জীবন বন্ধন

 জীবন বন্ধন

সিদ্ধার্থ যৌবনে পদার্পণ করিলে তাহার পিতা তাহার বিবাহ দিবার বাসনা করিলেন এবং স্বীয় আত্মীয় কুটুম্ব গণকে আদেশ প্রেরণ করিলেন যে, তাহারা যেন তাহাদের রাজ কুমারী গণকে আনয়ন করেন।  আগত রাজ কুমারী দের মধ্য হইতে রাজ কুমার নিজ স্ত্রী মনো নীত করিবেন।কুটুম্বগণ উত্তরে জানাইলেন, “রাজ কুমার তরুণ ও দুর্বল; তিনি শাস্ত্রা দিতে জ্ঞান লাভ করেন নাই।  


তিনি আমাদের কন্যাকে প্রতি পালনে অক্ষম এবং যুদ্ধ ঘটিলে তিনি শত্রু পক্ষকে প্রতি হত করিতে সমর্থ হইবেন না।” রাজ কুমার স্বভাবতঃ চিন্তা শীল ছিলেন, তিনি মুখর ছিলেন না।  তিনি পিতার উদ্যানে বিশাল জম্বু বৃক্ষ তলে অবস্থান করিতে ভাল বাসি তেন এবং সংসারের গতি পর্যালোচনা করিতে করিতে ধ্যান মগ্ন হইতেন।


আরো দেখুন: বোধিসত্বের সংসার ত্যাগ


আরো দেখুন: বোধিসত্বের জন্ম



জীবন বন্ধন

জীবন বন্ধন

রাজ কুমার পিতাকে কহিলেন, “কুটুম্ব গণকে নিমন্ত্রণ করুন।  উহারা আসিয়া আমাকে দেখুন ও আমার বল পরীক্ষা করুন।” পিতা পুত্রের অনুরোধ রক্ষা করিলেন।  কুটুম্বগণ আসিলে কপিলা বস্তু নগরীর জন সমূহ রাজ কুমারের শৌর্ষ ও বিদ্যাবত্তার পরীক্ষার জন্য সমাগত হইলেন।  রাজ কুমার দৈহিক ও মানসিক সকল প্রকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন।  


শৌষে, জ্ঞানে ও বিদ্যায় তাঁহার প্রতি দ্বন্দ্বী সমস্ত ভারতে ছিল না।  তিনি আগত জ্ঞানী গণের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন; কিন্তু যখন তিনি তাঁহা দিগকে প্রশ্ন করিলেন, তখন তাহাদের মধ্যে সর্বোচ্চ জ্ঞানীও উত্তর দানে অসমর্থ হইলেন।  তদন স্তর সিদ্ধার্থ স্বীয় স্ত্রী মনো নীত করিলেন।  তিনি স্বীয় পিতৃ স্বসা কন্যা কোলি রাজ দুহিতা যশো ধোরাকে নির্বাচিত করিলেন।  যশো ধরা রাজ পুত্রের বাগ দত্তা হইলেন।

 

বিবাহের পর যে পুত্র সন্তান জন্মিল, পিতা মাতা তাহার নাম রাখিলেন রাহুল।  নৃপতি শুদ্ধোদন পুত্রের উত্তরাধিকারীর জন্মে আনন্দিত হইয়া কহিলেন, “আমি যেমন কুমারকে ভাল বাসি, কুমারও নিজের পুত্রকে তেমনই ভাল বাসি বেন।  এই সন্তান প্রেমের কঠিন বন্ধন সিদ্ধার্থের হৃদয় কে সংসারে বদ্ধ করিয়া রাখিবে।  শাক্যকুলের রাজ্য আমার বংশ ধর দিগের দণ্ডা ধীন রহিবে।”  


সিদ্ধার্থ নিঃস্বার্থ হৃদয়ে পুত্রের শুভ কামনায় এবং প্রজা বর্গের মনো রঞ্জনার্থে ধর্মানুষ্ঠান পালন করিলেন।  তিনি পবিত্র গঙ্গায় দেহ স্নাত করিয়া ধৰ্ম বারি সেকে চিত্ত শুদ্ধি করিলেন।  সন্তান সন্ততিকে শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত করি বার জন্য মানুষ যে রূপ ব্যগ্র, তিনিও সেই রূপ সমস্ত পৃথিবীকে শান্তি দিবার জন্য একান্ত অভি লাষ করিয়া ছিলেন।

 

ত্রিবিধ দুঃখ

নৃপতি রাজ পুত্রের জন্য যে প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া ছিলেন, উহা ভারতের সর্বোৎকৃষ্ট ভোগ্য বস্তু সমূহে পরি পূর্ণ ছিল।  কারণ তিনি পুত্রকে সুখী দেখি বার জন্য অতিশয় উৎসুক ছিলেন।  সর্ব প্রকার দুঃখ জনক দৃশ্য, সর্ব বিধ যাতনা এবং দুঃখের অস্তিত্ব সিদ্ধার্থের দৃষ্টি পথের বহি ভুত করিয়া রাখা হইয়া ছিল। 


জগতে অমঙ্গলের অস্তিত্ব তাঁহার অবিদিত ছিল।  কিন্তু শৃঙ্খলিত হন্তীর চিত্ত যেরূপ অরণ্যের দিকে ধাবিত হয়, সেই রূপ রাজ কুমার জগত দেখিবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছিলেন।  তিনি পিতার অনুমতি প্রার্থনা করিলেন।  শুদ্ধোদন চতুরশ্ব যোজিত রত্ন মুখ রথ প্রস্তুত করিতে আদেশ করিলেন। ইহাও আদিষ্ট হইল যে, রাজ কুমারের গম্য মার্গ সমূহ সুসজ্জিত রহিবে।

 

নগরের গৃহ সমূহ যবনিকা ও পতাকায় সুশোভিত হইল এবং পথের উভয় পার্শ্বে দর্শ কম ণ্ডলী উৎসুক নেত্রে ভাবী নৃপতির দিকে চাহিতে লাগিলেন।  এই রূপে সিদ্ধার্থ রথা রোহণে সারথী ছন্নের সহিত নগরীর বর্ত্ম সমূহ অতি ক্রম করিয়া একটি জন পদে উপস্থিত হইলেন।  স্থানটি ক্ষুদ্র নদী সিক্ত ও সুদৃশ্য বৃক্ষ সমন্বিত।  ঐ স্থানে পথি পার্শ্বে এক জন বৃদ্ধ তাহাদের দৃষ্টি গোচর হইল। 


বৃদ্ধের নত দেহ, কুঞ্চিত মুখ মণ্ডল এবং দুঃখ সূচক ললাট দেখিয়া রাজ পুত্র ছন্নকে কহিলেন, “ইনি কে? ইহার মস্তক শুভ্র, চক্ষু দৃষ্টি হীন এবং দেহ বিশুষ্ক।  ইনি দণ্ডের সাহায্যেও চলিতে অক্ষম!”  উত্তর দিতে ক্লিষ্ট সার থীর সাহস হইতে ছিল না।  সে কহিল, “এই সমূদয় বার্ধক্যের চিহ্ন।  এই ব্যক্তিই এক সময়ে স্তন্যপায়ী শিশু ছিল, যৌবনে আমোদ প্রিয় ছিল।  কিন্তু এক্ষণে কালের গতিতে তাহার সৌন্দর্য আর নাই, তাহার জীবনী শক্তি নষ্ট হইয়াছে। ”

 

সাথীর বাক্যে সিদ্ধার্থ অতিশয় বিচলিত হইলেন।  বার্ধক্যের ক্লেশের জন্য তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন।  তিনি মনে মনে চিন্তা করিলেন, “মানুষ যখন জানে যে, তাহাকে শীঘ্রই শুষ্ক ও নষ্ট হইতে হইবে, তখন কি আনন্দ, কি সুখ তাহার পক্ষে পাওয়া সম্ভব ? পরক্ষণেই যাইতে যাইতে, একটী পীড়িত মানুষ দৃষ্ট হইল।  সে অতি কষ্টে শ্বাস গ্রহণ করিতে ছিল; সে বিকলাঙ্গ, স্নায়বিক আক্ষেপঞ্জিষ্ট এবং যন্ত্রণায় আর্তনাদ করিতে ছিল। 


রাজ কুমার সারথীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি প্রকার মনুষ্য?” সারথী উত্তর করিল, “এ ব্যক্তি পীড়িত।  ইহার দেহের চারি উপাদান শৃঙ্খলাচ্যুত ও বিকল হইয়াছে। আমরা সকলেই এই অবস্থার অধীন। ধনী, নির্ধন, অজ্ঞান, জ্ঞানী, দেহ ধারী সর্ব বিধ প্রাণীই এই অবস্থাপন্ন হইবে।” এই বার সিদ্ধার্থ আরও বিচলিত হইলেন।  সর্ব প্রকার ভোগ সুখ তাহার নিকট নিরর্থক বোধ হইল।  তিনি পার্থিব আনন্দকে হেয় জ্ঞান করিলেন।

 

বিষাদের দৃশ্য হইতে পলায়নের জন্য সারথী বেগে রথ চালিত করিল, কিন্তু অকস্মাৎ তাহাদের দ্রুত গতি রুদ্ধ হইল।  চারি জন মানুষ একটি শব দেহ বহন করিয়া চলিয়া গেল।  প্রাণ হীন দেহের দৃশ্যে ভীত হইয়া রাজ কুমার সারথীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহারা কি বহিতেছে? পতাকা ও পুষ্প মাল্য সমূহ দৃষ্ট হইতেছে; কিন্তু যাহারা পশ্চাতে অনুসরণ করিতেছে তাহারা শোকে অভি ভূত!” সারথী উত্তর করিল, “উহা একটি মনুষ্য।  


ইহার দেহ অনম্য এবং প্রাণ হীন; ইহার চিন্তা শক্তি নিক্ৰিয়; প্রিয় স্বজন ও মিত্র বর্গ এখন ইহার শব দেহ শ্মশানে লইয়া যাইতেছে।”  রাজ পুত্র ভয়ে ও বিস্ময়ে অভি ভূত হইলেন।  “ইহাই কি এক মাত্র মৃত মনুয়? কিম্বা জগতে এরূপ দৃষ্টান্ত আরও আছে?” তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন।  

 

দুঃখ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে সারথী উত্তর করিল, “সমস্ত জগতেই এই ব্যাপার চলিতেছে।  জীবন আরম্ভ করিলেই শেষ করিতে হইবে; মৃত্যুর হস্ত হইতে পরিত্রাণ নাই।” রাজ পুত্রের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হইল, তাহার বাক্য স্ফুর্ত্তি স্পষ্ট হইল না।  তিনি উচ্চ কণ্ঠে কহিলেন, “সংসার কৃষ্ট মনুষ! তোমার মোহ কি বিষময়! তোমার দেহ ধুলিতে পরিণত হইবে ইহা অনিবার্য; তথাপি তুমি নিশ্চিন্ত, নিশ্চেষ্ট হইয়া বাঁচিয়া চলিয়াছ।” দুঃখের দৃশ্য সমূহ রাজ কুমারের চিত্তে গভীর ভাবে অঙ্কিত হইয়াছে দেখিয়া সারথী অশ্বগণকে ফিরাইয়া নগরে প্রত্যাবর্তন করিলেন।  


যখন তাহারা সন্ত্রান্ত রাজ পুরুষ দিগের প্রাসাদ সমূহ অতি ক্রম করিতে ছিলেন, তখন শুদ্ধোদনের ভ্রাতুস্পুত্রী যুবতী রাজ কুমারী কৃশা গৌতমী সিদ্ধার্থকে দেখিলেন।  সিদ্ধার্থের পৌরুষ ও সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হইয়া এবং তাহার মুখ মণ্ডলের চিন্তা শীলতা অবলোকন করিয়া কৃশা গৌতমী কহিলেন, “যে পিতা তোমার জনক, তিনি সুখী; যে মাতা তোমাকে পালন করিয়াছেন, তিনি সুখী; যে স্ত্রী তোমার ন্যায় মহা পুরুষকে স্বামী বলিয়া বরণ করিয়াছেন, তিনি সখী। ”

 

রাজ কুমার এই অভিনন্দন শুনিয়া কহিলেন, “যাহারা মুক্তি লাভ করিয়াছে, তাহারাই সুখী।  আমি মানসিক শান্তির প্রার্থী, আমি নির্বাণের পরমানন্দ অন্বেষণ করিব।” তৎপরে রাজ পুত্রীর নিকট যে উপদেশ পাইলেন, ঐ উপদেশের পুরস্কার স্বরূপ স্বীয় মহা মূল্য মুক্তা কণ্ঠা ভরণ তাঁহাকে দান করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন।  সিদ্ধার্থ তাহার প্রাসাদের মূল্য বান দ্রব্য সমূহের প্রতি ঘৃণা পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। 


স্ত্রী তাহাকে সাদরে আহবান করিয়া তাহার সস্তাপের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কহিলেন, “আমি সর্বত্র পরিবর্তনের চিহ্ন দেখিতেছি; তজ্জন্য আমার হৃদয় ভার গ্রস্ত।  মনুষ্য বার্ধক্য, ব্যাধি ও মরণ পীড়িত।  জীবনে আস্থার নিবৃত্তি সাধন করিতে উহাই যথেষ্ট। ” শুদ্ধোদন পুত্রের ভোগ সুখে বিরতির সংবাদ অবগত হইয়া শোকাভিভূত হইলেন।  তাহার হৃদয় যেন অসিবিদ্ধ হইল।  জীবন বন্ধন ও ত্রিবিধ দুঃখ সমাপ্ত। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url