্য, ব্যাধি ও
মৃত্যুর ভয়ে পীড়িত! দিব্য বাণী শ্রবণকর, তোমাদের নিষ্ঠুর বিধাতা নাই। আত্মভিমান ভ্রান্তি, মোহ, স্বপ্ন। চক্ষুরুন্মীলন কর, জাগ্রত হও। বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ দেখ, তুমি শান্ত হইবে। “জাগ্রত হইলে দুঃস্বপ্নের ভীতি থাকিবে না, সর্প
ভ্রান্ত রজ্জুর স্বরূপ অবগত হইলে কেহ ভয় কম্পিত হইবে না।
যিনি ‘আমি’র নাস্তিত্ব উপলব্ধি করিয়াছেন, তিনি অম্মিতা জনিত কামনা ও বাসনা বিসর্জন দিবেন। পূর্বজন্ম হইতে প্রাপ্ত বস্তুতে আসক্তি, লোভ এবং ইন্দ্রিয় পরায়ণতা জগতে দুঃখ ও আত্ম অভিমানের জনক। সর্ব গ্রাসী অহম কারের বর্জন করিলে তুমি মনের যে নির্মল প্রশান্ত অবস্থা লাভ করিবে, ঐ অবস্থা তোমাকে সম্পূর্ণ শান্তি, মঙ্গল ও জ্ঞান দিবে। মাতা যেমন নিজের জীবন উপেক্ষা করিয়া এক মাত্র সন্তান কে রক্ষা করে, সেই রূপ যিনি সত্যের সন্ধান পাইয়া ছেন, তিনি অবিরত সর্ব প্রাণীর মধ্যে উপচিকীর্ষার অনুশীলন করিবেন।
তিনি সমস্ত জগতে, উর্ধে,
নিয়ে, চতুর্দিকে অবাধভাবে, ভেদ জ্ঞানহীন
হইয়া অপরিমিত উপকারবিতরণ করিবেন। জাগ্রত অবস্থায় মানুষ মনের এই রূপ অবস্থা অটল ভাবে
রক্ষা করিবে, তাহা দণ্ডায় মান হইয়াই হউক, কিম্বা পদ ক্ষেপে, কিম্বা উপবেশনে,
কিম্বা শয়নেই হউক।
অন্তঃ করণের এই রূপ অবস্থা সর্বোৎকৃষ্ট। ইহা নির্বাণ! “সর্ব প্রকার গঠিত আচরণের বর্জন, সাধু জীবন যাপন এবং অন্তঃ করণের বিশুদ্ধতা সম্পাদন, ইহাই বুদ্ধ দিগের ধর্ম। উপদেশ সমাপ্ত হইলে মগধ নৃপতি বুদ্ধ কে কহিলেন: দেব, অতীত কালে যখন আমি রাজ কুমার ছিলাম, তখন আমি পঞ্চ বিধ বাসনা হৃদয়ে পোষণ করিতাম।
আমার প্রথম বাসনা আমি যেন নৃবৃতি হইতে পারি, সে
বাসনা পূর্ণ হইয়াছে। আমার দ্বিতীয় বাসনা আমার রাজত্বকালে ভগবান বুদ্ধ পৃথিবীতে অবতীর্ণ
হইয়া যেন আমাররাজ্যে আগমন কবেন; সে বাসনা আমারপূর্ণ হইয়াছে। আমার তৃতীয় বাসনা আমি যেন তাহার পূজা করিতে পাই;
এই ক্ষণে সে বাসনা আমার পূর্ণ হইল। আমার
চতুর্থ বাসনা আমি যেন পুণ্যাত্মার নিকট ধর্মো উপদেশ প্রাপ্ত হই; এই ক্ষণে সে
বাসনাও আমার পূর্ণ হইল।
আমার পঞ্চম বাসনা, সর্বোচ্চ বাসনা আমি যেন বুদ্ধের ধর্ম উপলব্ধি করিতে পারি, এই বাসনা পূর্ণ হইয়াছে। মহি মান্বিত দেব! তথাগতের প্রচারিত সত্য অত্যুচ্চ মহিমা মণ্ডিত! জগৎপতি বুদ্ধ উৎপাতিতের পুনঃ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, লুম্বিতকে প্রকাশ করিয়াছেন, তিনি পথ ভ্রষ্ট পথিক কে পথ প্রদর্শন করিয়াছেন, তিনি অন্ধকারে দীপ জালিয়া চক্ষুষ্মন কে দেখিবার সুযোগ দিয়াছেন। আমি বুদ্ধের শরণ লইলাম, আমি ধর্মের শরণ লইলাম, আমি সঙ্ঘের শরণ লইলাম।
তথাগত তাহার শক্তি ও জ্ঞান প্রয়োগে অসীম আধ্যাত্মিক ক্ষম তার পরিচয় দিলেন। তিনি ভিন্ন ভিন্ন চিত্ত বশীভূত ও তাহাদের ঐক্য সাধন করিলেন, তিনি তাহাদিগকে সত্য দেখাইলেন ও গ্রহণ করা ইলেন, সমস্ত রাজ্যে পুণ্যের বীজ রোপিত হইল। রাজ গৃহ নগরে ধর্ম উপদেশ সমাপ্ত।