বারাণসীতে ধর্মোপদেশ
বারাণসীতে ধর্মোপদেশ
উপরোক্ত পঞ্চ ভিক্ষু তাঁহাদের পুরাতন শিক্ষককে আগমন করিতে
দেখিয়া সঙ্কল্প করিলেন যে, তাহাকে অভিবাদন করা হইবে না, তাঁহাকে গুরু বলিয়া সম্বোধন
করা হইবে না, নাম ধরিয়া তাহাকে সম্বোধন করিতে হইবে। কারণ, তাহারা কহিলেন, “তিনি ব্রত ভঙ্গ করিয়াছেন,
তিনি পবিত্র জীবন বর্জন করিয়াছেন। তিনি ভিক্ষু নহেন, গৌতম মাত্র। তিনি এক্ষণে সংসারে
প্রবেশ করিয়া প্রাচুর্য ও পার্থিব ভোগ সুখের মধ্যে বাস করিতেছেন। ” কিন্তু দিব্য পুরুষের
মহত্ব ব্যঞ্জক গতি দেখিয়া তাহারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠিয়া দাড়াইলেন ও সঙ্কল্পের বিরুদ্ধে
তাঁহার অভিনন্দন করিলেন।
আরো দেখুন: বুদ্ধের ১২টি কর্ম বিপাক
আরো দেখুন: সত্য প্রদর্শন
আরো দেখুন: মুক্তির প্রমানন্দ
![]() |
বারাণসীতে ধর্মোপদেশ |
তথাপি তাহার নাম
উল্লেখ করিয়া ‘বন্ধু’ বলিয়া তাহাকে সম্বোধন করিলেন। এইরূপে অভ্যর্বিত হইয়া মহাপুরুষ
কহিলেন, “তথাগতকে তাহার নাম ধরিয়া আহ্বান করিও না, কিম্বা ‘বন্ধু’ বলিয়া সম্বোধন করিও
না, কারণ তিনি পবিত্রতার আধারবুদ্ধ। সর্বপ্রাণীর
উপর বুদ্ধের কৃপানেত্ৰ সম ভাবে অপিত হয়। তজ্জন্য তিনি ‘পিতা’ অভি হিত হয়েন। পিতার অসম্মান অন্যায়; পিতা কে ঘৃণা করা পাপ। ”
“তথাগত” বুদ্ধ পুনরায়
কহিলেন, “আত্মনি গ্রহে মুক্তির অন্বেষণ করেন না। কিন্তু ইহা হইতে এমন মনে করিও না যে,
তিনি পার্থিব ভোগ সুখানুর, কিম্বা প্রাচুর্যের মধ্যে বাসকরেন। তিনি মধ্য মার্গ আবিষ্কার করিয়াছেন। “যে মনুয় মোহ মুক্ত নয়, সে কেবল মাত্র মৎস্য, মাংস
হইতে বিরতি কিম্বা ভস্মা বৃত দেহ দ্বারা কিম্বা অগ্নিতে আহুতি দিয়া শুদ্ধি লাভ করিতে
পারিবে না।
“বেদাধ্যয়ন, ব্রাহ্মণকে
দান, দেবতা দিগের নিকট বলি দান, উত্তাপ কিম্বা শৈত্য জনিত দেহের নির্যাতন এবং অমরত্ব
লাভের জন্য এবম্বিধ বহু কঠিন ব্রতের আচরণ, যে মানুষ মোহবি মুক্ত নয়, তাহাকে শুদ্ধ করিতে
পারে না। “ক্রোধ, মতা, স্বৈরিতা, ধর্মান্ধতা,
শঠতা, হিংসা, আত্ম প্রশংসা, পর গ্লানি অহমিকা এবং মন্দ অভিপ্রায় এই সকল কেই অশুদ্ধি
বলে; মাংস ভক্ষণে অশুদ্ধি হয় না। “ভিক্ষুগণ,
আমি তোমা দিগকে মধ্য মার্গ শিক্ষা দিব। উহা
উভয় বিধ আতিশয্য হইতে দুরে। দৈহিক ক্লেশ দ্বার। কৃষ্ণ ব্রত চারীর মন বিশৃঙ্খলা ও অস্বাস্থ্যকর চিন্তায়
পূর্ণ হয়, দৈহিক নির্যাতন পার্থিব জ্ঞান লাভেরও অনুকুল নয়; কি প্রকারে উহা ইন্দ্রিয়
সমূহ কে জয় করিতে সমর্থ হইবে? “প্রদীপ জলে পূর্ণ করিলে অন্ধকার দূরী ভূত হইবে না, গলিত
কাঠ হইতে অগ্নি উৎপাদনের চেষ্টা করিলে সে চেষ্টা সফল হইবে না।
“দেহের নির্যাতন
যন্ত্রণা দায়ক, বৃথা ও নিস্ফল। মনুষ যদি বাসনার
অগ্নি নির্বাপিত করিতে না পারে, তাহা হইলে মাত্র দিন জীবন যাপন করিয়া কি প্রকারে সে আত্মভিমান হইতে মুক্ত হইবে? “যতদিন আত্মভিমান বর্তমান, যতদিন পার্থিব কিম্বা স্বর্গীয়
ভোগ সুখের বাসনা বিদ্যমান, ততদিন দেহের নির্যাতন বৃথা। কিন্তু যিনি আত্মভিমান দূর করিয়াছেন
তিনি বাসনা মুক্ত, তিনি পার্থিব কিম্বা স্বর্গীয় সুখের আকাঙ্ক্ষা করিবেন স্বাভাবিক
অভাবের তুষ্টি সাধন তাহাকে অশুদ্ধ করিবেনা। দেহের প্রয়োজন অনুসারে পানাহারে কোনও বাধা
নাই। “জ্বল পদ্ম পুষ্পকে বেষ্টন করলেও তাহার
দল কে স্পর্শ করে না। অপর পক্ষে সর্ব বিধ ইন্দ্রিয়
পরতা দুর্বলতা আনয়ন করে। ইন্দ্রিয় পরত ব্যক্তি
রিপু সমূহের দাস; ভোগান্বেষণ অধঃপতন ও নীচ মার্গ।
“কিন্তু জীবনের অভাবের তুষ্টি সাধন অশুভ নহে। শরীবের স্বাস্থ্য রক্ষা কর্তব্য, অন্যথা জ্ঞান প্রদীপের নির্মলতা এবং চিত্তের শক্তি ও তীক্ষ্ণতা রক্ষা সম্ভব নয়। “ভিক্ষুগণ, ইহাই মধ্য পথ, ইহা উভয় বিধ আতিশয্য হইতে দূরে। ” তদনন্তর পুণ্যাত্মা শিবর্গকে মধুর বচনে সম্বোধন করিয়া তাহাদের ভ্রান্তির জন্য কৃপা প্রকাশ পূর্বক তাহাদের প্রয়াসের নিস্ফলতা প্রদর্শন করিলে তাহাদের অন্তঃকরণের বিদ্বেশ গুরুর উপদেশে অন্তর্হিত হইল। অতঃপর পুণ্যাত্মা সর্বোত্তম ধর্মচক্রের প্রবর্তন করিলেন। তিনি পঞ্চ ভিক্ষুর নিকট ধর্মপ্রচার আরম্ভ করিলেন। তাঁহাদের নিকট অমরত্বের দ্বার উদ্ঘাটিত ও নির্বাণের পরমানন্দ প্রদর্শিত হইল। পুণ্যাত্মধর্মোপদেশ আরম্ভ করিলে মহানন্দে সমস্ত বিশ্ব বিহবল হইল।
দেবগণ সত্যের মাধুর্য শ্রবণ করিবার জন্য স্বর্গ হইতে অবতরণ
করিলেন; জীবন্মুক্ত সিদ্ধ পুরুষগণ দিব্যবাণী গ্রহণেচ্ছায় দলবদ্ধ হইয়া বুদ্ধের চতুর্দিকে
দাড়াইলেন; ইতর প্রাণী পর্যন্ত তথাগতের বাক্যের মহিমা উপলব্ধি করিল। সর্ববিধ চেতন প্রাণী, দেবতা, মনুষ্য ও পশু মুক্তির বাণী শ্রবণ করিয়া
নিজ নিজ ভাষায় উহা গ্রহণ ও অনুধাবন করিল! বুদ্ধ কহিলেন: “বিশুদ্ধ আচরণের নিয়মা বলীই
চক্রের অর সমূহ, ন্যায় পরায়ণ তাই তাহাদের দৈর্ঘের সমরূপতা; জানই চক্রের বেষ্টনী; বিনয়
ও চিন্তাশীলতা উহার নাভি; সত্যের অপরিবর্তনীয় অক্ষদণ্ড উহাতেই অবস্থিত। “যিনি দুঃখের
অস্তিত্ব, ইহার কারণ, ইহার প্রতি বিধান ও শাস্তি হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন, তিনি চতুরঙ্গ মহান
সত্য অনুধাবন করিয়াছেন। তিনি প্রকৃত পথে চলিতে সমর্থ হইবেন।
“সত্য দৃষ্টি উদ্ধার ন্যায় তাহার পথ আলোকিত করিবে। সত্যলক্ষ্য তাঁহার চালক হইবে। সত্যবাক্য তাহার বাস গৃহ হইবে। তাহার গতি সরল হইবে, কারণ ইহা সত্য আচরণ। জীবিকা অর্জনের প্রকৃত উপায় তাহাকে সতেজ রাখিবে। যথার্থ উদ্যম তাঁহার পদক্ষেপ ও যথার্থ চিন্তা তাঁহার নিঃশ্বাস হইবে; শান্তি তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিবে।” তদনন্তর পুণ্য আত্মার অস্থায়ীত্ব ব্যাখা করিলেন। “যাহার উৎপত্তি হইয়াছে তাহাই বিনাশ প্রাপ্ত হইবে! আত্মার জন্য উদ্বেগ বৃথা; উহামরী চিকার ন্যায় এবং উহার সহিত সংস্পষ্ট সর্ববিধ ক্লেশ বিনষ্ট হইবে। নিদ্রিত জাগরিত হইলে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের ন্যায় উহারাও অদৃশ্য হইবে। “যাহার জাগরণ হইয়াছে তিনি ভয়মুক্ত, তিনি বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত; তিনি সর্ববিধ উদ্বেগ, উচ্চাকাঙ্খ এবং ক্লেশের নিষ্ফতা উপলব্ধি করিয়াছেন।
“ইহা সহজেই ঘটিয়া
থাকে যে, মানুষ স্নানের সময় আর্দ্র রজ্জু পদ দলিত করিয়া উহাকে সর্প ভ্রম করে। সেভয়ে অভিভূভ ও কম্পিত হইবে এবং সর্পের বিষাক্ত
দংশন জনিত বেদনা মনে মনে কল্পনা করিবে। কিন্তু ভ্ৰমবুঝিতে পারিলে তাহার কি স্বাচ্ছন্দ্য! তাহার ভীতির কারণ তাহার ভ্রান্তি তাহার
অজ্ঞানতা, তাহার মোহ। বন্দুর প্রকৃত স্বরূপ
দৃষ্ট হইলে তাহার চিত্তের শান্তি ফিরি। আসিবে;
সে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিবে; সে আনন্দ পূর্ণ ও সুখী হইবে। “যিনি আত্মার সত্তাভাব উপলব্ধি করিয়াছেন এবং যিনি
বুঝিয়াছেন যে, তাঁহার সমুদয় ক্লেশ, দুশ্চিন্তা এবং গর্বমরী চিকামাত্র, ছায়ামাত্র, স্বপ্নমাত্র,
তিনিই উক্ত প্রকার মানসিক অবস্থাপন্ন ।
“যিনি সর্ব প্রকার
স্বার্থান্বেষণ দূর করিয়াছেন, তিনিই সুখী; যিনি শান্তি লাভ করিয়াছেন, তিনিই সুখী;
যিনি সত্যের সন্ধান পাইয়াছেন, তিনিই সুখী। “সত্য মহান ও সুন্দর; সত্য তোমা দিগকে
অমঙ্গল হইতে মুক্ত করণে সক্ষম। সত্যভিন্ন
অন্যকোন ত্রাণকর্তা জগতে নাই। “সত্যকে
সম্পূর্ণ রূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিলেও উহাতে বিশ্বাস স্থাপন কর, যদিও উহার
মিষ্টতা তোমার নিকট তিক্ত অনুমিত হইতে পারে, যদিও উহার নিকটস্থ হইতে প্রথমে তোমার
কুণ্ঠাবোধ হইতে পারে। সত্যেবিশ্বাসবান হও। “সত্য যেরূপে বর্তমান সেরূপেই সর্বোৎকৃষ্ট। ইহা অপরিবর্তনীয়; কেহই ইহার উন্নতি সাধন করিতে
পারেন না। সত্যে বিশ্বাস করিয়া উহার
অনুসরণ কর।
“ভ্রান্তি বিপথে লইয়া যায়; মোহ
হইতে দুঃখের উৎপত্তি হয়। উত্তেজক মদিরার
ন্যায় উহামত্ততা আনয়ন করে; কিন্তু উহা মানুষ কে পীড়া গ্রস্ত ও তাহার বিরক্তির
উৎপাদন করিয়া অচিরেই অদৃশ্য হয়। “আত্মার
জ্ঞান জর বিশেষ; উহা ক্ষণস্থায়ী ছায়া মূর্তির ন্যায়, উহা স্বপ্ন মাত্র; কিন্তু
সত্য বাস্তবিক, সত্য মহান, সত্য অনন্ত। সত্য
ভিন্ন আর কিছুতেই অমরত্ব নাই। কারণ এক মাত্র সত্য অবিনশ্বর। ” এই রূপে ধৰ্মার্থ প্রকাশিত হইলে, পঞ্চভিক্ষু দিগের মধ্যে
সর্বাপেক্ষা বয়োবৃদ্ধ মাননীয় কৌণ্ডিণ্য মনশ্চক্ষে সত্যের দর্শন পাইলেন।
তিনি কহিলেন, “হে বুদ্ধ, তুমিই সত্যের সন্ধান পাইয়াছ। ” অনন্তর দেবগণ, সিদ্ধ পুরুষ গণ ও অতীত কালের দেহ মুক্ত পুণ্যাত্মাগণ তথাগতের উপদেশ শ্রবণ করিয়া তাহার ধর্ম মত গ্রহণ পূর্বক উচ্চকণ্ঠে কহিলেন, “মহা পুরুষ সত্যই ধর্ম রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন; তিনি পৃথিবীকে বিচলিত করিয়াছেন; তিনি ধর্ম চক্র প্রবর্তিত করিয়াছেন; ঐ চক্রের গতি দেবতা কিম্বা মনুষ, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কেহই রুদ্ধ করিতে পারিবে না। পৃথিবীতে সত্যরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে; উহা বিস্তৃতি লাভ করিবে; এবং মনুষ্য জাতির মধ্যে ন্যায় পরায়ণতা, উপচিকীর্ষা ও শান্তি রাজত্ব করবে। ” বারাণসীতে ধর্মোপদেশ সমাপ্ত।