ইসিদাসী

 ইসিদাসী

গঙ্গা সৈকতে সুখা সীনা দুই জন ভিক্ষুণী।  উভয়েই যুবতী, যৌবন সুষমায় সুরভিতা।  উভয়েই জ্যোতির্ময়ী।  সমুজ্জ্বল আনন, প্রসন্ন দৃষ্টি, সংযত বাক্যে, সুসংযত কায় ও মন, ভাব গম্ভীর মুখ মন্ডল।  তাঁদের দেখলে শ্রদ্ধার অন্তর আপ্লুত হয় মস্তক নত হয়ে পড়ে।  দিবা দ্বি প্রহর নির্জন মনোরম স্থান।  সম্মুখে তর তর বাহিনী শৈলসুতা গঙ্গা।  বসন্তের মৃদুমন্দ পবন হিল্লোল, পাদপনি কুসুম সম্ভারে সুশোভিত, নিবিড় ছায়া সেবিত বিট পীমূল, বিবেক পূর্ণ পরিবেশ।


আরো দেখুন: শুভা


আরো দেখুন: সুমেধা পূর্ব জন্ম


ইসিদাসী

ইসিদাসী

এক জন ইসিদাসী, অপর বোধি।  তাঁদের মধ্যে খুব ভাব, পরস্পর পরস্পরের প্রতি মৈত্রীময় অন্তর।  তাঁরা উভয়ে পাটলী পুত্র নগরে একসঙ্গে অন্ন ভিক্ষায় নিরত হয়ে ছিলেন।  নদী সৈকতে বসে ভোজন কৃত্য সম্পন্ন করলেন, পান করলেন গঙ্গার স্বচ্ছ সুশীতল পরিশ্রুত জল।  তাঁর পর নিবিড় ছায়া সম্পন্ন পাদ পমুলে বিশ্রাম মানসে সমাসীন হলেন।ভিক্ষুণী বোধি ইসিদাসীকে দেখলেন অনন্য দৃষ্টিতে, সমুৎসুক মনে।  বললেন স্মিত হাস্যে “ইসিদাসী, তুমি এখন পূর্ণ যুবতী। 


তোমার কান্তিময় দেহে উচ্ছল হয়ে পড়েছে যৌবন লালিত্য।  অভি রূপ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, কেমন সুন্দর মনো মোহন লক্ষণ বতী তুমি! আমি জানতে চাই, যুবতীর স্পৃহণীয় মদিরময় বিলাস ব্যসনে কেন তুমি বীত শ্রদ্ধ হয়েছ? কেন হয়েছ কামিনী কাম্য, সুখ ভোগের প্রতি বিরাগ? সংসারের কোন অবিচারে নিপীড়িত হয়ে বিরাগিণী বেশে গৃহ ত্যাগ করেছ? কেন তুমি প্রব্রজ্যার আশ্রয় নিয়েছ? প্রত্যুত্তরে ইসিদাসী বললেন “তবে শোন বোধি, আমার সে করণ কাহিনী। উজ্জয়িনী নগরে আমার পিত্রালয়।  পিতা আমার মহা ধন শালী।  তিনি সজ্জন ও ধর্ম পরায়ণ।  তাই তিনি “ধার্মিক শ্রেষ্ঠী” নামে সুপরিচিত।  আমি মাতা পিতার একমাত্র কন্যা।  তাই তাঁদের আমি ছিলাম অতি প্রিয় ও আনন্দ দায়িনী।


আমার পরিণত বয়সে সাকেত নগর হতে আমার বিবাহের প্রস্তাব উপস্থিত হয়ে ছিল।  বর বংশ মর্যাদা সম্পন্ন ধন বান শ্ৰেষ্ঠীর সময় মহা আড়ম্বরের সাথে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল।  আমি ধন বান শ্ৰেষ্ঠীর পুত্র।  সমজাতি ও সম অবস্থা দর্শনে পিতা সম্মত হলেন।  যথা সময় মহা আড়ম্বরের সহিত বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল।  আমি ধন বান শ্রেষ্ঠীর পুত্র বধূ হলাম।  স্বভাবতই আমি ছিলাম ভদ্র বিনীত। শ্বশুর কুলের গৌরব রক্ষার ও রীতি নীতি প্রতি পালনের প্রতি খুব যত্নবান ছিলাম।  প্রাতঃ সন্ধ্যা শ্বশুর শাশুড়ীকে প্রণাম করে তাঁদের পদ ধূলি মস্তকে ধারণ করতাম।  স্বামীর ভগ্নী, ভ্রাতা ও পরিজন বর্গের যে কাউকেও দেখলে শশব্যস্তে আসন প্রদান করতাম।  অন্ন পানীয়, খাদ্য ভোজ্য ইত্যাদি সমভোগে পরিবেশন করে তাঁদের সুখী করতাম।


সকলের পূর্বেই শয্যা ত্যাগ করে সম্মার্জন ও প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনের পর কৃতাঞ্জলি হয়ে স্বামীর নিকট গমন করতাম এবং চিরুনি, দর্পণ, মুখ বিলেপন, অঞ্জন ইত্যাদি প্রসাধনী নিয়ে সুবিনীতা পরিচারিকার মত স্বীয় হন্তে স্বামীকে বিভূষিত করতাম।  সহস্তে রন্ধন কার্য শেষ করে পত্রাদি ধৌত করতাম, মাতার এক মাত্র পুত্রের ন্যায় মমতাময় অন্তরে স্বামীর সেবা যত্ন করতাম স্বামী ভক্তি পরায়ণা ও স্বামী গত প্রাণা হয়ে সর্বক্ষণ স্বামীর সন্তোষ বিধানে তৎপর থাকতাম, তবুও স্বামী আমার প্রতি বিমুখ হলেন।  আমার ন্যায় অনুপমা সেবিকা, নির ভিমান, প্রত্যুষে সর্বাগ্রে শয্যা ত্যাগ শীলা, পতি গত প্রাণা, অনলসা, ধর্ম শীল, স্বামীর হিতৈষিণী পত্নী স্বামীর অসহ্য।


তিনি জনক জন নীকে বললেন “আমি গৃহ ত্যাগী হব।  আপনারা আমায় অনু মতি দেন, আমি সংসার ছেড়ে চলে যাই। ” মাতা পিতা ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “কেন পুত্র, গৃহ ত্যাগ করবে কেন?” তিনি বললেন “ইসিদাসী আমার অসহ্য হয়েছে। ” মাতা পিতা ব্যস্ত হয়ে বললেন “পুত্র, এমন কথা বলো না।  ইসিদাসী বিদুষী, বুদ্ধি মতী, গুণবতী, অতি প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ শীলা, নিরলসা।  তাঁর প্রতি কেন বিরক্ত হলে? সে কি কোন ও অনিষ্ট করেছে”? তিনি স্থির কণ্ঠে বললেন “সে অনিষ্ট না করলেও, আমার পক্ষে অসহ্য হয়েছে।  সে গুণ বতী হলেও, তাঁর সঙ্গে বাস করতে পারবো না।” তাঁর মাতা পিতা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন “পুত্র এমন বলোনা।  সেনির্দোষ হলে, তোমার অসহ্যহবার কারণকি? তোমারকি মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে? এরূপ গুণশীলা মেয়ে পাওয়াদুষ্কর।


এমন নির্দোষ লক্ষ্মী স্বরূপা বধূ মাতাকে আমরা ত্যাগ করতে পারবো না। ” স্বামী রুষ্ট হয়ে বললেন “তাঁকে তো ত্যাগ করতে বলছি না; বলছি, আমিই গৃহ ত্যাগী হবো।  একে নিয়ে আপনারা সুখে থাকুন।  শাশুড়ী বিমর্ষ হয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন “তুমি কি কোনো অপরাধ করেছো? নিঃসঙ্কোচে সত্য বল। ” আমি বাষ্পকুল কণ্ঠে বললাম “মা, আমি কোনও অপরাধ করিনি, কোন অনিষ্টও করিনি, কোন দিন কোন কটু কথাও বলিনি, তিনি কেন বিরূপ হয়ে ছেন তাও জানি না।  দাসীর মত সেবা করেছি, পরিচর্যা করেছি।  তাঁর সন্তোষ বিধানের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, প্রাণাধিক ভালবেসেছি।  তবুও যদি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, আমার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। ”


শ্বশুর শাশুড়ী মর্মান্তিক দুঃখে অভি ভূত হয়ে পড়লেন, তথা শ্বশুর কুলের সবাই।  তখন আমি দুঃখে ক্ষোভে অপমানে রোদন করতে লাগলেন।  পুত্ৰ গৃহ ত্যাগী হবেন মনে করে তাঁরা ভীত হয়ে পড়লেন।  আমার জন্য কি তাঁরা পুত্র হারাবেন? শ্বশুর সজল নয়নে আমায় বললেন “বৌমা, আমাদের কপাল মন্দ, ছেলের মতি গতি কেন এরূপ হল কিছুই বুঝলাম না।  


কি করবো, তোমায় বিদায় দেবার আমার মোটেই ইচ্ছা নেই তবুও বিদায় দিতে হচ্ছে।  তুমি প্রস্তুত হও, আমি গিয়ে দিয়ে আসবো।” শ্বশুরের আদেশ পেয়ে আমি প্রস্তুত হলাম।  শাশুড়ী আমার সর্বালঙ্কারে বিভূষিত করবার ইচ্ছা করলেন।  কিন্তু, আমি রাজী হলাম না।  বললাম “এতে আমার সুখের যাওয়া নয় মা।” শাশুড়ীর পায়ের উপর মস্তক রেখে প্রণাম করলাম। 


শাশুড়ী আমাকে বুকে চেপে ধরে বহু ক্রন্দন করলেন।  তাঁর পর শশুরালয়ের সকলের নিকট বিদায় নিয়ে শ্বশুরের সঙ্গে পিত্রালয় অভি মুখে রওনা হলাম।  পিতৃ ভবনে উপনীত হলে শ্বশুর পিতাকে সকল কথা বললেন।  আরো বললেন “আজ হতে আমরা লক্ষ্মী হীন হলাম। ” শ্বশুর সজল নেত্রে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।  বলা বাহুল্য, তিনি আমার পিতাকে আমার সমস্ত অলঙ্কার ও বহু অর্থ দিয়ে গেলেন, আমার পিতার অনিচ্ছা সত্বেও।  


পিতা খুব মর্ম বেদনা অনুভব করলেন।  কিন্তু, তা বহি প্রকাশ হল না, অন্তঃসলিলা ফলগুর মত।  তিনি আমাকে বহু উপদেশ ও আশ্বাস বাণী শোনালেন।  তবুও কিন্তু, আমার অন্তরে সকল সময় একটা প্রশ্ন জেগে উঠত “কেন এরূপ হল? নির্দোষ সেবা পরায়ণা হয়েও স্বামীর অসহ্য ও অবজ্ঞার পাত্রী হলাম কেন? এ প্রশ্নের সমাধান তখন আমি করতে পারি নি।   অবিদ্যার ঘনান্ধকারে তা আবৃত্ত ছিল। ”


আমার পিতা পুনরায় আমাকে পাত্রস্থ করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।  তাঁর প্রয়াস সফল হল।  আমার ভূত পূর্ব শ্বশুর প্রদত্ত অর্থের অর্ধ পরিমাণ ব্যয় করে দ্বিতিয় বার এক ধন বানের পুত্রের সাথে আমার বিবাহ দিলেন।  মাত্র এক মাস সেখানে অবস্থান করার পর সেখান হতেও বহিস্কৃত হলাম।  অথচ আমি ছিলাম নির্দোষ ও শীল বর্তী।  ক্রীত দাসীর মত স্বামী সেবায় নিরত ছিলাম।  তবুও এরূপ মন্দ ভাগ্য।  আমার।  অভাগা যে দিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়।  আমি যে দিকে চাই, সে দিকই শুকিয়ে যায়; যে ডাল ধরি, সে ডালই ভেঙ্গে যায়।  এরূপ দুর্ভোগ যে, কোন দারুণ পাপের ফল, তখন তা অজ্ঞাত ছিলাম।  আমার দুর্ভাগ্য জীবন দুর্বহ হয়ে উঠল।


এমন সময় দ্বারে দ্বারে ভিক্ষায় রত এক সন্ন্যাসীকে দেখে পিতা তাঁকে বললেন “তোমার চীবর বাস ও ভিক্ষা পাত্র ত্যাগ করে আমার।  গৃহে অবস্থান কর এবং আমার জামাতা হও। ” বাবার কথায় সন্ন্যাসী সম্মত হলেন।  তৃতীয় বার আমার বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল।  পবিত্র সন্ন্যাস ধর্ম ত্যাগ করে তিনি আমায় পত্নী রূপে বরণ করে নিলেন।  আমি সুখী ও কৃতার্থ হলাম এবং নতুন স্বামীর চিত্ত বিনোদনের জন্য যত্ন পর হলাম।  


দেখ বোধি, সংসার কেমন বৈচিত্রময়? কামিনীর কামনা।  চরিতার্থের জন্য সন্ন্যাসীকেও স্বামী রূপে পেতে ইচ্ছা করে, পেলে সুখী হয়, কৃতার্থ হয়! আমি ছিলাম এমন দুরাশায় নারী।  এমন দুর দৃষ্ট আমার।  মাত্র এক পক্ষ কালের পর আমার অজ্ঞাত নিগুঢ় কর্মের তাড়নায় ইনিও বিরূপ হলেন, আমার সংসর্গ তাঁর অসহ্য হল।  তিনি বিতৃষ্ণা মনে পিতাকে বললেন “শ্রেষ্টী প্রবর, আমার ছিন্ন বস্ত্র ও ভিক্ষা পাত্র ফিরিয়ে দিন, আমার ভিক্ষা বৃত্তিই শ্রেয়। ”


হঠাৎ তাঁর একথা শুনে মাতা পিতা বিমর্ষ হলেন।  মাতা ও জ্ঞাতি বর্গ।  আমাদের ধন সম্পদ ও সুখ ভোগের কথা বলে তাঁকে প্রলোভিত করার প্রয়াস পেলেন।  কিন্তু, তিনি সব কিছুতেই উপেক্ষা ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করলেন।  অগত্যা মাতা তাঁকে বললেন “এ সুরম্য প্রাসাদ এবং আমাদের যা সম্পদ সমস্তই তোমার, তুমিই হবে এর সর্বেসর্বা, যেহেতু আমাদের এক মাত্র সন্তান ইসিদাসী।  তাই বলছি, তুমি এখানে অবস্থান কর। ” তিনি বিরক্তির স্বরে বললেন “আমি সম্পদ চাই না, অট্টালিকা চাই , আমি চাই বৃক্ষ মূল, চাই নির্জন পর্ণ কুটীর। ” মাতা অধীর হয়ে বললেন “এখানে অবস্থান তোমার অপ্রিয় হচ্ছে কেন? আমরা কি করলে তুমি সুখী হবে, তা বল।”


তিনি নিস্পৃহ বাক্যে বললেন “আমি একাকী অবস্থানেই তৃপ্ত।  ইসিদাসীর সংসর্গে আমি থাকতে চাই না।  আমার সেই ছিন্ন বস্ত্র ও ভিক্ষা পাত্রটি ফিরিয়ে দিন, আমি চলে যাই। ” মা বললেন “সে কোন অপরাধ করেনি বটে, কিন্তু আমার মন।  বলছে ত্যাগই শান্তি। ” আমি পায়ে পড়ে কাতর অনুরোধ করলাম, কত রোদন করলাম, বললাম কেঁদে কেঁদে “আমি আপনার চরণ সেবিকা, দাসী; আমায় ত্যাগ করে যাবেন না আপনার বিরহ ব্যথা আমার অসহ্য হবে, বক্ষ বিদীর্ণ হবে, আপনি যাবেন না। ”


তবুও তিনি চলে গেলেন, আমার কোনও কথা শুনলেন না, আমার প্রতি দৃকপাতও করলেন না, তাঁর ছিন্ন বস্ত্র ও ভিক্ষা পাত্র নিয়ে চলে গেলেন।  তখন চিন্তা করলাম “আমি বড় মন্দ ভাগিনী।  আমার জন্য মাতা পিতা ক্ষোভে দুঃখে অপমানে ম্রিয় মান।  জাতি বর্গও কত মর্ম পীড়া ভোগ করছেন।  আমার এ উপেক্ষিত লাঞ্ছিত ঘৃণ্য জীবনের কি প্রয়োজন? আমি আত্মঘাতিনী হোব, উদ্বন্ধনে প্রাণ ত্যাগ করবো। ”


আবার চিন্তা কররাম “আত্ম হত্যা মহা পাপ, ইহা শাস্ত্রোক্ত কথা। ” একাকিনী নিরালায় বসে এসব চিন্তা করছি।  এমন সময় আর্যা জিনদত্তা। ভিক্ষুণী, যিনি বিশুদ্ধ শীল গুণ সম্পন্ন, বহু শ্রুতা, তৃষ্ণা হীনা, অর্থৎ তাঁর শুভা গমন হল আমাদের গৃহে।  তাঁকে দেখে আমি প্রসন্ন হলাম এবং আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করলাম।  সত্বর সঙ্গে আসন পেতে বস বার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম। 


তিনি উপবেশন করলে বন্দনা করার পর অন্ন পানাদি আহার্য দ্রব্য পরিবেশন করে তাঁকে পরি তৃপ্ত করলাম।  আর্যা জিনদত্তাকে দেখে আমার অভিশপ্ত জীবনকে উৎকর্ষে পর্যবসিত করবার শ্রেষ্ঠ, ঋজু, উত্তম ও সুন্দর পথের ইঙ্গিত পেলাম।  তখন সরাসরি চিত্তে উদয় হল “ভগবান বুদ্ধের পবিত্র শাসনে আমি প্র্যার আশ্রয় নেবো।  তাই কল্যাণকর ও দুঃখ মুক্তির শ্রেষ্ঠতম উপায়। ” অন্ধকারে যেন দীপ্ত আলোকের সন্ধান পেলাম।  আমার অন্তরে যে কি রূপ প্রীতির সঞ্চার হয়ে ছিল তা অবর্ণনীয়।  তখন আমার মনে দুঃখ ও গ্লানি সবই মুছে গেল।  জিন দত্তাকে বললাম “আর্যে, আমি বুদ্ধ শাসনে আত্মোৎসর্গ করতে চাই।আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করবো।


জিনদত্তা আমাকে উৎসাহিত করলেন।  বললেন “ইসিদাসী, তা অতি উত্তম।  ইহাই দুঃখ মুক্তির শ্রেষ্ঠতম অয়ন। ” পিতা একথা শুনে আমায় বললেন “কন্যা, প্রব্রজ্যা ধর্ম শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র বটে, কিন্তু বড় কঠিন, বড় দুষ্কর।  তুমি সুকোমল।  এত কষ্ট তোমার সহ্য হবে না।  তুমি ঘরে বসে বসে ধর্মাচরণ কর, যথেচ্ছা দান কর, শীল পালন কর। ” পিতার কথা শুনে সন্দেহ হল “ইনি কি আমার মুক্তি পথের অন্তরায় হবেন? তখন আমি শঙ্কিত ও মনো দুঃখে কেঁদে উঠে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললাম “বাবা, বাধা দেবেন না, আমার মুক্তি পথের সহায় হউন।  স্বকৃত পাপের ক্ষালন করতে হবে, আমায় যেতে দিন।  সত্য ধর্মের আশ্রয় নিয়ে নির্জনে সাধনায় ব্রতী হব।  অন্য থায় মৃত্যু আলিঙ্গন করে এ অভিশপ্ত জীবনের অবসান ঘটাবো। ”


আমার দৃঢ় সংকল্প দেখে পিতা ক্ষান্ত হলেন।  সংবিঘ্ন অন্তরে তিনি বললেন “প্রাণাধিক কন্যা, যাও প্রজ্ঞার অধিকারী হও।  শ্রেষ্ঠতম ধর্মে আত্ম নিয়োগ করে শান্তিময় নির্বাণ সাক্ষাৎ কর।  মহা মানব বুদ্ধ সেই পরম পদ সপ্রাপ্ত হয়ে ছেন। ” সে দিনই মাতা পিতা ও অতিদের নিকট বিদায় নিয়ে আর্যা জিনদত্তার অনুকম্পায় বুদ্ধ শাসনে প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষা লাভ করলাম।  অতঃপর জন্ম নিরোধক আধ্যাত্মিক গভীর সাধনার নিজকে নিয়োজিত করলাম।  


চতুরার্যসত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সাধনার মাধ্যমে অনিত্য দুঃখ অনাত্মের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্যক উপলব্ধি করে সপ্তাহের মধ্যেই।  জাতিস্মর জ্ঞান, চুতি উৎপত্তি জ্ঞান ও তৃষ্ণা ক্ষয় জ্ঞান, এ গরিষ্ঠ গুণ যুক্ত ত্রিবিদ্যা সহ অর্হত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরাশান্তির উৎস অমৃত নিৰ্কর নির্বাণ সাক্ষাৎ করলাম। জাগতিক আত্যন্তিক দুঃখের আকর জন্ম মৃত্যু রুদ্ধ হয়ে গেল।


তখন অনুপম প্রীতিরসে আমার সর্বশরীর স্নাত হল।  আমি হলাম শান্ত বিমুক্ত।  তাঁর পর আমার জন্মান্তরের নিগূঢ় রহস্যের দ্বার উদ্‌ঘাটন করতে প্রবৃত্ত হলাম।  আমার অভি শপ্ত অবজ্ঞাত জীবনের উৎস কোথায়, কোন অপ কর্মের প্রভাবে এত দুঃখ, এত মর্ম পীড়ায় জর্জরিত হলাম, তা উপধারণে মনো যোগী হলা।  একে একে অতীত সপ্ত জন্মের ইতিবৃত্ত আমার দিব্য দৃষ্টির গোচরী ভূত হল।  প্রীতি ভাজন বোধি, সে অসহ দুঃখময় করুণ কাহিনী প্রকাশ করছি, মনো যোগ দিয়ে শোন।


১।  অতীত এক জন্মে এরক কচ্ছ নামক নগরে আমি প্রসিদ্ধ এক ধন শালী সুবর্ণকার ছিলাম। যৌবনে মদে মত্ত হয়ে ধন বিতরণে বশী ভূত করে পরস্ত্রীতে রত হয়ে ছিলাম।  এ বাভিচার পাপে নিজকে সানন্দে আহুতি দিয়ে ছিলাম।  এর পরিণাম ফল কখনও চিন্তা করি নি।


২।  সে জন্মের অবসানে নরকে উৎপন্ন হয়ে ভীষণ দুঃখ ভোগ করে ছিলাম।  উঃ, সে কী দুঃসহ দুঃখ।  পরদার লঙ্ঘনের এমন দারুণ বিষময় ফল সুদীর্ঘ কাল ভোগ করে ছিলাম।


৩।  বহু দীর্ঘ দিন পরে এ মহা দুঃখের অবসান হলে নরক হতে মুক্ত হয়ে কর্মের তাড়নায় মহা বনে বানরীর গর্ভে জন্ম নিয়ে ছিলাম।  জন্মের সপ্তম দিবসে নিষ্ঠুর বানর ‍যূথপতি তীক্ষ্ন দন্তের দংশনে আমার অন্ডচ্ছেদ করে ছিল।  আহা, সে কী দুঃখ, অসহ্য যন্ত্রণায় সংজ্ঞাহারা হয়ে ছিলাম।  আমার কাতর চীৎকারে মাতা শোকা কুলা হয়ে ছিল।  নির্দোষ নিরীহ শিশু, তবুও অন্ডচ্ছেদ হলো পরদার লঙ্ঘনের এমনি দারুণ দন্ড।


৪।  বানর জন্মের অবসানে মৃত্যুর পর সিন্ধু প্রদেশে এক অরণ্যে কাণা ও খঞ্জ এক ছাগীর গর্ভে জন্ম নিয়ে ছিলাম।  মালিক আমায় শৈশবেই মুস্কচ্ছেদ করে দিয়ে ছিল।  উঃ, সে কী যন্ত্রণা।  কম্পিত দেহে মা মা বলে কতই না রোদন করে ছিলাম।  পরদার লঙ্ঘনের কী দারুণ দন্ড।  তাঁর পর সারা জীবন আমার পৃষ্ঠোপরি প্রভু পুত্রদের বহন করতে হয়ে ছিল।  সহ্য করতে হয়ে ছিল কত বেত্রাঘাত পদাঘাত।  তাঁর পর মাংস লোলু পদের রসনা তৃপ্তির জন্য ঘটলো আমার অকাল মৃত্যু।


৫।  এ অপঘাত মৃত্যু তেই দুঃখ পূর্ণ ছাগ জন্ম হতে মুক্ত হলাম বটে, কিন্তু কর্ম নিবন্ধনে আবার পশু কুলে গো ব্যবসায়ীর গাভীর গর্ভে জন্ম নিলাম।  আমার দেহ ছিল সুন্দর লাক্ষা রক্ত বর্ণ।  কর্মের তীব্র তাড়নায় এখানেও আমার অন্ডচ্ছেদ হয়ে ছিল।  ক্রমে বলী বর্দে পরিণত হলাম।  দেহ হল সুন্দর, হৃষ্ট পুষ্ট বলিষ্ট।  মালিকের প্রিয় হলাম বটে, কিন্তু আমায় নিযুক্ত করল লাঙ্গল ও শকট বহনে।  যত দিন দেহে শক্তি ছিল ততদিন এ দুঃখের মধ্য দিয়েই অতি বাহিত হল। যখন দুর্বল হয়ে পড়লাম তখন অন্ধ হয়ে ম্রিয়মান হয়ে পড়লাম।  ততোধিক দুঃখ হল মক্ষিকা মশক ও দংশকের দংশনে।  তীব্র শীতে, প্রখর গ্রীষ্মে ও মুষল ধারা বৃষ্টিতে কত যে দুঃখ পেয়েছি তা অবর্ণনীয়। পরদার লক্ষ্মনের এমন দুঃখ পূর্ণ বিপাক ভোগ করে ছিলাম।


৬।  গো জন্মের অবসানে মান বকুলে গৃহ হীন ক্রীতদাসীর গর্ভে জন্ম।  নিয়ে ছিলাম ক্রীতদাসীর সন্তান, তদু পরি হয়ে ছিলাম নপুংসক।  আহা, নারীও নয়, পুরুষও নয়।  কুকর্মের কী অলঙ্ঘ্য বিধান! অসহ্য রিপুর তাড়না! উঃ সে কী অসহ দুঃখ। ত্রিংশতি বৎসর ব্যাপী অহোরাত্র উগ্রতেজোময় কামাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে দুঃসহ যন্ত্রণায় অতৃপ্ত কামনা নিয়ে।  অকালে মৃত্যু আলিঙ্গন করে ছিলাম।  পরদার লঙ্ঘনের কী দারুণ দন্ড!


৭।  নপুংসক দেহের অবসানে জন্ম নিলাম নিরতিশয় দরিদ্র, বহু ঋণ গ্রস্ত জনৈক শকট চালকের কন্যা রূপে।  ঋণ পরিশোধের জন্য পিতা এক বণিক হতে অর্থ গ্রহণ করে তৎবিনিময়ে আমায় প্রদান করলেন তাকে।  আমি রোদন ও বিলাপ করতে করতে পিতৃ গৃহ হতে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হলাম। আমার যৌবন কালে বণিকের পুত্র গিরিদাস আমাকে স্ত্রী রূপে বরণ করেন।  তাঁর অপর এক পত্নী ছিল।  সে ছিল পতি গত প্রাণা, শীল বতী ও যশোবতী।  সপত্নী ঈর্ষায় আমার অন্তর রাত্রি দিন দগ্ধ হয়ে ছিল।


৮।  তাঁর পর হল আমার এ বর্তমান জন।  ইহ জন্মে দাসীর ন্যায় যাদের সেবা করেছি, তাঁদের আমি অসহ্য হয়েছি।  তারাই আমাকে ঘৃণা ও উপেক্ষা করেছে। এর কারণ আমি ইতি পূর্বে অজ্ঞাত ছিলাম। ইহা যে পরদার লজ্ঞানের প্রতি ফল তা এখন সম্যক রূপে জ্ঞাত হয়েছি।  এক্ষণে আমি যে কর্মের বিপাকে অতি ক্রম করেছি।  তৎসঙ্গে জাগতিক সকল দুঃখেরও নিরসন করেছি। এখন আমি বিমুক্ত। ” ভিক্ষুণী বোধি প্রফুল্ল বদনে বললেন “নির্বাণ প্রত্যক্ষ কারিণী ইসিদাসী, তজ্জন্য তোমায় অভিনন্দন জানাচ্ছি। ” ইসিদাসী কাহিনী সমাপ্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url