ধর্ম প্রচার

ধর্ম প্রচার

দিনে দিনে বুদ্ধ বাণী প্রসারিত হইতে লাগিল।  বহু জন তাহার নিকটে আসিয়া দুঃখ জয়ের বাসনায় পবিত্র জীবন যাপনাৰ্থ তাহার বাণী শ্রবণকরিল! বুদ্ধ যখন দেখিলেন যে, সত্যানুসন্ধিৎসু ও অভিষেক প্রার্থী সকলের উপরে মন সংযোগ করা অসম্ভব, তখন তিনি শিষ্য বর্গের মধ্যে হইতে ধর্ম প্রচারের উপযোগী গণকে নির্বাচন করিয়া দেশান্তরে প্রেরণ করিলেন।  


তিনি তাঁহাদিগ কে কহিলেন: “ভিক্ষুগণ, বহু প্রাণীর মঙ্গলের জন্য, মানব জাতির কল্যাণের জন্য, জগতের প্রতি করুণা পর বশ হইয়া তোমরা যাও; ধর্ম প্রচার কর।  ঐ ধর্মের বাহ্য ও অভ্যন্তর এবং আদি, মধ্য ও অস্ত মহিমা মণ্ডিত।  এমনপ্রাণী বিদ্যমান যাহাদের চক্ষু ভস্মাচ্ছাদিত নহে; কিন্তু তাহাদের নিকট যদি ধর্ম প্রচারিত না হয় তাহারা মুক্ত হইবে না। 


আরো দেখুন: রাজ গ্রহ নগরে ধর্ম উপদেশ


আরো দেখুন: সত্য প্রদর্শন


ধর্ম প্রচার

ধর্ম প্রচার

তাহাদের নিকট পবিত্র তার জীবন ঘোষণা কর।  তাহারা প্রাণি ধান পূর্বক উহা গ্রহণ করিবে।  “তথাগতের ঘোষিত ‘ধর্ম’ ও ‘বিনয়’ প্রকাশেই দীপ্ত হয়, আচ্ছাদনে নহে।  তথাপি এই সত্য গর্ভ উৎকৃষ্ট ধর্ম যেন অনধিকারীর হস্তে পতিত না হয়।  তাহা হইলে উহা উপেক্ষিত ও ঘৃণ্য হইবে, অবমানিত হইবে, হাস্যাস্পদ হইবে, নিন্দিত হইবে।  


“ভিক্ষুগণ, আমি এক্ষণে তোমাদিগকে এই অনুমতি দিতেছি।  ভিন্ন ভিন্ন দেশে যাহারা অভিষেক গ্রহণের ঐকান্তিক বাসনা প্রকাশ করিবে, যদি তাহাব।  উপযুক্ত হয়, তাহাদিগ কে অভিষিক্ত কর। ” তদ বধি অনুকুল চতুতে ভিক্ষু গণের দুরে গিয়া প্রচার কার্য সম্পাদন করা এবং বর্ষায় সকলে একত্র হইয়া তথাগতের উপদেশ শ্রবণ করার বিধি প্রতিষ্ঠিত হইল।

 

কাশ্যপ

ঐ সময়ে উরুবিবে জটিল নামে এক সম্প্রদায় বাস করিত।  উহারা কৃষ্ণ বিশ্বাসী অগ্নি উপাসক; কাশ্যপ তাহাদের নেতা।  সমস্ত ভারতে কাশ্যপ বিখ্যাত ছিলেন।  পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী গণের মধ্যে অন্যতম বলিয়া তাহার নাম সম্মানিত হইত।  


ধর্ম সম্বন্ধে তাহার মত সর্ব জন পূজ্য ছিল।  পুণ্যাত্মা উরুবিত্বের জটিল কাশ্যপের নিকট গমন করিয়া কহিলেন, “আপনি যে কক্ষে আপনার পবিত্র, অগ্নি রক্ষা করেন, সেই খানে আমাকে এক রাত্রি অবস্থান করিতে অনুমতি করুন। ” অপুর্ব শ্রী ও সৌন্দর্য সম্পন্ন বুদ্ধকে দেখি কাশ্যপ মনে মনে চিন্তা করিলেন, “ইনি মহা মুনি ও উপযুক্ত শিক্ষক।  যে কক্ষে পবিত্র অগ্নি রক্ষিত হয়, সেখানে রাত্রি বাস করিলে সপদংশনে ইহার মৃত্যু হইবে। ”

 

পরি শেষে কহিলেন, “যে কক্ষে পবিত্র অগ্নি রক্ষিত হয় সেখানে আপনার রাত্রি বাসে আমার আপত্তি নাই, কিন্তু সর্প রাক্ষস আপনার প্রাণ নাশ করিলে আমি দুঃখিত হইব। ” কিন্তু বুদ্ধের নির্বাদ্ধা তিশয্যে কাশ্যপ তাহাকে ইচ্ছা মত রাত্রি বাসের অনুমতি দান করিলেন।  পুণ্যাত্মা দেহ কে সরল ভাবে রক্ষা করিয়া সতর্কিত ভাবে উপবেশন করিলেন।  


রাত্রি কালে রাক্ষস বুদ্ধের নিকট আগমন করিল; সে ক্রোধে বিষাগ্নি উদগীরণ এবং জলন্ত বাষ্পে বায়ু মণ্ডল পূর্ণ করিতে ছিল।  কিন্তু সে বুদ্ধের কোনও অনিষ্ট করিতে পারিল না।  অগ্নি ভস্মী ভূত হইল, সর্ব জন পুজিত পুরুষ শ্রেষ্ঠ প্রশান্ত রহিলেন।  বিষবাহী রাক্ষস ক্রুদ্ধ হইয়া স্বক্রোধে বিনষ্ট হইল।

 

কক্ষ হইতে নির্গত আলোক রশ্মি দেখিয়া কাপ কহিলেন, “হায়, কি দুর্দৈব।  মহান শাক্য মুনির মুখ মণ্ডল সত্যই সুন্দর, কিন্তু সর্প তাহাকে বিনাশ করিবে।” প্রভাতে রাক্ষসের মৃত দেহ কাশ্যপকে দেখাইয়া পুণ্যাত্মা কহিলেন, “ইহার অগ্নি আমার অগ্নির নিকট পরাজিত হইয়াছে। ” কাশ্যপ মনে মনে কহিলেন, শাক্য মুনি মহা শ্ৰমণ; তিনি অসাধারণ ক্ষমতা শালী, কিন্তু তিনি আমার ন্যায় পবিত্র নহেন। ” 


ঐ সময়ে একটি উৎসব ছিল।  কাশ্যপ চিন্তা করিলেন, “সমস্ত দেশ হইতে বহু লোক আগত হইয়া শাক্য মুনিকে দেখিবে।  তিনি তাহাদের সহিত বাক্যলাপ করিলে তাহারা তাহার প্রতি বিশ্বাস হইয়া আমাকে পরিত্যাগ করিবে। ” এই রূপে তাহার হিংসার উদয় হইল। 

 

উৎসবের দিন আগত হইলে বুদ্ধ স্থান ত্যাগ করিলেন, কিন্তু তিনি কাশ্যপের নিকট গমন করিলেন না।  কাশ্যপ তাহার নিকট গিয়া কহিলেন, “মহা মান্য শাক্য মুনি কেন আসিলেন না?  তথাগত উত্তর করিলেন, “কাশ্যপ, উৎসবে আমার অনুপস্থি তিই কি তোমার স্পৃহনীয় নয়?” কাশ্যপ বিস্ময়া বিষ্ট হইয়া চিন্তা করিলেন, “শাক্য মুনি অতি মহান, কিন্তু তিনি আমার ন্যায় পবিত্র নহেন। ” 


তৎপর বুদ্ধ কাশ্যপকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “তুমি সত্য দেখিতেছ, কিন্তু হৃদয় স্থিত হিংসার জন্য তাহা গ্রহণ করিতেছ না।  হিংসা কি পবিত্র তার আচরণ? হিংসা তোমার মনে আত্মা অভি মানের শেষাংশ।  কাশ্যপ, তুমি পবিত্র নও; তুমি এখনও মার্গে প্রবেশ কর নাই।”

 

কাশ্যপ আর প্রতি কুলতাচরণ করিলেন না।  তাঁহার হিংসা অন্তর্হিত হইল এবং বুদ্ধের সম্মুখে নত মস্তক হইয়া তিনি কহিলেন, “দেব, আমি আপনার নিকট অভিষেক গ্রহণ করিতে বাসনা করি। ” বুদ্ধ কহিলেন, “কাশ্যপ, তুমি জটিল দিগের নেতা।  প্রথমে তোমার অভি প্রায়।  তাহাদিগের নিকট জ্ঞাপন কর, তাহারা তোমার নির্দেশ বর্তী হউক।” 


কাশ্যপ জটিলদিগের নিকট গিয়া কহিলেন, “আমি শাক্য মুনির নির্দেশনা অনুসারে ধর্ম জীবন যাপন করিতে উৎসুক হইয়াছি; শাক্য মুনি বুদ্ধ, জগৎপতি।  তোমাদের যাহা সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলিয়া বোধ হয় তাহা করিতে পারি।” জটিলগণ উত্তর করিলেন, “আমরা শাক্য মুনির প্রতি গভীর স্নেহে আকৃষ্ট হইয়াছি, আপনি যদি তাহার সম্প্রদায় ভুক্ত হয়েন, আমরাও তদ্রুপ করিব। ”

 

এই রূপে উরুবিধে জটিল গণ অগ্নি উপাসনার উপকরণাদি নদীতে নিক্ষেপ করিয়া বুদ্ধের সমীপে গমন করিল।  নদী কাশ্যপ ও গয়া কাশ্যপ নামক উরুবিম্বে কাশ্যপের ভ্রাতৃদ্বয় পরাক্রম শালী ও জন গণের অধিনেতা ছিলেন।  তাহারানদী তীরেবাস করিতেন।  অগ্নি পূজার উপকরণাদি নদী বক্ষে ভাস মান দেখিয়া তাঁহারা কহিলেন, “আমাদিগের ভ্রাতার কিছু ঘটিয়াছে।” 


ইহা কহিয়া সদলে তাহারা উরুবিবে আগমন করিলেন।  যাহা ঘটিয়া ছিল তাহা শ্রবণ করিয়া তাহারাও বুদ্ধের সন্নি ধানে গমন করিলেন।  অতি কঠোর ব্রত চারী ও অগ্নি উপাসক নদী ও গয়া কাপয়কে নিকটে আসিতে দেখিয়া পুণ্যাত্মা অগ্নি সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া কহিলেন: জটিল গণ, সর্ব বস্তুই জ্বলিতেছে। চক্ষু জ্বলিতেছে, চিন্তা সমুহ জলিতেছে, সর্বেন্দ্ৰিয় জ্বলিতেছে।  

 

তাহার কামনার অগ্নিতে জ্বলিতেছে।  ক্রোধ রহিয়াছে, অবিদ্যা রহিয়াছে, দ্বেষ রহিয়াছে; যত দিন অগ্নি নিজের পুষ্টি সাধনের জন্য দাহ পদার্থের সন্ধান পাইবে, তত দিন জন্ম, মৃত্যু, ক্ষয়, শোক, বিলাপ, ক্লেশ, নৈরাশ্য ও দুঃখের অস্তিত্ব বর্তমান থাকিবে।  ইহা বিবেচনা করিয়া, সত্যানু সন্ধিৎসু চতুরঙ্গ সত্য অনু ধাবন পূর্বক মহান অষ্টাঙ্গ মার্গে প্রবেশ করিবেন।  


তিনি তাহার চক্ষু তাহার চিন্তা, তাহার সর্বেন্দ্ৰিয় হইতে নিজেকে সতর্ক করিবেন।  তিনি রাগ দ্বেষাদি বিবর্জিত হইয়া মুক্ত হইবেন।  তিনি আত্ম পরতা হইতে মুক্তি লাভ করিয়া নির্বাণে পরম সুখময় অবস্থা প্রাপ্ত হইবেন। ” জটিলগণ সানন্দে বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের শরণ লইল।  জটিলগণ সানন্দে বুদ্ধ, ধর্ম ও সঘের শরণ লইল।  ধর্ম প্রচার সমাপ্ত

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url