সুমেধা

সুমেধা

আড়াই হাজার বৎসর আগেকার কথা।  তখন “মন্তাবত” ছিল ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ নগরী।  এ দেশের অধি পতি ছিলেন নৃপতি কোষ্ণ।  তাঁর অগ্র মহিষীর পুণ্য গর্ভে জন্ম নিয়ে ছিলেন ‘সুমেধা’।  রাজ কন্যা সুমেধা ছিলেন বড় পুণ্যবতী, পুণ্য লক্ষণ বিমন্ডিতা।  বড় মনোরম সমুজ্জ্বল তাঁর লাবণ্যচ্ছটা।  জ্যোৎস্নার মত মনোরম মদিরতা মাখান তাঁর রূপ।  কেবল যে রূপবতী ছিলেন তা নয়, এর চেয়েও সুন্দর পবিত্র ছিল তাঁর অন্তর। মুখে হাস্য মধুর প্রসন্নতায় স্বতঃই প্রতি পলিত হয়ে থাকে তাঁর শুভ্র হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।


আরো দেখুন: সুমেধা পূর্ব জন্ম


আরো দেখুন: আম্বপালী জীবন কাহিনী


সুমেধা

সুমেধা

তখন মুনি শ্রেষ্ঠ শাক্য মুনির পরাশান্তির উৎস নৈর্বণিক ধর্মের প্রাণ স্পশী বাণী ভারতের নগরে গ্রামে প্রতি ঘরে ঘরে আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছে অভূত পূর্ব।  জাগিয়ে তুলেছে প্রাণে পুলক শিহরণ।  উদ্বুদ্ধ হল জন গণের সন্ধানী অন্তর।  সার্বভৌম সার্বজনীন অমৃত বাহন।  সত্য ধর্মের মোহন মধুর সুর রণিত হল দিকে দিকে, আকাশে বাতাসে।ক্ষেমঙ্কর সুবি শুদ্ধ ধর্মের অজেয় আকর্ষণে জনগণ আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। ভারতে সর্বত্র উডীন হল সদ্ধর্মের বিজয় পতাকা।  


এ সন্তা পহারী অভিনব ধর্মের প্রতি বালিকা সুমেধার অন্তরেও প্রগাঢ় আকর্ষণ জাগ্রত হল।  তিনি জানতে চান নৈর্বণিক ধর্মের নিগুঢ় তত্ত্ব।  তাই প্রতি দিন তিনি সহচরীদের নিয়ে বিহারে উপনীত হন এবং অন্তর্দৃষ্টি লাভী অভিজ্ঞ ভিক্ষুণীদের নিকট ধর্ম কথা শোনেন।  ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা।  দান করেন প্রসন্ন মনে, শীল রক্ষা করেন পরম যত্নে, শিক্ষা করেন আধ্যাত্মিক সাধনার বিষয় ও প্রণালী।  তাঁর বুদ্ধি বিবেচনা চমৎকার, বোধ শক্তি অসাধারণ, মেধা শক্তিও অতি প্রখর। তাঁর সঙ্গে নামের মিশ খেয়েছে আশ্চর্য রকম।  ‘সুমেধা’ নাম করণ যেন দেব তাঁরই দান।

 

সুমেধার প্রত্যেক কাজে ও কথায় মহিমাময়ী ও মহীয়সীর ইঙ্গিত পরি স্ফুট হয়ে ওঠে।  তিনি ধর্মোপদেশ যা শোনেন, তাই হৃদয়ঙ্গম করেন এবং অন্তরে ধারণ করেন।  নিত্য নতুন ধর্ম বিষয় অধিগত কর বার জন্য তাঁর খুব উৎসাহ ও একাগ্রতা।  গভীর তত্ত্বমূলক আধ্যাত্মিক বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসা অসাধারণ।  চুরাশি হাজার ধর্ম স্কন্ধে জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁর আগ্রহ ক্রমশঃ বেড়ে ওঠে।  অতঃপর তিনি সদ্ধর্মে বহু শ্রুত জ্ঞানের অধিকারী হলেন।  কায়গত স্মৃতি তাঁর অন্তরে সমধিক আলোক পাত করল।  সময়ে তিনি অনিত্য দুঃখ অনাত্ম।  চিন্তায় তনায় হয়ে পড়েন। ইহাও তিনি উপলব্ধি করলেন জন্ম মাত্রই দুঃখ পূর্ণ, তৃষ্ণাই সকল দুঃখের মূল।  এ কারণেই তিনি পুনর্ভবে জনু গ্রহণকে ভীতি চক্ষে দর্শন করে ভোগা সক্তি থেকে নিজকে মুক্ত রাখ বার চেষ্টায় তৎপর হলেন।

 

রাজ নন্দিনী সুমেধা এখন যৌবন সীমায় পদার্পণ করেছেন।  যৌবনের ছোঁয়া লেগে তাঁর অপরূপ রূপ লাবণ্য উচ্ছল হয়ে পড়ছে।  ফুটে উঠল তাঁর অঙ্গ প্রত্যঙ্গে দেব দুর্লভ পুণ্য লক্ষণ সমূহ।  কিন্তু যুবতী সুলভ যৌবন চাঞ্চল্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারল না।  বিলাস ব্যসনের।  প্রতি তিনি একেবারেই উদাসীন।  সর্বক্ষণ কি যেন চিন্তা করেন।  তাঁর স্বতস্ফূর্ত ফুল্লাননে কেমন এক গাম্ভীর্যের ছাপ এসে পড়েছে।  ‘বারণবতী’ নগরের রাজা অনিকরত্ব সুপুরুষও প্রিয় দর্শন। 


তিনি রাজ কন্যা সুমেধার রূপ গুণের কথা শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। তাঁকে দর্শনের জন্য তিনি আকুল হয়ে পড়লেন।  এক সময় তিনি স্বচক্ষে দেখলেন তাঁর মানসী প্রিয়াকে।  নূপসুতাঁর সৌন্দর্য দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন।  নৃপতি কোষের নিকট তিনি সুমেধার প্রার্থী হলেন।  রাজা অনিকরত্তকে সুমেধার সর্বাংশে উপযোগী মনে করে তিনি কন্যা।সম্প্রদানের স্বীকৃতি দান করলেন।  তিনি এও বললেন যে, রাজা অনিকরত্ত এসে সুমেধার সাথে যেন আলাপ করেন এবং তাঁর সম্মতি গ্রহণ করেন।

 

সুমেধা একথা শুনে প্রমাদ গুণলেন।  তাঁর ইচ্ছা নয় সংসারের। জটিলতায় আবদ্ধ হন।  তিনি চান গৃহবাস ত্যাগ করে ভিক্ষুণী ধর্মের আশ্রয় নিতে এবং নির্জনে আধ্যাত্মিক চিন্তায় আত্ম নিয়োগ করেন।  কিন্তু, মাতা পিতাঁর উদ্দেশ্য জ্ঞাত হয়ে তিনি চিন্তা যুক্ত ও বিমর্ষ হলেন। মাতা পিতাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে তিনি বললেন আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মৈত্রী করুণার মূর্ত প্রতীক মাতা পিতা পুত্র কন্যার একান্তই হিতকামী। মাতা পিতাঁর মত কল্যাণমিত্র এ জগতে দুর্লভ।  সুতরাং যা আমার পক্ষে কল্যাণ জনক যে রূপ কাজে আপনারা আমার সহায় হবেন, ইহাই আমি প্রত্যাশা করি।  এখন আমি নির্বাণ গত প্রাণ, নির্বাণেই অভিরমিত।  দেহ দিব্য হলেও নশ্বর অসার, জন্ম মৃত্যুর অধীন, দারুণ দুঃখের আকর, তৃষ্ণার মূলাধার।

 

কাম তৃষ্ণা সর্প বিষ তুল্য কটু, অজ্ঞ জন এতেই মোহিত হয়।  এসব মোহান্ধ জন সুদীর্ঘ কাল নরকে নিমগ্ন হয়ে অসহ দুঃখ ভোগ করে।  কায় বাক্য মন যাদের অসংযত, তাদৃশ পাপী জন অপায়ে দীর্ঘ কাল শোক প্রাপ্ত হয়।  দুষ্প্রজ্ঞ মূর্খ গণ চেতনা হীন, তাই তারা সর্ব দুঃখে অবরুদ্ধ। আর্য সত্য সম্বন্ধে তাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই, দেশনা করলেও তারা বুঝে না।  আর্য সত্য যারা জ্ঞাত নয়, তারাই জন্মকে অভিনন্দন করে এবং দেব লোকে উৎপত্তির কামনা করে।  দেবত্বও চির স্থায়ী নয়।  জন্ম অনিত্য ও দুঃখময়।  তবুও মূঢ়গণ পুনর্জন্মকে ভয় করে না।

 

দুর্গতি কুল চতুর্বিধ, যথা নরক, প্রেত, অসুর ও পশু পক্ষী কুল।  সুগতি, দ্বিবিধ, যথা মনুষ্য লোক ও দেব লোক।  দুর্গতি কুলে জন্ম লাভ যত সহজ, সুগতি লাভ করা ততো ধিক দুষ্কর।  দেব লোক অথবা অপায়ে প্রব্রজ্যা লাভের উপায় নেই।  ভগবান তথাগতের শাসনে প্রব্রজ্যা লাভের জন্য আপনারা উভয়ে আমার অনুমতি প্রদান করুন।  আমি অতন্দ্রিত ভাবে জন্ম মৃত্যুর মূলোৎ পাটনে প্রবৃত্ত হব।  পুন র্জন্ম অভিনন্দন কারী অসার ও ঘৃণ্য দেহের কী প্রয়োজন? আমাকে অনুমতি দেন, আমি বুদ্ধ শাসনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে ভব তৃষ্ণা নিরোধ করব।  বুদ্ধ উৎপন্ন হয়ে ছেন, অক্ষণ বিদূ রিত হয়েছে, শুভ ক্ষণ লাভ করেছি, সারা জীবন শীল ও ব্রহ্মচর্য আচরণ করে নির্বাণ সাক্ষাৎ করব।” অতঃপর দৃঢ় বাক্যে বললেন “আমার মৃত্যু হলেও গৃহী অবস্থায় আর আহার গ্রহণ করবো না।”

 

সুমেধার কথা শুনে জনক জননী মর্মান্তিক দুঃখে অভি ভূত হয়ে রোদন করতে লাগলেন।  সুমেধারও গল্ড প্রদেশ অশ্রু জলে সিক্ত হল।  তিনি ক্রন্দন পরায়ণ হয়ে প্রাসাদ তলে ভূমি শয্যায় লুটিয়ে পড়লেন।  মাতা পিতা তাঁকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন, ব্যথিত স্বরে বললেন “প্রাণাধিক কন্যা, উঠ, কি জন্য দুঃখ করছো? বারণবতী নগরে তোমায় সম্প্রদান করেছি। সুগঠিত অঙ্গ সৌষ্ঠব, সুন্দর অভি রূপ রাজা। অনিকরত্তে এখন তুমি বাগদত্তা।  তুমি তাঁর প্রধান মহিষী হবে।  বংশে, শীল ও ব্রহ্মচর্য রক্ষা এবং প্রজ্যা জীবন যাপন করা বড়ই কষ্ট কর।  তুমি রাজী হয়ে প্রভুত্ব ও ধনৈশ্বর্যের অধিকারিণী হবে।  তুমি তরুণী, সর্বাধিক সুখ ভোগ তোমার আয়ত্তে।  নারী জীবনের যা একান্ত কাম্য, সে রূপ সুখ ভোগে লিপ্ত হও।  এস বৎসে, স্বামী বরণ কর।

 

প্রত্যুত্তরে সুমেধা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন “তা হবে না।  বরঞ্চ আমি মৃত্যু বরণ করতে পারি, তবুও তা হবে না।  সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবো না।  সংসার নিরব চ্ছিন্ন দুঃখময়, সেখানে সুখ কোথায়? সুখ যা বলা হয়, তা জীব জীবনের মৃগ তৃষ্ণিকা মাত্র।  জীবনে শুধু দুঃখ, শুধু ক্লেশ, শুধু অশ্রু, শুধু ব্যথা।  জীবন যেখানে মৃত্যু কালিমায় পরিম্নান, জরা ব্যাধি শোক সন্তাপে জর্জরিত, সুখের পরিকল্পনা সেখানে? আশ্চর্য বটে! পুনঃ পুনঃ জন্ম মৃত্যুর মধ্যে সুধাম্বেষণ মোহান্ধতার পরিচায়ক নয় কি? এ দেহ যে কেবল অসার তুচ্ছ, তা নয়; দারুণ দুঃখ পূর্ণও।  এ দুঃখের নিরব শেষ নিরোধেই হয় চির সুখের অধিকারী।  তাই আমার নিতান্তই প্রয়োজন প্রব্রজ্যার।  একথা নিশ্চয়, হয় প্রব্রজ্যা লাভ নয় মৃত্যু আলিঙ্গন।

 

কৃমি ও অশুচি পূর্ণ এ পূতিকায় ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ বাহী চর্মের থলি এবং জঘন্য মলনিঃসারী ভস্ত্রা সদৃশ।  রক্ত মাংসের লেপনাচ্ছাদিত কদর্য কৃমি কুলের আলয় ও পশু পক্ষীর খাদ্য এ দেহের কী বা মূল্য? চিন্তা করে দেখুন, মৃত দেহ অচিরে শ্মশানে নিতে হয়।  তখন তা বিষ্ঠ লিপ্ত অব্যবহার্য কাষ্ঠ খন্ডের ন্যায় পরিত্যক্ত হয়।  তখন তিরাও ঘৃণা করে।  শৃগাল কুকুরের খাদ্য এ দেহ শ্মশান মশানে নিক্ষেপ করে জ্ঞাতিগণ ঘৃণা ভরে স্নান করে।  অন্যের কথা দূরে থাক, মাতা পিতাও তা বর্জন করে।  অস্থি স্নায়ু সংঘ বদ্ধ যুক্ত বিষ্ঠা মূত্র, অশ্র থুথু পরি পূর্ণ পচা দেহের প্রতি মানুষেরা আসক্ত হয়।  

 

এ দেহ ব্যবচ্ছেদ করে অভ্যন্তরের অস্ত্রাদি অশুচি পদার্থ যদি বের করা হয়, এর অসহ্য দুর্গন্ধে অতিষ্ট হয়ে স্বীয় মাতাও ঘৃণার সাথে ত্যাগ করবে।  পঞ্চ স্কন্ধ, পঞ্চে ন্দ্রিয়, পৃথিবী, আপ, তেজ ও বায়ু ধাতু ইত্যাদি ক্ষণ স্থায়ী সংযোগ মাত্র।  এসবই দারুণ দুঃখ দায়ক জন্ম মৃত্যুর উৎস। এসব চিন্তা করলে এর প্রতি কি অনুরাগী হতে পারে? তবে কাকে আমি বরণ করবো? প্রতি দিন তিন শত সুতীক্ষ্ন অস্ত্রের প্রহার শত বর্ষ যাবৎ আমাকে যদি করা হয়, সে মহা দুঃখও আমার শ্রেয়ঃ মনে হবে, যদি এতেই জাগতিক সকল দুঃখের চরম অবসান ঘটে।  এরূপ সংসারাবর্ত দুঃখের নিরব শেষ বিনাশই জ্ঞানী জন ইচ্ছা করেন।  যাদের পুনঃ পুনঃ মৃত্যু হয়, সুদীর্ঘ কাল তারা জন্ম জরা ব্যাধি দুঃখ ভোগ করে।

 

আমি অনন্ত জন্যে অনন্ত অনন্ত দুঃখ ভোগ করেছি।  দেব মনুষ্য লোকে, পশু পক্ষী কুলে, নরক প্রেত ও অসুর লোকে দারুণ দুঃখের মধ্য দিয়ে অনন্তবার মৃত্যু বরণ করেছি।  অসংখ্য প্রাণী অপায়ে অসহ দুঃখে নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছে।  দেব লোক প্রাপ্তিতেও দুঃখের অবসান ঘটে না।  এক মাত্র দুঃখের বিরাম ঘটে নির্বাণে।  নির্বাণ সুখই পরম সুখ।ভগবান তথাগতের বাণী যাঁরা অনুসরণ করেন এবং ‘জন্ম মৃত্যুর মূলোচ্ছেদের জন্য প্রয়াস পান, তাঁরাই নির্বাণ সাক্ষাৎ করেন।  পিত অসার ধূণ্য ভোগ বিলাসে আমার প্রয়োজন নেই, তা আমার অকাম্য।  অদ্যই আমি অভি নিষ্ক্রমণ করবো।” এমন সময় কন্যা দান অঙ্গীকার লব্ধ অনুরাগ রঞ্জিত রাজা অনিকরত্ত। প্রীত মনে ভাবী পত্নীর সম্মতি গ্রহণের জন্য স্বীয় রাজ ধানী বারণবতী হতে মন্তাবতী অভি মুখে অগ্রসর হলেন।  

 

একথা শুনে সুমেধা স্বীয় মস্ত কের সুকোমল, আজানুলম্বিত, নিবিড়, ভ্রমর কৃষ্ণ কেশ রাজি অসিদ্বারা কর্তন করে নিজ প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন এবং দ্বার রদ্ধ করে আধ্যাত্মিক ধ্যানে সমাসীন হয়ে মুহূর্ত কালের মধ্যেই লৌকিক প্রথম।  ধ্যানে সিদ্ধি লাভ করলেন।  সুমেধার এরূপ ধ্যান নিবিষ্ট অবস্থার সময় রাজা অনিকর মন্তাবতী নগরে উপনীত হলেন।  তখন রাজ কন্যা অনিত্য ভাবনায় তন্ময়। 


মণি কাঞ্চন বিভূষিত অনিকরত্ত ত্বরিত পদবিক্ষেপে নৃপতি কোষ্ণের প্রাসাদে আরোহণ করলেন।  কোষ্ণের মুখে তিনি সকল কথা শুনলেন। তবুও তিনি রুদ্ধ দ্বারের বহির্দেশে দাঁড়িয়ে প্রেম মুগ্ধ সতৃষ্ণ অন্তরে অনুরাগ মিশ্রিত বাক্যে সুমেধার পাণি প্রার্থনা করলেন।  আকুল কণ্ঠে বললেন “কল্যাণ, তুমি রাজী হয়ে প্রভুত ধনৈশ্বর্য ও প্রভু শক্তি উপভোগ কর।  তুমি সৌভাগ্যবতী তরুণী।  নারী জীবনের কাম সুখ ভোগে রত হও, পঞ্চ কাম গুণে অভি রমিত হও।  সংসারে এমন সুখ, এমন বিলাস ব্যসন দুর্লভ।  ঐশ্বর্য পূর্ণ আমার মনোরম রাজ্য তোমায় অর্পণ করছি, যথেচ্ছা ভোগ ও দান কর।  উদভ্রান্ত হয়ো না, দুর্ভাবনা ত্যাগ কর, তোমার জনক জননী দুঃখিত সন্তপ্ত।”

 

কাম তৃষ্ণায় বীত শ্রদ্ধ, মোহ হীন রাজ নন্দিনী সুমেধা রাজা অনিকরত্তকে বললে “রাজন, কামে অভিনন্দন করবেন না।  করবেন না এতে আনন্দ ও সুখের অনুসন্ধান।  বহু বিধ দোষ দুষ্ট কাম পরিভোগ। মনশ্চক্ষে দর্শন করুন এতে কত দারুণ দুঃখ বিজড়িত রয়েছে।  কাম তৃষ্ণা সমুদ্রের ন্যায় দুষ্পার।  সসাগরা মহা পৃথিবীর একচ্ছত্র চক্রবর্তী রাজা মান্ধাতা দেবরাজ সদৃশ অখন্ড প্রতাপ শালী হয়ে।  তাবতিংস দেবলোকে রাজত্ব করে ছিলেন।  তথায় তিনি ৩৬ জন দেবেন্দ্রের ১২৯ কোটি ৬০ লক্ষ বৎসর পরমায়ু লাভ করে দিব্য কাম ভোগে অভি রমিত হয়ে ও কাম তৃষ্ণা সম্পূরণে অসমর্থ হয়ে অতৃপ্ত বাসনা নিয়েই মৃত্যু গ্রাসে পতিত হয়ে ছিলেন।

 

আকাশ হতে সপ্তরত্ন বর্ষিত হয়ে যদি দিগন্ত পূর্ণ হয়, তবুও তৃপ্ত হয় না। অতৃপ্ত তৃষ্ণা নিয়েই মানুষের মৃত্যু হয়।  কাম রাগ অসি ও শূলের ন্যায় দুঃখ দায়ক, উন্নত শির সর্পের ন্যায় ভীষণ, জ্বলন্ত উল্কার ন্যায় দগ্ধকারী, লোভাতুর কুকুর অস্থি চর্বণ দ্বারা মুখ ভ্যন্তর ক্ষত বিক্ষত করার ন্যায় যন্ত্রণা দায়ক।  কাম পরিভোগ অনিত্য, অধ্রুব, অনর্থকর, বিরোধ সৃষ্টি মূলক, স্বপ্নের মত প্রপঞ্চময়, ভীতি জনক, প্রাণ নাশী এবং মুক্তি মার্গের মহা অন্তরায়, একথা চক্ষুষ্মন বুদ্ধ বলেছেন। আপনি এখন যেতে পারেন।  ভবরাগের প্রতি আমি অনুরাগ হীন আস্থা হীন।  আমার জন্য কর্তব্য আছে।  আমার জন্য অপরে কি করবে? আমার মস্তন্ত্রের উপর একাদশ প্রকার অগ্নি (জন্ম, জরা, মরণ, লোভ, দ্বেষ, মোহ, শোক, পরিদেবন, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও উত্ত্যক্ত) জ্বলছে, বিশেষতঃ জরা মরণ আমায় অনুসরণ করছে।  এর নিরসনের জন্য আমাকে সচেষ্ট হতে হবে।”

 

একথা বলে সুমেধ প্রকোষ্ঠের দ্বার উন্মুক্ত করলেন।  তখন দেখলেন  ‘মাতা, পিতা ও রাজা অনিকরত্ত প্রাসাদতলে বসে ক্রন্দন করছেন।  রাজ কন্যা তাঁদের লক্ষ্য করে বললেন “অজ্ঞ জনের সংসার।  পরি ভ্রমণ অতি দীর্ঘ।  সুদীর্ঘ কাল তাদের পুনঃ পুনঃ রোদন করতে হয়।  অনাদি কাল থেকে মাতৃ পিতৃ মরণ, ভ্রাতৃ মরণ ও নিজ মরণ ভয় অন্ত হীন।  জ্ঞাতির মৃত্যু জনিত দুঃখ এবং জাগতিক অসহ দুঃখে যে পরিমাণ অশ্র বর্ষিত হয়েছে, তা চার মহা সমুদ্রের জলের চেয়েও অধিক।  জন্ম জন্মান্তর যে পরিমাণ মাতৃস্তন্য পান করা হয়েছে, তাও চার মহা সমুদ্রের জলের চেয়ে অধিক।  জন্মে জন্মে শক্র হস্তে নিধনজনিত দেহ হতে যে পরিমাণ রক্ত ক্ষরণ হয়েছে, তাও চার মহা সমুদ্রের জলের অধিক।  মাত্র এক কল্পের অস্থি সঞ্চিত হলে বৈপুল্য পর্বতের সমান স্তূপাকার হবে।

 

দিব্যদর্শী বুদ্ধ ইহাও বলেছেন আদি অন্তহীন সংসারে পরিভ্রমণকারী এক এক জনের মাতা পিতার সংখ্যা গণনায় সমগ্র জম্বুদ্বীপের মৃত্তিকা যদি বদরী বীজ প্রমাণ এক একটা গুটিকা করা হয়, তাও সংকুলান হবে না। মানব জন্ম যে কি রূপ দুর্লভ উপমা স্বরূপ মহা সমুদ্রে কাণা কচ্ছপ ও এক ছিদ্র জুয়ালের কথা স্মরণ করলে অনেকটা উপলব্ধি করা যায়, তা স্মরণ করুণ।  এ দেহ জলবুদ্বুদ সদৃশ ক্ষণ ভঙ্গুর, জঘন্য ও অসার, এও মনশ্চক্ষে নিরীক্ষণ করুন।  অনিত্য ও দুঃখের মূল পঞ্চ স্কন্ধের প্রতি দৃষ্টি পাত করুন।  অষ্ট মহানরক ও ষোড়শ ‘উস্সন’ নরকের দারুণ দুঃখের কথা স্মরণ করুন।  পুনঃ পুনঃ বিভিন্ন জন্যে আমরা শ্মশানের অভি বৃদ্ধি সাধন করছি।  উদর পোষণের জন্য কত না কুকর্ম সম্পাদন করেছি।  এর প্রতি ফলন ভোগ করতে হয়েছে ভীষণ দুঃখময়।  দুঃখ সত্য, সমুদয় সত্য, নিরোধ সত্য ও মার্গ সত্যের প্রতি মনো নিবেশ করুন।  

 

চতুরঙ্গ আর্য সত্য রূপ অমৃতের বিদ্যমানে পঞ্চ কটুরস কেন পান করবেন? যা অন্বেষণে দুঃখ পরি গ্রহণে দুঃখ, আরক্ষায় দুঃখ, পরি ভোগে দুঃখ এবং বিপাক ততোধিক দুঃখদায়ক, তৎপ্রতি কেন এত লাল সাৎ নৈর্বণিক ধর্মা মৃতের বিদ্যমানে পরিতাপ বহুল কামাগ্নির প্রতি কেন তুষিত? কাম রতি বড় জ্বালাময়, ক্ষোভময় ও সন্তাপময় ।

 

বৈরাহীন নৈঞ্জম্যের বিদ্যমানে শক্র বহুল কামা সক্তিতে কী প্রয়োজন? রাজা, অগ্নি, জল, চৌর এবং অপ্রিয় উত্তরাধিকারী প্রভৃতি কামের বহু শত্রু ।  কাম রাগের কারণে রাজ রোষে পতিত হয়, রাজ দন্ডে দন্ডিত হয়, অগ্নিতে দগ্ধ হয়, জলে মগ্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করে, চোরের মত গোপন অভিসারে নিযুক্ত হয়, ব্যাভিচার দোষে দুষ্ট হয় এবং অন্যায়। প্রণয় হেতু অপ্রিয় উত্তরাধিকারীর উদ্ভব হয়, একটি রমণীর প্রতি বহু জন আসক্ত হয়ে পরস্পর পরস্পরের শত্রু  হয়ে দাঁড়ায়। অতএব পরম সুখদায়ক অমৃত নির্ঝর নির্বাণ বিদ্যমানে বধ বন্ধনাদি সন্ত্রাস বহুল কামলালসায় কী প্রয়োজন? কামা সক্ত দুঃখে জর্জরিত হয়।

 

জ্বলন্ত তৃণোক্কা নিঃশেষ হবার সময় তা যদি নিক্ষেপ না করে ধারণ করেই থাকে, নিশ্চয়ই সে দগ্ধ হয়।  সে রূপ কাম তৃষ্ণা যে ত্যাগ করে না, সেও দগ্ধ হয়। ক্ষণিকের কাম সুখের জন্য বিপুল সুখকে ত্যাগ করবেন না।  মৎস্যের বড়শি গ্রাসের মত বিনষ্ট হবেন না।  কাম তৃষ্ণা দমন করুন, নচেৎ স্তম্ভে শৃঙ্খলাবদ্ধ কুকুর যেমন চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে, তদ্রপ আপনাকেও ভবচক্রে সুদীর্ঘ কাল ঘুরতে হবে।  ক্ষুধার্ত চন্ডাল যেমন সম্মুখে কুকুর দেখলে হত্যা করে, সে রূপ কাম তৃষ্ণাও আপনাকে বিনষ্ট করবে।  কামানু রক্ত হয়ে আপনি অশেষ দুঃখ ও দৌর্মনস্য ভোগ করবেন।  অব কাম তৃষ্ণাকে পরিত্যাগ করুন।

 

অজরতু বিদ্যমানে জরাশীল কামরতিতে কী প্রয়োজন? সকল জন্মেই বিদ্যমান রয়েছে জর দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ ও মৃত্যু দুঃখ।  অজর অমর অবস্থাই শোক হীন, শত্রু  হীন ও বিঘ্ন হীন।  তা অচঞ্চল, ভয় ও সন্তাপ হীন।  এ অমৃত বহু জনের অধিগত হয়েছে।  যাদের হয়নি; তাদের অদই লাভ করা উচিত।  যিনি একা গ্রতার সহিত নিজেকে নিয়োজিত করেন, তিনিই লাভ করে থাকেন।  অন্যথায় ইহা প্রাপ্য নয়।  অনুমাত্রও সংস্কার প্রবর্তিত হলে, দুঃখ ব্যতীত সুখ নেই।” এ বলে সুমেধা রাজা অনিরত্তের চেতনা উৎপাদনের জন্য তাঁর কর্তিত কেশ রাজার সম্মুখে ভূমি তলে নিক্ষেপ করলেন।  


তখন অনিকরত্ত দাঁড়িয়ে অঞ্জলি বদ্ধ হয়ে নৃপতি কোষ্ণকে বললেন “মুক্তি ও সত্য দর্শন উদ্দেশ্যে প্রব্রজ্যা গ্রহণের জন্য সুমেধাকে অনুমতি প্রদান করুন।  জাগতিক দুঃখ ভয়ে ভীতা রাজ সুতা সুমেধা মাতা পিতার অনুমতি পেয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন এবং আধ্যাত্মিক ধ্যানে অভি নিবিষ্ট হয়ে অচিরে ষড় ভিজ্ঞা সহ অর্হত্ব ফল সাক্ষাৎ করলেন।  সুমেধার কাহিনী সমাপ্ত। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url