বোধিসত্বের সংসার ত্যাগ
বোধিসত্বের সংসার ত্যাগ
রাত্রি কাল। সুকোমল উপা ধানে মস্তক রক্ষা করিয়া রাজ পুত্র বিভ্রম সুখ অনুভব করিলেন না।তিনি উঠিয়া উদ্যানে গমন করিলেন এবং কহিলেন, “হায়! সমস্ত জগৎ অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছন্ন; জীবনের অশুভ সমূহ হইতে মুক্তির পন্থা কেহই অবগত নয়!” তিনি যন্ত্রণায় আর্তনাদ করিলেন।
সিদ্ধার্থ বৃহৎ জম্বু বৃক্ষ তলে উপবেশন করিয়া
জীবন, মৃত্যু ও ধ্বংসের অমঙ্গল বিষয়ে চিন্তা মগ্ন হইলেন, চিত্তের একাগ্রতায় তিনি
মোহ মুক্ত হইলেন। সর্ব বিধ হীন বাসনা
তাহার হৃদয় হইতে দূরী ভূত হইল ও তিনি পূর্ণ শান্তি অনুভব করিলেন এই আনন্দ মগ্ন অবস্থায় তিনি মনশ্চক্ষে পৃথিবীর
সমস্ত দুঃখ ও অমঙ্গল দেখিলেন। তিনি ভোগনিহিত
দুঃখ এবং মৃত্যুর অনিবার্যতা অনুধাবন করিলেন।
আরো দেখুন: নৃপতি বিম্বিসার
আরো দেখুন: জীবন বন্ধন
![]() |
বোধিসত্বের সংসার ত্যাগ |
মানুষ কিন্তু সুষুপ্তিতে মগ্ন সত্য তাহার নিকট অজ্ঞাত। তাঁহার হৃদয় করুণায় অভি ভূত হইল। এই রূপে দুঃখের সমস্যার বিষয় গভীর চিন্তা করিতে করিতে রাজ পুত্র মানস নয়নে জম্বু বৃক্ষ তলে একটি বিরাট, মহান ও স্থির মূর্তি অবলোকন করিলেন। “কোথা হইতে আসিয়াছ? তুমি কে?” রাজ পুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন।
উত্তরে মূর্তি কহিল, “আমি শ্ৰমণ। বার্ধক্য,
ব্যাধি ও মৃত্যুর চিন্তায় ক্লিষ্ট হইয়া মুক্তির অন্বেষণে আমি গৃহ ত্যাগ করিয়াছি। সর্ব বিধ বস্তু অচিরে ধবংস প্রাপ্ত হয়; এক মাত্র
সত্যই অবিনশ্বর। সর্ব বস্তু পরিবর্তন শীল,
স্থান্বিত্ব কুত্রাপি নাই, কিন্তু যাঁহারা বুদ্ধ তাঁহাদের বাক্য অপরিবর্তন শীল। যে সুখের ক্ষয় নাই সেই সুখ আমার কাম্য; যে ধনের
নাশ নাই আমি সেই ধনের প্রার্থী; যে জীবন অনাদি ও অনন্ত সেই জীবনই আমার কাম্য; সর্ব
বিধ পার্থিব চিন্তা আমি দূর করিয়াছি।
নিভৃতে বাস করি বার জন্য আমি জন হীন করে আশ্রয় লইয়াছি; আমার খাদ্য ভিক্ষা লব্ধ অন্ন; একান্ত কামের উদ্দেশে আমি নিজেকে উৎসর্গ করিয়াছি।” সিদ্ধার্থ জিজ্ঞাসা করিলেন, “অশান্তির আগার এই সংসারে শান্তি লাভ কি সম্ভব? ভোগের অসারতায় আমি স্তম্ভিত, বাসনা আমার নিকট ঘৃণ্য।
সংসার আমাকে
পীড়ন করিতেছে, জীবন আমার নিকট দুর্বহ। ” শ্ৰমণ উত্তর করিলেন, “যেখানে উত্তাপ
বর্তমান, সেই খানেই শৈত্যের সম্ভাবনা বর্তমান প্রাণী সমূহ যখন দুঃখের অধীন তখন সুখ
লাভের ক্ষমতাও তাহাদের অধিকারে; দুঃখের মূল সুখের বিকাশের সূচনা করে। কারণ সুখ ও
দুঃখ পরস্পর সম্বন্ধ বিশিষ্ট। এই রূপে দুরন্ত
ক্লেশ হইতে স্বর্গীয় আনন্দ উদ্ভুত হইতে পারে।
কেবল মাত্র মানুষকে আয়াস
সহকারে ঐ আনন্দ অন্বেষণ করিতে হইবে। পঙ্কে
পতিত মানুষ যে রূপ নিকটস্থ পদ্মা বৃত জলাশয় অন্বেষণ করিবে, সেই রূপ তুমিও পাপের
মলিনতা ধৌত করি বার জন্য নির্বাণের অক্ষয় জলাশয় অন্বেষণ কর। যদি জলাশয়কে অন্বেষণ করা না হয়, তাহা হইলে জলা শয়ের
দোষ নয়; তদ্রুপ পাপ গ্রস্ত মানুষকে নির্বাণের মুক্তিতে চালিত করি বার যখন পথ
বিদ্যমান, তখন ঐ পথে মানুষ যদি বিচরণ না করে তাহা হইলে পথের দোষ নয়, মানুষের
দোষ। পরন্তু ব্যাধি গ্রস্ত মানুষ চিকিৎসক
বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যদি তাহার সাহায্য না লয় তাহাতে চিকিৎসকের দোষ হয় না। সেই রূপ পাপ ব্যাধি গ্রস্ত মানুষ যদি জ্ঞান লোকের
আশ্রয় না লয় তাহা হইলে তাহার দোষ। ”
রাজ কুমার ছায়া মূর্তির মহৎ বাণী শুনিয়া কহিলেন, “তোমার বাক্য আনন্দ দায়ক, যে হেতু আমি এখন বুঝিলাম যে আমার উদ্দেশ্যে সিদ্ধ হইবে। আমার পিতা আমাকে জীবন উপভোগ করিতে এবং সাংসারিক কর্তব্য পালন করিতে উপদেশ দিতেছেন, যাহাতে আমার ও আমার বংশের সম্মান লাভ হয়। তিনি বলেন, আমি এখনও অতিশয় তরুণ, আমার রক্ত এখনও ধর্ম সাধনের উপযুক্ত হয় নাই।”
সৌম্য মূর্তি মস্তক সঞ্চালন পূর্বক উত্তর করিলেন,
“প্রকৃত ধর্মের অন্বেষণের জন্য সকল সময়ই কালোচিত, ইহা অবশ্য জানিবে।” সিদ্ধার্থের
হৃদয় আনন্দে পরি পূরিত হইল। তিনি কহিলেন,
“ধর্মান্বেষণের ইহাই উপযুক্ত অবসর; পূর্ণ জ্ঞান লাভের পথে বিঘ্ন প্রদায়ী বন্ধন সমূহ
ছিন্ন করি বার ইহাই উপযুক্ত সময়; অরণ্যে বাস ও সন্ন্যাসীর জীবন যাপন পূর্বক মুক্তির
পথ লাভের ইহাই প্রকৃত সুযোগ।” স্বর্গীয় দূত সিদ্ধার্থের সংকল্প অনুমোদন সহকারে
শ্রবণ করিলেন।
তিনি পুন রায় কহিলেন, “ধর্মান্বেষণের সত্যই এই উপযুক্ত অবসর। যাও, সিদ্ধার্থ, মনো বাসনা পূর্ণ কর। যে হেতু তুমি বোধিসত্ত্ব, ভবিষ্যৎ বুদ্ধ, পৃথিবীকে জ্ঞান লোকে প্রদীপ্ত করাই তোমার জন্মের উদ্দেশ্য। “তুমি তথাগত, তুমি সর্ব গুণান্বিত, যে হেতু তুমি সর্ব ধর্ম সাধন পূর্বক ধর্ম রাজ আখ্যা লাভ করিবে। তুমি ভগবন্ত, তুমি মোক্ষ প্রাপ্ত, যে হেতু তুমি পৃথিবীর মুক্তি দাতা হইবে।
“তুমি সত্যের
পূর্ণতা সম্পাদন কর। শিরে বজ্রা ঘাত হইলেও
সত্যের পথে মানুষকে প্রলুব্ধকারী মোহ সমূহকে কখনও প্রশ্রয় দিও না। সূর্য যেমন সর্ব ঋতুতেই নিজ গতি অনুসরণ করে,
কখনই ভিন্ন গতি অবলম্বন করে না, সেই রূপ তুমি যদি ন্যায় ধর্মের সরল পথ হইতে ভ্ৰষ্ট
না হও, তাহা হইলে তুমি বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হইবে।
“সোৎসাহে কাম্য বস্তুর অনুসরণ কর, ঈপ্সিতকে লাভ করিবে। অনন্য মনা হইয়া লক্ষ্যকে সম্মুখে রাখিও, তুমি পুরস্কৃত হইবে। ঐকান্তিকতার সহিত সংগ্রাম কর, জয়ী হইবে। সর্ব দেবতা, সর্ব মহা পুরুষ, জান লোক প্রার্থী মাত্রেই তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছেন, সর্বোত্তম প্রজ্ঞা তোমার পথ প্রদর্শক। তুমি বুদ্ধ হইয়া আমাদিগের শিক্ষক ও অধিশ্বর হইবে; তুমি জ্ঞান লোকে জগত আলোকিত করিয়া মানুষকে ধবংস হইতে রক্ষা করিবে।”
তদনন্তর
ছায়া মূর্তি অদৃশ্য হইল এবং সিদ্ধার্থের চিত্ত শান্তি তে পরি পূরিত হইল। তিনি মনে মনে কহিলেন: “আমি সত্যের সন্ধান পাইয়াছি,
আমি স্বীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে কৃত সঙ্কল্প। যে সকল বন্ধন আমাকে সংসারে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে
ঐ সকল বন্ধন ছিন্ন করিব, আমি গৃহ ত্যাগী হইয়া মুক্তি পথের অনুসরণ করিব।
“বুদ্ধদিগের বাক্য কখনও বৃথা হয় না, তাহাদের বাক্য সত্যের প্রতিবিম্ব। “যে হেতু বায়ু পথে নিক্ষিপ্ত প্রস্তর খণ্ডের পতন, নশ্বর প্রাণীর মৃত্যু, এভাতে সূর্যোদয়, বিবর ত্যাগ কালে সিংহের গর্জন এবং গর্ভবতী স্ত্রীলোকের এসব যে রূপ নিশ্চিত, সেই রূপ বুদ্ধ বাক্যও নিশ্চিত, তাহা কখনও বৃথা হয় না। “আমি নিশ্চয়ই বুদ্ধহইব।” যাহারা জগতে সর্বাপেক্ষা প্রিয়তম, তাহাদিগকে বিদায়ের শেষ দেখা দেখি বার জন্য রাজ পুত্র স্ত্রীর শয়না গারে প্রবেশ করিলেন।
পুত্রকে আর এক বার বক্ষে লইয়া বিদায়ের শেষ চুম্বন দিবার জন্য তিনি অধীর হইলেন। কিন্তু শিশু মাতৃ ক্রোড়ে সুপ্ত। তাহাকে তুলিয়া লইলে মাতাকেও জাগরিত করা হয়। সিদ্ধার্থ দাঁড়াইয়া অনিমেষ নয়নে সুন্দরী স্ত্রী ও প্রিয়তম সন্তানের প্রতি চাহিতে লাগিলেন, শোকে তাঁহার হৃদয় অভি ভূত হইল।
বিদায়ের বেদনা নিষ্ঠুর ভাবে তাহাকে জয় করিল। যদিও তাহার চিত্ত দৃঢ় ছিল, যদিও শুভ কিংবা অশুভ কিছুই তাহার সঙ্কল্পকে বিচলিত করিতে সমর্থ ছিল না, তথাপি তাহার চক্ষু দ্বয় হইতে দরবিগলিত ধারে অশ্রু নির্গত হইল, তিনি চেষ্টা করিয়াও অশ্রু গতি রুদ্ধ করিতে পারিলেন না।যথার্থ পুরুষের ন্যায় সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগ করিনে। তিনি হৃদয়ের বেদনা দমন করিলেন বটে, কিন্তু স্মৃতির উচ্ছেদ করিলেন না।
তিনি স্বীয় অশ্ব কণ্টকে আরোহণ পূর্বক উন্মুক্ত প্রাসাদ বার অতি ক্রম করিয়া বাহিরে রাত্রির নিস্তব্ধতায় মিশিয়া গেলেন। সঙ্গে এক মাত্র বিশ্বস্ত সারথী ছন্ন। এই রূপে রাজ পুত্র সিদ্ধার্থ পার্থিব সুখ ভোগ বিসর্জন দিয়া রাজ্য ত্যাগ করিয়া, সর্ব বিধ বন্ধন ছিন্ন কবিয়া, সন্ন্যাস আশ্রয় করিলেন।পৃথিবী অন্ধকারে মগ্ন হইল; কিন্তু নক্ষত্রগণ আলোকে আকাশ উজ্জল করিল। বোধিসত্বের সংসার ত্যাগ সমাপ্ত।