অনাথপিণ্ডিক

 অনাথপিণ্ডিক

এই সময়ে রাজ গৃহ নগরে অনাপপিণ্ডিক নামক এক জন প্রভূত ধন শালী।  ব্যক্তি আসিয়া ছিলেন।  দান শীলতার জন্য তিনি ‘পিতৃ মাতৃ হীনের প্রতি পালক এবং দরিদ্রের বন্ধু’ আখ্যা প্রাপ্ত হইয়া ছিলেন। পৃথিবীতে বুদ্ধ অবতীর্ণ হইয়া নগরের উপকণ্ঠস্থ বেণুবনে অবস্থান করিতেছেন শুনিয়া তিনি রাত্রি কালেই পুণ্যাত্মার দর্শন মানসে যাত্রা করিলেন।  


দর্শন মাত্রেই পুণ্যাত্মা অনাথপিণ্ডিকের হৃদয়ের অকৃত্রিম গুণ রাশি অবলোকন করিয়া শান্তি প্রদ পূতবাক্যে তাঁহার অভ্যর্থনা করিলেন।তাহারা একত্রে উপবেশন করিলেন।  তৎপরে অনাপপিণ্ডিক পুণ্যাত্মার মুখ নিঃসৃত মধুর সত্য শ্রবণ করিলেন।  বুদ্ধ কহিলেন জগৎ অহরহ ব্যাপৃত, স্থৈর্যহীন ইহাই বেদনার মুল।  চিত্তের যে প্রশান্ত অবস্থায় অমরত্বের শান্তি অনুভূত হয়, ঐ অবস্থা লাভে যত্নশীল হও।  আত্মা বিমিশ্র শুণ সমূহের সমষ্টি মাত্র, উহা স্বপ্নের ন্যায় অসার।


আরো দেখুন: বোধিসত্বের জন্ম

আরো দেখুন: হেমবত্ত সূত্র

 

অনাথপিণ্ডিক

অনাথপিণ্ডিক

“কে আমাদিগের জীবন গঠন করে? ঈশ্বর, ব্যক্তিক সৃষ্টি কর্তা? ঈশ্বর যদি সৃষ্টি কর্তা হন, তাহা হইলে সর্ব প্রাণী নীরবে স্রষ্টার ক্ষম তার বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য।  তাহারা কুম্ভ কারের হস্ত নির্মিত পাত্রের ন্যায়; যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ধর্মাচরণ কি প্রকারে সম্ভব? যদি ঈশ্বর জগতের সৃষ্টি কর্তা হইতেন তাহা হইলে দুঃখ, দুর্দৈব কিম্বা পাপের অস্তিত্ব থাকিত না; কারণ শুভ ও অশুভ উভয় বিধ কর্মই তাহা হইতে আসিবে।  


যদি তাহা না হয়, তাহা হইলে তিনি ব্যতীত অপর কারণ বিদ্যমান, অর্থাৎ তিনি স্বয়স্ভূ, নহেন।  সুতরাং দেখিতেছ, ঈশ্বরের কল্পনা ভিত্তি হীন।  “ইহাও কথিত হয় যে, নিগুণ ঈশ্বর আমাদি গের সৃষ্টি কর্তা।  কিন্তু যাহা নির্গুণ তাহা কারণ হইতে পারে না।  চতুর্দিকন্তু সমুদয় বস্তু কারণ সম্ভুত, যে রূপ বীজ হইতে বৃক্ষের উৎপত্তি; কিন্তু নিণ ঈশ্বর কি প্রকারে সম ভাবে সর্ব স্তর কারণ হইতে পারেন? যদি তিনি বস্তু সমুহে ব্যাপ্ত হন তাহা হইলে ইহা নিশ্চিত যে তিনি উহাদের সৃষ্টি কর্তা নহেন।  

 

“ইহাও কথিত হয় যে আত্মই সৃষ্টি কর্তা।  যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে তিনি বস্তু সমুহকে সুখ প্রদ করিয়া সৃষ্টি করেন নাই কেন? দুঃখ ও সুখের কারণ বাস্তবিক এবং বাহ্য বস্তু ঘটিত।  আত্ম কর্তৃক কি প্রকারে উহা সৃষ্ট হইতে পারে? “পুনশ্চ, যদি বলাযায় যেসৃষ্টি কর্তানাই, সকলই আমাদিগকে অদৃষ্ট, কার্যকারণ ভাবের অস্তিত্ব নাই, তাহা হইলে লক্ষ্যবস্তু হইয়া জীবন গঠনের প্রয়োজন কি? “তজ্জন্য আমাদিগের মত এই যেবস্তু মাত্রই কারণ সস্ভূত।  


অপিচ সগুণকি নির্গুণ, ঈশ্বর কিম্বা আত্মকিম্বা কারণহীন দৈব, সৃষ্টি কর্তানয়।  আমাদের কর্ম, শুভ ও অশুভ উভয় বিধ ফলই উৎপাদন করে।

“সমস্ত জগত কার্য কারণ ভাব সম্বন্ধীয় নিয়মের অধীন, এবং ক্রিয়া শীল কারণ সমূহ অমানসিক নহে, কারণ, স্বর্ণ পাত্র বিশেষে পরিণত হইয়াও স্বর্ণই থাকে। 

 

“ঈশ্বরের উপাসনা ও তাহার নিকট প্রার্থনা সত্যপথ নহে, ঐভ্রান্ত মার্গ পরিত্যাগকর; বৃথা অনুধ্যান ও নিস্ফল কূটতর্ক বর্জনকর; অহংকার এবং সর্বপ্রকার আত্মপরতা বিসর্জন দাও; যেহেতু সব বস্তু কর্ম কারণ ভাব সম্বন্ধীয়।  নিয়ম দ্বারা স্থিরীকৃত, সেই হেতু মঙ্গল আচরণ কর, উহা হইতে মঙ্গলের উৎপত্তি হইবে।”


তদনন্তর অনাথপিণ্ডিক কহিলেন, “আমি বুঝিয়াছি আপনি বুদ্ধ, পরম পুরুষ, পবিত্র তার আধার; আমার মনের দ্বার আপনার নিকট উদঘাটিত করিব, আমার বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার কর্তব্য সম্বন্ধে আমাকে উপদেশ দিন।  ‘আমার জীবন কর্ম পূর্ণ, প্রভূত ধন সঞ্চয় করিয়া আমি দুশ্চিন্তা ক্লিষ্ট।  তথাপি আমার কর্মেই আমি সুখী; আমি পূর্ণ আয়াস সহ কারে উহাতে রত হই।  বহু জন আমার অধীনে নিযুক্ত, তাহারা আমার ব্যবসায়ের সফল তার উপর নির্ভর করে।

 

“কিন্তু আপনার শিষ্য বর্গ সন্ন্যাসের সুখময় অবস্থারই প্রশংসা করেন এবং জগতের চাঞ্চল্যের নিন্দা করেন।  তাহারা কহেন, পুণ্যাত্মা রাজ্য ও পৈতৃক ধনৈশ্বর্য পরি ত্যাগ করিয়া ধৰ্ম মার্গ আবিষ্কার করিয়াছেন, এই রূপে তিনি সমস্ত জগতকে নিবাণ প্রাপ্তির উপায় প্রদর্শন করিয়াছেন। “ন্যায় পথে চলিয়া সব প্রাণীর মঙ্গল করণে সক্ষম হইতে আমার একান্ত বাসনা।  


তজ্জন্য জিজ্ঞাসা করিতেছি, আমি কি ধনৈশ্বর্য, গৃহ, ব্যবসা সমুদয় পরি ত্যাগ করিয়া ধার্মিক জীবনের পরম সুখময় অবস্থা লাভ করিবার জন্য আপনার ন্যায় সন্ন্যাস আশ্রয় করিব?” বুদ্ধ উত্তর করিলেন, “মহান অষ্টাঙ্গ মার্গে প্রবিষ্ট ব্যক্তি মাত্রই ধার্মিক জীবনের।  পরম সুখময় অবস্থা লাভ করিতে সক্ষম।  


যিনি ধন সম্পদে তাহার অত্যধিক আসক্ত, তাহার পক্ষে উহা ত্যাগ করাই শ্রেয়, কারণ উহাতে তাহার অন্তঃকরণ বিষাক্ত হইতে পারে; কিন্তু অনাসক্ত হইয়া যিনি ধনের সদ ব্যবহার করেন, তিনি সর্ব প্রাণীর মঙ্গল করণে সক্ষম।  “আমি তোমাকে কহিতেছি, তুমি জীবনের বর্তমান অবস্থা রক্ষা করিয়া আয়াস সহকারে স্বকর্মে প্রবৃত্ত হও।

 

জীবন, ধন, কিম্বা প্রভুত্ব মনুষ্যকে দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ করে না, ঐ বস্তু সমূহে অত্যধিক আসক্তিই তাহার দাসত্বের কারণ।  “যে ভিক্ষু স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করিবার উদ্দেশ্যে সংসার ত্যাগ করেন, তিনি লাভ বান হইবেন না।  কারণ অলস জীবন অতি ঘৃণিত এবং উদ্যমের অভাব ঘৃণ্য।  “তথাগতের ঘোষিত ধর্ম কাহাকেও সন্ন্যাস আশ্রয় কষিতে কিম্বা বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে কাহাকেও সংসার ত্যাগী হইতে কহে না; তথাগতের ধর্ম প্রত্যেক মনুষ্যকে অহংকারের মোহ হইতে মুক্ত হইতে, স্বীয় অন্তঃকরণের বিশুদ্ধতা সম্পাদন করিতে, ভোগ সুখের তৃষ্ণা পরিহার করিতে এবং সাধু জীবন যাপন করিতে শিক্ষা দেয়।  


‘মানুষ যাহাই করুক, সংসারে থাকিয়া শিল্পী, বণিক এবং রাজ কর্ম চারীই হউক, কিংবা সংসার ত্যগী হইয়া ধর্ম চিন্তায় নিরত হউক, সর্বান্তঃকরণে তাহাকে স্বীয় কর্মে নিযুক্ত হইতে হইবে; তাহাকে পরি শ্রম ও উদ্যম শীল হইতে হইবে।  এইরূপে পদ্ম যেমন জলে উৎপন্ন ও বর্ধিত হইয়াও জল স্পষ্ট নহে, মানুষও যদি।  সেই রূপ দ্বেষ ও হিংসার বশ বর্তী না হইয়া জীবন সংগ্রামে রত হয়, যদি সে অহংকারের অনুসরণ না করিয়া সত্যের অনুগামী হয়, তাহা হইলে নিঃসন্দেহ রূপে সে শান্তি ও পরমানন্দ অনুভব করিবে। ”

 

দান সম্বন্ধে উপদেশ

অনাথপিণ্ডিক পুণ্যাত্মার বাক্যে আনন্দিত হইয়া কহিলেন, “আমি কোশলের রাজ ধানী শ্রাবন্তি নগরে বাস করি।  ঐ রাজ্য ফল শস্য পূর্ণ এবং তথায় শান্তি বিরাজ করিতেছে।  প্রসেনজিং তথাকার রাজা, প্রজা বর্গের মধ্যে ও নিকটস্থ স্থান সমূহে তাহার নাম বিদিত।  


আমি ঐ স্থানে একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করিব, ঐ বিহার ভব দীয় সঙ্ঘের ধর্মানু শীলনের স্থান হইবে; আমার প্রার্থনা আপনি দয়া করিয়া উহা গ্রহণ করুন।” বুদ্ধ দেব অনাথ প্রতি পালকের হৃদয়ের অন্তরে প্রবেশ করিলেন; নিঃস্বার্থ দানই তাহার এক মাত্র উদ্দেশ্য ইহা অবগত হইয়া বুদ্ধ ঐ দান গ্রহণে সম্মত হইয়া কহিলেন:

 

“দান শীল মনুষ্য সকলেরই প্রিয়; তাহার বন্ধুত্ব অতি মূল্য বান বিবেচিত হয়; মৃত্যুতে তাহার অন্তঃকরণ বিভ্রান্ত ও আনন্দ পূর্ণ, কারণ তাঁহার অনুতাপ নাই; তিনি পুরস্কারের মুকুলিত পুষ্প ও তৎপ্রসূত ফল লাভ করেন।  “অনুধাবন করা কঠিন: নিজের খাদ্য বিতরণ করিয়া আমরা অধিক শক্তি প্রাপ্ত হই, নিজের বস্ত্র অপরকে দান করিয়া আমরা অধিকতর সৌন্দর্য শালী হই, বিশুদ্ধ ও সত্যের জন্য আবাসের প্রতিষ্ঠা করিয়া আমরা বৃহৎ ধন ভাণ্ডারের অধিকারী হই।  ‘দানের উপযুক্ত সময় ও প্রণালী আছে; বীর্য বান যোদ্ধা যেরূপ যুদ্ধ যাত্রা করেন, দান করিতে সমর্থ ব্যক্তিও তদ্রুপ।  তিনি সমর্থ যোদ্ধার ন্যায়, তিনি শক্ত ও সমর কুশল বীর।

 

“প্রীতি ও করুণা প্রণোদিত হইয়া ভক্তির সহিত তিনি দান করেন এবং হৃদয় হইতে সর্ব প্রকার দ্বেষ, হিংসা ও ক্রোধ দূর করেন।  দান শীল ব্যক্তি মুক্তির মার্গ প্রাপ্ত হইয়াছেন।  বাল বৃক্ষ রোপণ কারী মনুষ্য যেরূপ ভবিষ্যতে উহার ছায়া, পুষ্প ও ফল উপভোগ কবে, তিনিও তদ্রুপ। দানের ফলও সেই রূপ; ক্লিষ্টের সাহায্য কারীর আনন্দও তদ্রুপ; নির্বাণও তদ্রুপ।  


“নিরব চ্ছিন্ন করুণা অমরত্বের পথ প্রদর্শী; করুণা ও দানে পূর্ণতা সাধিত হয়। ” অনাথপিণ্ডিক কোশলে প্রত্যাবর্তন কালে, বিহার নির্মাণার্থে রম্য স্থান নির্বাচন করি বার জন্য শারি পুত্রকে তাঁহার সমভিব্যাহারে যাইতে নিমন্ত্রণ করিলেন।  অনাথপিণ্ডিক কাহিনী সমাপ্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url