আম্বপালী জীবন কাহিনী
আম্বপালী জীবন কাহিনী
সুদূর অতীতের কথা। অম্বপালীর সৌভাগ্য
যে তখন তিনি বুদ্ধ ভগ্নী হয়েই জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন। তাঁর ভ্রাতা ‘ফুস’ বুদ্ধ তখন জগতে আবির্ভূত হয়ে
দেব মানব কে ধর্মামৃত বিতরণে প্রবৃত্ত ছিলেন।
যে বোনের ভাই বুদ্ধ, সে বোন কে অবশ্য ভাগ্যবতীই বলতে হবে। এ কারণে তিনি গৌরবান্বিতা হবারই কথা। বিশ্ব পূজ্য ভ্রাতার উপদেশ ভগ্নী কিঞ্চিত্রও যদি
আপনার মধ্যে প্রতি ফলিত করতে না পারলেন, তবে বুদ্ধ ভগ্নী হয়ে তাঁর জন্মানোর
সার্থকতা কোথায়? এ হেতু, সশ্রদ্ধ অন্তরে সে’ বৌদ্ধ নারী বুদ্ধ ভ্রাতার অমৃতময়
ধর্মোপদেশ শুনতেন। শুধু তা নয়, দানাদি সৎকাজ
করে এরূপ প্রার্থনা করতেন যে ‘জন্মান্তরে তিনি যেন রূপ লাবণ্যের অধিকারিণী হন।
আরো দেখুন: সুমেধা
আরো দেখুন: সুজাতা
অম্বপালী জীবন কহিনী |
মানব যেমন মরণ শীল, তেমন জনম শীলও।
এক জন্মে এর জন্মান্তর রেখার পরি সমাপ্তি
ঘটে না। জন্মে জন্মেই তার কৃত কর্মের জের
টেনে যেতে হয়, যত দিন না তার চরম মুক্তি ঘটে। এ অপ্রতি হত কার্য কারণের দরুণ এ নারী আবার যখন
এক সময় ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন, তখন ধর্মাধি পতি ‘সিখী’ বুদ্ধ ধর্মশাসনে
প্রজারঞ্জন করছিলেন। এ করুণাময় বুদ্ধের ধর্ম শুনে এ ধনী কন্যার নারী হৃদয় দ্রবীভূত
হলো, ধর্ম প্রীতি জাগ্রত হলো অভূত পূর্ব, দুঃখ মুক্তির ঐকান্তিক বাসনায় বিরাগের
ছোঁয়া লাগল তাঁর মর্ম স্থলে। দীক্ষা গ্রহণ
করলেন তিনি ভিক্ষুণী ধর্মে। ভিক্ষুণী
জীবনের কঠোর ব্রত নিয়মানু বর্তিতার সাথে সমভা বেই আচরণ করে তিনি সুখী হলেন।
একটানা সুখের মধ্য দিয়ে কিন্তু
তাঁর জীবন কাটল না। তাঁর ভাগ্যা কাশে দেখা
দিল কাল মেঘ। এক দিন এক অহৎ ভিক্ষুণীকে
তিনি আক্রোশ সহ কারে মন্দ বাক্য বলে ফেললেন। ঘটনা এই যে এক দিবস কতি পয় ভিক্ষুণী সহ তিনি
চৈত্য বন্দনায় গমন করেন। তাঁদের মধ্যে কেহ
কেহ সাধনার পরমা প্রতি ভায় (অর্হত্ব) প্রতিভা শালিনীও ছিলেন। সবাই চৈত্য প্রাঙ্গণে উপনীত হয়ে সমবেত ভাবে পূজা
বন্দনা কার্য সম্পন্ন করলেন। তার পর তাঁরা
চৈত্য প্রদক্ষিণে প্রবৃত্ত হলেন। নব
দীক্ষিতা ভিক্ষুণীর পূর্ব বর্তিণী যিনি তিনিই অহৎ। প্রদক্ষিণের সময় তাঁর হাঁচি ক্ষেপণ হলে, কিছু
পরিমাণ সিকুনি অলক্ষিতে চৈত্যাঙ্গণে পড়ল।
সেই ধনীর দুলালীর ভিক্ষুণী জীবনে দুর্দশা ঘনিয়ে এলো। তিনি অগ্রবর্তিণীর অনুসরণ করতেই পতিত সিকনি তাঁর
দৃষ্টি এড়াতে পারল না। সিকনি দেখে তিনি
ক্রুদ্ধ হলেন এবং অগ্র পশ্চাৎ না ভেবে বলে ফেললেন “না জানি, কোন শাসন দোষিণী,
অনাচারিণী বারাঙ্গনা এমনতর পবিত্র স্থানে সিকনি ফেলেছে। ”
ভাবী অম্বপালীর এ আক্রোশ বাক্য তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনা কাশে কী যে কাল যবনিকাই পতিত করবে, এটা তিনি বুঝতে পারলেন না। কিন্তু, এটাই ঠিক যে তিনি নিজের অমঙ্গলের পথই পরিস্কার করে ফেললেন। অবশ্য তাঁর দুঃখের বোঝা এত খানি ভারী হতো না যদি না সে ভিক্ষুণী অহৎ হতেন। অর্থৎ ভিক্ষুণীকে এরূপ আক্রোশ পূর্ণ দুর্বাক্য প্রয়োগ। করায় ধর্মের শাসনে তিনি রেহাই পেলেন না। মৃত্যুর পর তিনি নর কাশ্রিতা হলেন। সুদীর্ঘ কাল অতীত হয়ে গেল। দুঃসহ নরক যন্ত্রণা ভোগ করার পর আবার তিনি নারী হয়ে জন্ম লাভ করলেন মানব কুলে। পূর্ব পুণ্য প্রভাবে মানব জন্মে তিনি সুখ যশের অধিকারিণী হলেন বটে, কিন্তু সে অনাচারিণী ও বারাঙ্গণা প্রভৃতি দুর্বাক্য প্রয়োগ জনিত পাপ থেকে এখনও নিষ্কৃতি পেলেন না। তাঁর দুষ্কর্মের যথো পযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত এখনও। হয়নি। কর্ম বিপর্যয়ে তাঁকে নগর শোভিনী বারাঙ্গনা সাজতে হলো।
কর্ম
প্রভাবে মানুষ কিনা হতে পারে কোথায় বুদ্ধ ভগ্নী, আর এখন কোথায় বারাঙ্গনা! তবুও তাঁর
এ গণিকা বৃত্তি এক জন্ম দুই জন্মে শেষ হয়নি, দশ হাজার বৎসর গণিকা বৃত্তি করেও যে তাঁর
উপযুক্ত প্রতিকার হলো না, এটাই বিস্ময়ের বিষয়। তারপর অতীত হলো সুদীর্ঘ কাল। আবির্ভূত
হলেন ভগবান ‘কশ্যপ’ বুদ্ধ। তাঁর শাসন কালে
ভাবী অম্বপালীর জীবনের কিঞ্চিৎ উন্নতি সাধিত হলো। তিনি এ যাত্রায় ব্রহ্ম চারিণী ধর্ম
অবলম্বন করতে পেরেছেন। এ কারণে, মৃত্যুর পরতিনি
“তাবতিংসস্বর্গে উৎপন্ন হলেন। কিন্তু, এসুখতাঁর
জন্ম জন্মান্তরের সুখেপরিণত হতেপারল না।
চির মুক্তি লাভ না হওয়া পর্যন্ত
মানবের জন্মান্তর ধারা শেষ হয় না। ভগবান গৌতম
বুদ্ধের শাসন কালে এ রমণীর জন্ম প্রবাহ থেমে যাবে। সুতরাং এ জন্য তাঁর অন্তিম জন্ম, আবার এ মৃত্যুই
তাঁর চির মৃত্যু। স্বর্গ বাসিনী এ দেবালার স্বর্গের আলো নিপ্রভ হয়ে এলো। আলো নিভে যেতেই দেখলেন তিনি মানব কুলের প্রদীপ। দেখলেন মাতৃগর্ভে জন্ম গ্রহণ করে নয়, বৈশালীর মনোরম
রাজোদ্যানে আম্র শাখান্তরে ঔপপাতিক রূপে জন্ম গ্রহণ করে। অতীতে যে জন্মে তিনি ভিক্ষুণীত্ব
লাভ করে ছিলেন, সে জন্মে গর্ভবাসের প্রতি বিরাগই তাঁর কাছে বিরাট রূপে দেখা দিয়ে ছিল। এ বিরাগই তাঁর জীবনকে ঘৃণ্য করে তুলল। তাই
তিনি ভবিতব্যে ঔপপাতিক জন্ম লাভেরই আন্তরিক প্রার্থনা করে রেখে ছিলেন। উদ্যান পাল এ সুদর্শন নারী শিশুকে দেখে সবিস্ময়ে
রাজ হস্তে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত হলো। অম্বশান্তরে জন্ম হেতু রাজা এর নাম রাখলেন
‘আম্বপালী। ’
কয়েক বৎসর পরের কথা। আম্বপালী ক্রমে কৈশোর অতি ক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। এখন রূপ মাধুরী তাঁর লতিকাদেহ ফেটে পড়তে চায়। তা অবশ্য অতীত জনের কশল কর্ম ও প্রার্থনার
ফল। তেমনি কিন্তু, অতীতের কৃত দুষ্কর্ম হেতু এ রূপ লাবণ্য তাঁকে ঘৃণার
পথে যে টেনে নেবে, এটা তিনি বুঝতে পারেন নি।
অম্বপালীর অসামান্য এ রূপ লালিত্য বৈশালীর রাজ কুমারদের সম ভাবে মুগ্ধ করল।
সকলেই পেতে চায় অম্বপালীকেই তাঁর পাণি প্রার্থী।
তাঁদের মধ্যে ভীষণ প্রতি যোগিতা আরম্ভ হলো
অম্বপালীকে কেন্দ্র করে। একা ধারে তাঁর নয়না
ভিরাম রূপ লাবণ্য, বীণা বিনিন্দিত কণ্ঠস্বর ও ভুবন মোহিনী নৃত্য ভঙ্গিমা ত্রিবেণীর
ত্রিধারার মতো অম্বপালীর মধ্যে বয়ে চলছে। কিন্তু,
এক জন নারীকে সকলে লাভ করতে পারে কি রূপে, এটাই হলো সমস্যা। সমস্যার সমাধান হলো সকলে সমভাবে লাভের উপায় স্বরূপ
তাঁকে গণিকা বৃত্তিতে নিযুক্ত করা হল।
কিছু দিন গত হলো। মগধরাজ
বিম্বিসার তখন তরুণ যুবক। তাঁর কর্ণগোচর
হলো যুবতী অম্বপালীর রূপ মাধুর্যের প্রশংসা কাহিনী। শুনে মুগ্ধ হলেন বিম্বিসার। উদ্বেলিত করে তুলল তাঁকে। তাঁর মনে জাগল কামনা বাসনার তীব্র তাড়না,
অনুরাগের প্রবল আকর্ষণ। এক দিন ছদ্ম বেশে
মগধরাজ উপনীত হলেন নগর শোভিনী অম্বপালীর প্রমোদ ভবনে।তাঁর চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হলো। অম্বপালীর অপূর্ব লাবণ্যচ্ছটা, বিলোল কটাক্ষ,
মনোরম অঙ্গ সৌষ্ঠব দেখে তিনি বিমুগ্ধ। হলেন সেদিন তাঁর রাজ প্রাসাদে আর ফেরা হলো না। রাজা বিম্বিসারের সহিত অম্বপালীর মিলন ঘটল বড়ো
শুভ ক্ষণে। এ মিলন এক দিন এনে দেবে
অম্বপালীর ভাগ্য কাশে সুখ সূর্যের আবির্ভাব।
বৈশালীর নগর শোভিনী, জগৎ কল্যাণী শান্তির মন্দাকিনী।
অম্বপাপী হলেন অন্তঃসত্ত্বা। রাজা উপহার স্বরূপ প্রদান করলেন বহু অর্থ, আর
হীরা মুক্তার অলঙ্কার। দশ মাস অতীত হলো। সুবর্ণ প্রতিমা সদৃশ এক পুত্র সন্তান লাভ করে অম্বপালী
অনুভব করলেন মাতৃত্বের গৌরব। এ নব জাত
সন্তানের নাম করণ মূলে রয়েছে অতীত জন্মের এক অপূর্ব কাহিনী। কথিত আছে এ শিশু অতীত জন্মে চারটি স্বর্ণময়
পুষ্পের দ্বারা ‘বিপর্শীৎ’ বুদ্ধে পূজা করে ছিলেন। তখন সর্বজ্ঞ বুদ্ধ এমন এক অলৌকিক শক্তি (ঋদ্ধি)
বিকাশ করলেন যে তদ্বারা হয়ে ছিল চতুর্দিকে উদ্ভাসিত। সম্বুদ্ধের এ আলোক সামান্য
প্রতিভা দর্শনে যুগপৎ তিনি হয়ে ছিলেন বিস্মিত ও আনন্দিত। এ আনন্দানু ভূতির মহাপুণ্যই তাঁর ভবিষ্যৎ করে
ছিলো উজ্জ্বল। সে পুণ্যেই তিনি মৃত্যুর পর
‘তুষিত’ স্বর্গে জন্ম লাভ করে ছিলেন। ইহ জন্মে
সে পুণ্যেই। হয়ে ছিলেন সুদর্শন ও বিমল
কান্তি। তাই তাঁর নাম হলো ‘বিমল কোন্ডণ্য। ’ সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না।
ক্রমে মাসের পর মাস বৎসরের পর বৎসর অতীত হয়ে
যায়। স্নেহের বিমলকে নিয়ে অম্বপালীর সুখের
দিন সমভাবেই অতি বাহিত হচ্ছে।
এক দিন ভগবান গৌতম বুদ্ধ
বৈশালীতে পদার্পণ করে সকল কে ধর্মোপদেশ প্রদান করে ছিলেন। বুদ্ধের অমৃতময় বাণী অম্বপালীর চিত্তকে আকৃষ্ট
করল। তিনি ধর্ম ভাবে জাগ্রত হলেন। নৈর্বাণিক ধর্মের বিমুক্তি সাগরে অম্বপালীর
নারী হৃদয়ের শ্রদ্ধা ঠাঁই পেল না। ছোট ছেলে
মেয়ে দের চিত্ত কাঁচের মতো নির্মল ও স্বচ্ছ। কাঁচের সম্মুখে যে রূপ তুলে ধরা হয়, সে রূপই
থাতে প্রতি ফলিত হয়। ছোট শিশু বিমলের বয়ো বৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জ্ঞানও তদ্রুপ বেড়ে চলেছে। শাক্য মুনির প্রতি মা অম্বপালীর অচলা শ্রদ্ধা ও
অটল বিশ্বাস, বিমলের মধ্যেও তা বিকাশ লাভ করল। পুণ্য সংস্কারের প্রবল আকর্ষণে বিমল বুদ্ধ শাসনে
দীক্ষা নেবার জন্য আকুল হয়ে উঠলেন। এক দিন
আকুলতার আতিশয্যে মাকে বলে বসলেন “মা, ভগবান বুদ্ধের যা’ ধর্ম ব্যাখ্যা শুনে আসছি,
তা তো গৃহ বাসে থেকে সম্যক আচরণ করা সম্ভব নয়। ব্রহ্ম চর্যের মাধ্যমে মুক্তির সন্ধানার্থ আপনি
আমায় বুদ্ধ শাসনে দান করেন না কেন?”
পুত্রের এ অভাবনীয় প্রশ্নে
অম্বপালী যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। ছেলের মনো ভাব তিনি সম্যক উপলব্ধি করে
বললেন “সাধু বিমল, তোর এরূপ সুমতিই আমি চেয়ে ছিলাম। একমাত্র তুই আমার অঞ্চলের নিধি, চক্ষের মণি, হৃদয়ের
আনন্দ। বাবা, তোর শাসনিক জীবনের জন্য
বুদ্ধ শাসনে তোকে দান করে, এ ভেবে প্রাণে প্রবোধ দেবো যে আমি মা হয়ে তাকে সত্য ও অহিংসার
পথে ছেড়ে দিতে পেরেছি। অচিরে অম্বপালী
পুত্র বিমলকে বুদ্ধ শাসনে উৎসর্গ করে দিলেন। বিমল কোন্ডণ্য ক্রমে প্রব্রজ্যা উপসম্পদায়
উন্নীত হয়ে সমাধি ভাবনায় নিজকে নিয়ন্ত্রিত করলেন। তার সাধনা সার্থক হলো। তিনি তৃষ্ণা ক্ষয় করলেন। অর্থৎ ফল সাক্ষাৎ করে
নৈর্বাণিক পুরা শান্তি অনুভব করলেন। প্রীতিরসে
তাঁর অন্তর ভর পুর হলো। তখন তিনি ভাষণ
করলেন এ প্রীতি গাথা “আম্র বৃক্ষে উৎপন্ন অম্বপালীর গর্ভে বিম্বিসারের ঔরসে আমি
জন্ম গ্রহণ করেছি। প্রজ্ঞা রূপ কেতু দ্বারা মান রূপ কেতু ধ্বংস করেছি। মহা কেতু ক্লেশমারকে ধ্বংস করে আমি অৰ্হত্ব ফল
সাক্ষাৎ করেছি। ”
অন্য এক দিন। বার বনিতা অম্বপালী শুনতে পেলেন যে ভগবান বুদ্ধ
কোটি গ্রামে উপনীত হয়ে অমৃতোপম ধর্মোপদেশ পরিবেশন করছেন। তিনিও প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় অনুপ্রাণিত হয়ে বুদ্ধ দর্শন
ও ধর্ম শ্রবণ। মানসে তথাগত সন্নি ধানে উপনীত হলেন। সুগতকে বন্দনান্তর তিনি উপবিষ্ট হলে অম্বপালীর
চিত্তানু রূপ তিনি ধর্ম দেশনা করলেন। দুঃখ
নিবৃত্তির সম্যক উপায় শান্তি প্রদ ধর্মোপদেশে তাঁর চিত্ত হলো স্নিগ্ধ, প্রীতিসেও
হলো পরি পূর্ণ। আগামী দিবসের জন্য তাঁর
বাস ভবনে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে তিনি নিমন্ত্রণ করলেন। বুদ্ধের মৌনসম্মতি পেয়ে তিনি প্রফুল্ল মনে গৃহাভিমুখে
প্রত্যাবর্তন করলেন।
বৈশালীর লিচ্ছ বিদের সাথে তাঁর
দেখা হলো পথি মধ্যে। লিচ্ছ বিকুমারগণ বিবিধ
বর্ণের মূল্যবান সুন্দর সজ্জায় সজ্জিত হয়ে মনোরম বিচিত্র রথারোহণে কোটি গ্রাম অভি মুখে
চলেছেন। উদ্দেশ্য, তথাগতকে নিমন্ত্রণ
করবেন তাঁরা। পথের মধ্যে স্মিতাননা
অশ্বপালীর দেখা পেয়ে সবাই কৌতুক বাক্যে বলে উঠল ‘ব্যাপার কি হে, আজ বড়ো ফুল্লাননা
যে!” অম্বপালী মৃদুহাস্যে উত্তর করলেন “হবো না? এ যে নারীর স্বভাব ধর্ম। এতে
আশ্চর্য হবার কি আছে? আজি কার আনন্দের আরো একটু বিশেষত্ব আছে যে হেতু, আমি সশিষ্য
বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করেছি আগামী কালের জন্য। ”
লিচ্ছ বিদের মনের স্বাভাবিক
প্রফুল্লতা একটু ম্লান হয়ে এলো। কারণ,
তারাও আসছেন সে উদ্দেশ্যে। তাঁরা এক
প্রকার প্রস্তুতও হয়ে ছেন তজ্জন্য। কিন্তু, অম্বপালী হয়েছে এখন এর প্রতি বন্ধক। তাঁরা নিরাশ হলেও, কিন্তু সম্পূর্ণ আশা ত্যাগ
করলেন না। মনে করলেন “বারাঙ্গনা সাধারণতঃ
অর্থ লোলুপ। যথেষ্ট অর্থের প্রলোভন
দেখালে, নিশ্চয়ই তাঁর মত বদলাবে। ” তাঁরা অশ্বপালীকে বললেন “আচ্ছা অম্বি, আমাদের
উদ্দেশ্যও তো তোমায় একটু জানান দরকার। এ
যে আমরা সবাই চলেছি কোটি গ্রাম অভি মুখে, তা এক মাত্র আগামী কালের জন্য বুদ্ধ
প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে নিমন্ত্রণ করতে। কিন্তু, তোমার এক জনের জন্য সবাই আমরা নিরাশ
হতে বসেছি। তোমার ব্যক্তি গত বাসনার চেয়ে
আমাদের সমষ্টিগত বাসনাকে কি বড় করে দেখবে না? আগামী কালের জন্য তোমার নিমন্ত্রিত
সশিষ্য বুদ্ধকে আমাদের দাও। এর বিনিময়ে
তোমায় লক্ষ টাকায় পুরস্কৃত করবো। ”
অম্বপালী তাঁদের কথা শুনে হো হো
করে হেসে ফেললেন। তাঁদের এ প্রস্তাবে
সত্যই তার নারী হৃদয় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। কারণ, বারাঙ্গনা হলে কি হয়, এক জন নারী হিসাবে
এটা তাঁর আত্ম মর্যাদায় আঘাত দিয়েছে। আর অহিংস নির্বিরোধী বুদ্ধের নিকট বারাঙ্গনা
ও কুলাঙ্গনার পার্থক্যই বা কি? না, এটা তেমন হতে দেবেন না তিনি। অম্বপালী ঘূণা ব্যঞ্জক স্বরে অথচ হেসে বললেন
“আমি দুঃখিত যে, আপনাদের এ প্রস্তাবে আমি আপনাদের সঙ্গে এক মত হতে পারলাম না। কারণ, ‘অজ্জেব কিং আতপ্পং’ হিসাবে আমার দান কার্য শীঘ্রই সম্পন্ন করতে ইচ্ছা করি। আপনারা লক্ষ মুদ্রার লোভ কেন, সমগ্র বৈশালী
প্রাপ্তির লোভ দেখালেও, এতে আমার সম্মত হবার উপায় নেই। ”
লিচ্ছবি কুমারগণ অম্বপালীর
অসন্তোষের ভাব লক্ষ্য করলেন। তাঁদের একথায় যে তিনি সুখী হতে পারেন নি, এটা তাঁর
ক্ষুব্ধ অন্তরের উষ্ম থেকেই প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু, অম্বপালীর ব্যক্তিগত অসন্তোষকে
যে তাঁদের সমষ্টিগত অসন্তোষ ছেপে উঠেছে, এটা তাঁদের বেশ উপলব্ধি হলো। অম্বপালীর
মতো এক জন গণিকার নিকট যে তাঁদের সমষ্টিগত ইচ্ছা উপেক্ষিত হলো এ অবমাননা তাঁদের
পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠল।পরদিবস পূর্বাহ্ন ভগবান তথাগত সশিষ্য অম্বপালীর মনোরম আম্রোদ্যানে উপনীত হলেন। আম্বপালী বুদ্ধ
প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে স্বাগত দেখে সশ্রদ্ধ সংবর্ধনায় সুসজ্জিত আসনে তাঁদের উপবেশন
করালেন। এবং উত্তমতর খাদ্য ভোজ্য পরি তৃপ্ত
করলেন। ভোজন কৃত্য সম্পন্ন হলে, অন্দপালী
সুগতকে বন্দনা করে বিনীত বাক্যে বললেন ভগবান, আমার একান্ত বাসনা যে আমার এ
আম্রোদ্যান আপনাদের দান করি। দয়া করে এ
উদ্যান দান গ্রহণ করলে আমি চির কৃতার্থ হবো। ”
তথাগত মৌন সম্মতিতে আম্বপালীর প্রদত্ত আম্রোদ্যান গ্রহণ করলেন। আবার তিনি ভাবলেন “আমার প্রদত্ত এ উদ্যান দিয়ে তাঁরা কি করবেন, যদি তাঁদের বিহরণের জন্য বিহার প্রস্তুত করে না দিই? যত দিন তিনি বিহার নির্মাণ করে দিতে না পারেন, তত দিন তিনি স্বস্তি পাবেন না। সুতরাং অম্বপালী অচিরেই আম্রোদ্যানে সুন্দর ও চারুশিল্প শোভিত এক বিরাট বিহার নির্মাণ করালেন এবং এ নবনির্মিত বিহার বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে দান করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। আনিন্দ্য সুন্দরী অম্বপালীর জীবন গাঙে ভাটা ধরেছে। জরা জীর্ণতা ও ব্যাধি বার্ধক্যের নির্মম নিষ্পেষণে অম্বপালী এখন নিষ্পেষিত। অনিত্যত্ব ও ক্ষণ ভঙ্গুরত্বের বিষ বাষ্পে তাঁর সুন্দর সতেজ তনু মন বিষাক্ত। যৌবনোন্মাদনার কোনও তীব্র রস তাঁর এ শুষ্ক ও তিক্ত প্রাণকে আর সরস মধুময় করে তুলতে পারে না। তিনি এখন নির্জন প্রিয়। নিরালায় বসে শরীরের অনিত্যত্ব চিন্তা করতেই তিনি ভালো বাসেন। তিনি ভাবেন
১। আমার মস্তক কেশ ছিল কতো সুন্দর। কুঞ্চিতা ও সুরভিত ছিল আমার শোভন মোহন ভ্রমর কৃষ্ণ
সুদীর্ঘ কেশ রাশি। কনক ও হীরক সূচী
সমলস্কৃত, পুষ্পমাল্য শোভিত, সুগন্ধি তৈল সিক্ত কেশক লাপ এখন হয়েছে শশক লোমের মতো
শ্বেত বর্ণ ও দুর্গন্ধ যুক্ত। আমার
সুদৃশ্য ঘন কেশ রাশি এখন হয়েছে বিরল কেশ, জটা যুক্ত ও বিশ্রী।
২। সুদক্ষ শিল্পীর রেখা চিত্রের মতো সুন্দর সুশোভন
নীল বর্ণ যুগল হয়েছে বলী যুক্ত ও বিশ্রী।
৩। সমুজ্জ্বল নীল মণি সদৃশ শোভন মোহন হরিণনেত্র
আমার জানা। হয়েছে জ্যোতি হীন, অভি হত
চক্ষু মল সমাকীর্ণ ও শ্রীহীন ।
৪। সুচার হরি তাল বর্তিকা সম উন্নত শোভ মান আমার
নাসিকা এখন বক্র সৌন্দর্য হীন হয়েছে।
৫। সুবর্ণ কঙ্কন সদৃশ সুন্দর কর্ণ পত্র এখন বলী যুক্ত
হয়ে প্রণমিত বস্ত্র খন্ড সম ঝুলছে।
৬। শোভন শুভ্র অবিরল কুন্দ দন্তু আমার খন্ডিত
স্খলিত হয়ে বিশ্রী হয়েছে। যে কয়টা আছে, তাও হয়েছে পীত বর্ণ।
৭। রম্য কাননে মহানন্দে বিচরণ কারিণী কোকিলার
সুকণ্ঠ সম আমার সুমধুর মদন মোহন কণ্ঠস্বর এখন হয়েছে মধুরতা ও মাদকতা হীন! খন্ড
দন্ত হেতু শব্দ স্খলিত হয় কথা বলতে।
৮। সুন্দর ও মসৃণ সুবর্ণ শঙ্খনিভ সুগোল, স্নিগ্ধ,
কোমল ও সুগঠন গ্রীবা আমার এখন হয়েছে মাংস হীন, শিরা জাল সমাকীর্ণ, বিনত ও বিশ্রী।
৯। সুন্দর, মনোরম, নিটোল, সুগোল ও মাংসল আমার বাহু
যুগল এখন হয়েছে জীর্ণ, বলী যুক্ত, শিরা জাল বেষ্টিত ও বিশ্রী।
১০। হীরা মুক্তা খচিত স্বর্ণালঙ্কার ভূষিত মসৃণ
সুন্দর হস্তদ্বয় এখন হয়েছে বিশুষ্ক, বলী যুক্ত ও শিরা জাল বেষ্টিত।
১১। সুগোল পীনোন্নত পয়োধর এখন জলনিষ্কাশিত চর্ম
স্থাবিকা সদৃশ ঝুলছে।
১২। সুমার্জিত কাঞ্চন ফলক সদৃশ নয়ন মোহন অপরূপ রূপ
শ্রীমন্ডিত আমার শরীর এখন হয়েছে অমসৃণ, বলী যুক্ত ও বিশ্রী।
১৩। সুন্দর, সুগোল, মাংসল ও
মসৃণ আমার উরুপ্রদেশ এখন হয়েছে বংশ পর্ব সদৃশ বিশ্রী।
১৪। স্বৰ্ণনু পূরে বিভূষিত স্নিগ্ধ, মসৃণ ও মনোরম
জঙ্ঘ প্রদেশ এখন রক্ত মাংস হীন কৃশ হয়ে বিশুদ্ধ তিল দন্ড সদৃশ হয়েছে।
১৫। সিম্বলী তুলা পূর্ণ সুন্দর মসৃণ পাদুকা সদৃশ
আমার পদদ্বয় এখন হয়েছে ফালিত, বলী যুক্ত ও শ্রী হীন।
১৬। আমার শরীরের সন্ধি বন্ধ হয়েছে শিথিল। এ দেহ বহু দুঃখের আগার, প্রলেপ পরি ক্ষয়
পতনোম্মুখ জীর্ণ গৃহ সদৃশ। ভগবান বুদ্ধ
যথার্থই বলেছেন, প্রাণীজগৎ ও জড়জগৎ অনিত্যে কবলিত। জগতে চির স্থির কিছুই নেই।
আম্বপালী কখনও কখনও ভাবেন “আমার
অনিশ্চিত এ বিষাক্ত দুঃখময় জীবনের জন্য কেবল কি বার্ধক্যই দায়ী? না, কেবল বার্ধক্য
নয়। এর জন্য দায়ী আমার মিথ্যা ভ্রান্তি,
আর ভ্রান্তির মালিক আমি নিজে। কারণ, আমি শূন্যের মধ্যে খুঁজে ছিলাম পূর্ণকে;
অস্থির চঞ্চলের মধ্যে খুঁজে ছিলাম চির শান্তিকে; ভোগের মধ্যে খুঁজে ছিলাম পরা শান্তিকে।
” এখন তাঁর প্রমাণ পেয়েছেন তিনি মর্মে মর্মে তাঁর ক্রম বিলীয় মান সেই যৌবনে, তাঁর
সেই নিটোল দেহে, তাঁর সেই রূপ মাধুর্যে, তাঁর সেই ভ্রমর কৃষ্ণ কেশ কলাপে, তাঁর সেই
মুক্তা শুভ্র দন্তে, তাঁর সেই হরিণাক্ষিতে, তাঁর সেই কোকিল বিনিন্দিত কণ্ঠস্বরে,
তার জীবনের সব কিছুতেই। এখন তিনি উপলব্ধি করলেন “সংসার অনিত্য, রূপ যৌবন
ক্ষণস্থায়ী। ”
এক দিন অম্বপালীর এ ধারণাকে আরো দৃঢ় তর করে দিল তাঁর গর্ভজাত পুত্র বিমল কোন্ডণ্যের ধর্মোপদেশ। ইনি যখন শাস্তার বাসনা বিলয় মুক্তি বাণী প্রচার করে দেশ দেশান্তর পরি ভ্রমণ করে ছিলেন, তখন অম্বপালীর সুযোগ ঘটল আপন পুত্রের মুখে ধর্ম শোনবার। এ ধর্ম শ্রবণই তাঁকে সাংসারিক হীন গণিকা জীবনে করে তোলে বীতস্পৃহ। সুখের মায়া মরীচিকা রূপান্তরিত হয়ে দেখা দিল দুঃখ বিভীষিকার। রুদ্র মূর্তি রূপে। তাই তিনি অবিলম্বে ভিক্ষুণী ব্রত অবলম্বন করে অবশিষ্ট জীবন বিদর্শন সাধনায় আত্মনিয়োগ করলেন। এতেই তাঁর সম্যক উপলব্ধি হলো জগতের ক্ষণ স্থায়িত্ব, ত্রিলোক দুঃখের আকর, আত্মার অস্তিত্ব রিক্ত শূন্য। অনুক্রমে তিনি চার প্রতিসম্ভিদা (অর্থ, ধর্ম, নিরুক্তি ও প্রতিভান) সহ ঋদ্ধি শক্তি, দিব্য চক্ষু, দিব্য কর্ণ, পরচিত্ত বিজানন জ্ঞান ও জাতি স্মর জ্ঞান প্রভৃতি প্রতি ভায় প্রতি ভাশালিনী হয়ে অর্হত্ব ফল সাক্ষাৎ করলেন। অম্বপালী জীবন কহিনী সমাপ্ত।