সুজাতা
সুজাতা
ছোট কাল থেকেই সুজাতা অত্যন্ত মুখরা। স্বভাবও তার দাম্ভিক। অতুল ঐশ্বর্যের মধ্যে সে হচ্ছে লালিত পালিতা। মাতা পিতার অনুপম স্নেহ মমতার মধ্য দিয়ে সে যতই বড় হতে লাগল, ততই বেড়ে উঠল তীর দৌরাত্ম। শ্রাবস্তীর ধন কুবের ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা সুজাতা, পুণ্য শ্লোকা বিশাখার কনিষ্ঠা সহোদরা। কিন্তু হলে কি হয়, বিশাখার স্বভাবের সঙ্গে সুজাতার স্বভাব কোন খানেই মিশ খায় না। বড় বোন বিশাখা ধীর, স্থির, বিদূষী, বিনীতা, শান্ত শীলা ও বুদ্ধি মতী; আর ছোট বোন সুজাতা কিন্তু এর বিপরীত মুখরা, চপলা, প্রগল্ভা, দুর্বিনীতা ও অভিমানিনী।
আরো দেখুন: পটাচারা জীবনী
আরো দেখুন: আম্বপালী জীবন কাহিনী
সুজাতা |
পিতা ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর ধনের তুলনা
নেই। তাঁর প্রকান্ড ভবন, বড় বড় প্রাসাদ,
ছোট বড় কতো ঘর, প্রকান্ড প্রকান্ড অঙ্গন, সম্মুখে বৃহৎ সবোবর, সুন্দর
পুষ্পোদ্যান, হস্তি শালায় হস্তী, অশালায় অশ্ব, গোশা লায় গোধন, কতো দৌবারিক, কর্ম
চারী ও দাস দাসী! ভান্ডারে ভান্ডারে বস্ত্র, তন্দুল, ঘূত তৈল, আরো কতো কি! সোনা
রূপা, হীরা মুক্তা, মণি মাণিক্য কতো অপার ঐশ্বর্য। আর সেই ঐশ্বর্যের মধ্যে সুজাতার আধিপত্য রাজ
রাণীর চেয়েও অধিক। এক জনকে ডাকলে দশ জন
দৌড়ায়।
বহু কোটি ধন ব্যয়ে ধন পতি ধনঞ্জয
শ্রেষ্ঠ। ঐশ্বর্য শীল দেখিয়ে মহা সমরোহে শ্রাবস্তীর মিগার শ্রেষ্ঠীর পুত্রের সঙ্গে
জ্যেষ্ঠা কন্যা বিশাখার বিবাহ কার্য সম্পাদন করলেন। বিশাখার বিবাহ ব্যাপার এক অত্যাশ্চর্য কাহিনী। জগতের
লোক এখনও তা শুনলে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। বিশাখাও যে কি রূপ পুণ্যবতী ও ভাগ্যবতী ছিলেন,
সাধারণের তা ধারণার অতীত। বিশাখার বিবাহের সময় তাঁকে যে এক অলংকার দেওয়া হয়ে ছিল,
সে অলংকারের নাম মহলতা প্রসাধন। এর মূল্য
লক্ষাধিক নয়, কোটি মুদ্রা। যৌতুক সামগ্রী যা দেওয়া হয়ে ছিল, তার তুলনা মিলে না।
সুজাতা এখন ষোড়শী যুবতী। তার নিটোল দেহের উজ্জ্বল গৌর কান্তি ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর
বিশাল ভবন আলোকিত করে তুলেছে। এক সময়
শ্রাবস্তীর মহা শ্রেষ্ঠী অনাথাপিন্ডিক সুজাতাকে দেখে প্রসন্ন হলেন। তার আকৰ্ণ বিস্তৃত কৃষ্ণ চোখ দু’টির অপূর্ব
উজ্জ্বল তার মধ্যে কেমন এক মহীয়সী ভাবের অন্যবদ্য নিদর্শন দেখতে পেয়ে তাকে পুত্র বধূ
করবার জন্য অনাথপিন্ডিক ব্যর্থ হয়ে উঠলেন।
একদা তিনি ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর
নিকট একথা উত্থাপন করলেন। তিনিও সাগ্রহে
কন্যা সম্প্রদানের সম্মতি প্রদান করলেন। কারণ, তিনি জানেন যে, অনাথপিন্ডিক এক দিকে
যেমন ধন শালী ও কুল মর্যাদা সম্পন্ন, অন্য দিকে তেমনি অসাধারণ ধর্ম পরায়ণ ও
ত্রিরত্নের শ্রেষ্ঠ উপাসক। সুতরাং এমন
ব্যক্তির পুত্রের জন্য কন্যা সম্প্রদান করতে ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর দ্বিরুক্তি করার
কিছুই নেই। অনাথপিন্ডিক আনন্দিত হয়ে
বিবাহের শুভলগ্ন নির্ধারণ করে উৎসব কার্যের আয়োজনে লেগে গেলেন।
ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী চিন্তা করলেন
“বিশখার বিবাহে যত ব্যয় ও জাক জমক করা হয়েছে, সুজাতার বিবাহে তেমন না হলেও অন্ততঃ
কিছু না করলে মানাবে কেন?” এ ভেবে তিনি কন্যার বিবাহে মহাড়ম্বরের উদ্যোগ করতে
লাগলেন। যথা সময়ে মহা সমারোহে শুভ পরিণয় সম্পন্ন হলো। সুজাতা শ্বশুর কুলে যাবার সময় বহু লক্ষ মুদ্রার
যৌতুক তার সঙ্গে দেওয়া হলো। তখন এমন এক
বৈশিষ্ট্য পূর্ণ শোভা যাত্রার সমারোহ শ্রাবন্তীকে আলোড়িত করে তুলল যে সে স্মৃতি
দীর্ঘ কাল শ্রাবস্তী বাসীর অন্তরে বিরাজিত থেকে সুজাতার সৌভাগ্য মহিমা ঘোষণা
করেছিল।
বিরাট শোভা যাত্রা ধীরে ধীরে
অগ্রসর হলো। এ অপূর্ব দৃশ্য দর্শন মানসে শ্রাবস্তীর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অগণিত
লোক বিস্তৃত রাজ পথের উভয় পার্শে ভিড় জমিয়েছে। শোভা যাত্রায় কত রকম বাদ্য; বাদ্যের সম্মিলিত
ঝঙ্কারে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছে। কত
সুসজ্জিত হস্তী, অশ্বথ, কত বিচিত্র প্রহসন, কত মনোরম সাজে সজ্জিত পুষ্পমান ধীরে
মন্থরে অগ্রসর হচ্ছে। সুদীর্ঘ শোভা যাত্রা
যেতে যেতে আর ফুরায় না।
অই দূরে দশ ঘোড়ার পুষ্প রথে নব
দম্পতি আসছে লীলায়িত গতিতে দর্শক বৃন্দের নয়ন মন বিমোহিত করে। মহার্ঘ পরিচ্ছেদে ভূষিত বর রাজ বেশে, পাত্রী রাজ
রাণীর বেশে। পাত্রীর গৌরতনু বেষ্টন করে এক
খানি অতি সূক্ষ্ম ক্ষৌমপট্র শাড়ী, শাড়ীর প্রশস্ত দীপ্তোজুল সোনালী পাড়, হীরা মুক্তার
অলংকার থেকে যেন বিদ্যুৎ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, মুক্তার কর্ণ ভূষণ, মাথয় হীরার মুকুট,
শুভ্র নিটোল কণ্ঠে উজ্জ্বল হীরা মুক্তার হার। সকলের বিস্ময় উৎপাদন করে শোভা যাত্রা অগ্রসর
হচ্ছে। পর পর আরো কত গাড়ী, কত শত লোক,
তার পর বহু মূল্য যৌতুক সামগ্রী পূর্ণ শত শত গো শকট। দর্শ কবৃন্দ বিমোহিত হয়ে
প্রশংসা বাক্যে বলতে লাগল “স্বয়ং রাজ লক্ষ্মী যেন রাজ ভান্ডার পূর্ণ করতে চলেছেন।
”
শ্ৰেষ্ঠী পত্নী সানন্দে নব বধূ
বরণ করে নিলেন। বধূর রূপ দেখে তিনি খুবই
প্রীত হলেন। মনে মনে প্রার্থনা করলেন “এ
লক্ষ্মী স্বরূপিণী নব বধূর গুণে আমার সোনার সংসার উজ্জ্বল হোক। ” দেশবাসী নব বধূকে
দেখবার জন্য ভীড় জমিয়েছে। সকলেই এক
বাক্যে প্রশংসা করতে লাগল “বেশ চমৎকার বৌ!”
শ্বশুর ঘরে দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস অতীত হতে চলল সুজাতার দিন। তার পিতার অতুল ঐশ্বর্য্যের নিকট শ্বশুরের সম্পত্তি
সামান্য হলেও উপেক্ষণীয় নয়। তবুও শ্বশুর
কুলের বৈভব সুজাতার মনে সন্তোষ বিধান করতে পারল না। অনাথপিন্ডিক জেতবন বিহার প্রস্তুত করতে চুয়ান্ন
কোটি স্বর্ণ মুদ্রা ব্যয় করেছেন, প্রতি দিন পাঁচশত ভিক্ষুর আহার্য প্রদান করেন,
অনাথদের জন্য তো অন্নসত্র খোলাই আছে। এতদ্ব্যতীত তাঁরবিশাল ভূসম্পত্তি, সুবৃহৎ
অট্টালিকা, কত কর্মচারী ও দাস দাসী রয়েছে। কিন্তু তবুও মনে ভরে না সুজাতার। ধীরে ধীরে তার
স্বভাব সুলভ আত্মম্ভরিতা ও প্রগলভতা উন্মুখ হয়ে উঠল। পৈতৃক সম্পত্তির গর্ব করে শ্বশুর কুলের প্রতি
অবজ্ঞা প্রকাশ করতে লাগল। স্বামীর প্রতি
অপ্রীতি, শ্বশুর শাশুড়ীর প্রতি অমান্যতা, তাঁদের বাক্যের উপর বাক্য প্রয়োগ এবং
তার উচ্চবাচ্য ও বাদ বিসংবাদ সকলকে শান্তি হীন ও অতীষ্ঠ করে তুলল।
শান্তি কামী সুখ বিহারী
শ্রেষ্ঠী ও শ্রেষ্ঠ পত্নীর সুখের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। তাদের শান্তির সংসারে অশান্তি পুঞ্জী ভূত হয়ে
উঠল। স্বর্গীয় আনন্দ মলিন হয়ে এল। চিন্তিত হলেন অনাথপিন্ডিক। স্বনাম ধন্য মহা শ্রেষ্ঠী অনাথপিন্ডিকে পুত্র
বধূর কুৎসা প্রচার হওয়াই যে তাঁর মর্যাদা হানিকর, এ আশংকাই তাকে সব চেয়ে বিচলিত
করে তুলল। অগত্যা তিনি নীরব থাকাই বুদ্ধি মানের
কাজ মনে করলেন।
এক দিন তথাগত বুদ্ধ
অনাথপিন্ডিকের গৃহে উপস্থিত হয়ে সুসজ্জিত আসনে উপবেশন করলেন। শ্রেষ্ঠীর প্রবর তাঁকে বন্দনান্তে এক পাশে বসে
আলাপে প্রবৃত্ত হলেন। এমন সময় অন্তঃপুর
হাতে কল হের উচ্চ শব্দ শুনে সুগত জিজ্ঞাসা করলেন “মহা শ্রেষ্ঠী, কৈবর্তদের মৎস্য
ভাগের সময় যেরূপ কোলা হল হয়, আপনার অন্তঃপুর থেকে সেরূপ। কোলা হল শব্দ শোনা যাচ্ছে কেন?”
একথা শুনে শ্রেষ্ঠীর সদা
প্রসন্ন মুখ বিমর্ষ হয়ে গেল। দুঃখের সাথে
তিনি বললেন “ভগবান, আমার পুত্র বধূ সুজাতাই যত অনর্থের মূল। ধন কুবের ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা কি না, তাই তার
অহঙ্কার বড়ো বেশী। সে মান্য করে না শ্বশুর
শাশু ড়ীকে, স্বামী করে না গ্রাহ্য, এমন কি প্রভু, আপনার প্রতিও সম্মান প্রদর্শনে
সে বড়ো একটা আগ্রহী নয়। আর অন্য কথাই বা
কি!”
শান্তা তখন সুজাতাকে আহ্বান
করলেন। সুজাতা এসে তাঁকে বন্দনা করে
একান্তে উপবিষ্ট হলো। ভগবান তাকে উপদেশ
প্রসঙ্গে বললেন “সুজাতা, পুরুষের ভার্যা সাত প্রকার। যথা বধ কাসমা, চৌরীসমা,
আর্যাসমা, মাতৃসমা, ভগ্নীসমা, সখীসমা ও দাসীসমা। এ সাত প্রকার ভার্যার মধ্যে তুমি কোন প্রকারের?”
সুজাতা বিনীত ভাবে বলল “ভগবান, আপনি সংক্ষেপে যা বললেন, তা ভালো করে বুঝলাম না,
অনুগ্রহ করে তা এমন ভাবে প্রকাশ করুন, যাতে আমি সহজে বুঝতে পারি। ” বুদ্ধ বললেন
“আচ্ছা, আমি এক একটা বিষয় বিস্তৃত ভাবে বলছি, তুমি মনো যোগের সাথে শ্রবণ কর।
১। যে স্ত্রী প্রদুষ্টচিত্তা, খলস্বভাবা, স্বামীর
অমঙ্গল চিন্তা কারিনী, পর পুরুষে আসক্তা, স্বামীকে অবজ্ঞ কারিনী, স্বামীর ধন সম্পদ
অপব্যয় কারিনী, অর্থ না পেলে অর্থ কারিনী, হত্যা করার ভয় দেখায় স্বামীকে, এমন কি,
হত্যা করতেও সমুৎসুক, তেমন স্ত্রীকে বধকাসমা। ভার্যা বলা হয়।
২। যে স্ত্রী স্বামীর শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি কর্মের
দ্বারা উৎপন্ন ধন সম্পদ পরিভোগ করে, তবুও স্বামীর সম্পদ চুরি করবার ইচ্ছা করে এবং
অল্প হলেও চুরি করে অর্থাৎ রান্নার সময় ধৌত করবার জন্য যে চাউল নেওয়া হয়, তার
থেকেও চুরি করে, ধান্য শস্যাদির আর কথাই বা কি? সে স্ত্রীকে বলা হয় চৌরীসম ভার্যা।
৩। যে স্ত্রী নিষ্কর্মা, আলস্য পরায়ণা, অধিক ভোজন কারিণী,
আহাৰ্য বস্তুর প্রতি অত্যধিক লোভ পরায়ণা, মুখরা, প্রচন্ডা, দুর্ভাষিণী, বাক্যের
উপর বাক্য বলে স্বামীকে পরাস্ত করবার চেষ্টা কারিনী ও স্বামীর উৎসাহ উদ্যম
অসহনশীলা সে স্ত্রীকে বলা হয় আর্য (কর্ত্রী) সমা ভার্যা।
৪। স্বামীর সঞ্চিত ধন যে স্ত্রী রক্ষা করে, সর্বদা
স্বামীর হিত কামিনী ও উপকারিণী, মাতার পুত্র রক্ষার ন্যায় স্বামীকে রক্ষা করে, সে
স্ত্রীকে বলা হয় মাতৃসমা ভার্যা ।
৫। জ্যেষ্ঠ সহোদরের প্রতি কনিষ্ঠা ভগ্নীর আদর ও
সম্মান প্রদর্শনের ন্যায় যে স্ত্রী স্বামীর প্রতি আদর সম্মান প্রদর্শন করে,
স্বামীর প্রতি লজ্জানতা এবং স্বামীর অনুবর্তিনী হয়, সে স্ত্রীকে বলা হয় ভগ্নীসমা
ভার্যা।
৬। দীর্ঘ দিন পরে সখার আগমনে সখীর আনন্দিত হওয়ার
মতো স্বামী দর্শনেও যে স্ত্রী আনন্দিতা এবং কুল মর্যাদা রক্ষা কারিণী, শীল বতী ও
পতি ব্রতা হয়, সে স্ত্রীকে বলা হয় সখীসমা ভার্যা।
৭। স্বামী শাসন অনুশাসন এবং লাঠি হস্তে তর্জন গর্জন
করলেও যে স্ত্রী চিত্ত দূষিত করে না বা ক্রোধ হিংসা উৎপন্ন করে না, বরং তিতিক্ষার
সাথে স্বামীর শাসন সহ্য করে এবং ক্রোধ হীনা শান্ত শীলা ও স্বামীর অনুগতা হয়, সে
স্ত্রীকে বলা হয় দাসীসমা ভার্যা।
তথাগত এ সাত প্রকার ভার্যা
সম্বন্ধে বর্ণনা করার পর আরো বললেন “সুজাতা, জগতে যে সকল ভার্যা বধা, চোরী ও
আর্যাসমা হয়, মুখরা, প্রভা, দুঃশীলা, লজ্জাহীনা হয় ও পুরুষ বাক্যে (কুঠারাঘাৎ সদৃশ
কথা) প্রয়োগ করে, স্বামীকে অনাদর করে ও অখাদ্য খাওয়ায়, স্বামীর রোগ হলে সেবা শুশ্রুষা
করে না, সেসব স্ত্রী মৃত্যুর পর নরকে জন্ম নিয়ে দুঃসহ দুঃখ ভোগ করে। আর যেসব স্ত্রী মাতৃসমা, ভগ্নীসমা, সখীসমা এবং
দাসীসমা, তারা মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোক সম্প্রাপ্ত হয়।
১। দুষ্টমতী, হিত ব্রতে চিত্র নাহি ধায়,
পতির সম্পত্তি সব দু’হাতে
উড়ায়।
নিজ পতি ঘৃণা করে, পর পুরুষে
তরে,
অথচ যাহার মন হয় উচাটন।
‘বধকা’ সে ভার্যা ইহা বলে
সর্বজন,
২। শিল্প বা বাণিজ্য কিংবা কৃষির শরণ।
লইয়া যে ধন পতি করেন অর্জন,
নিজ ব্যবহার করে যে তাহার অংশ
হবে।
পতির যে কষ্ট হবে, ভাবে না কখন,
চৌরী হেন ভাষা ইহা বলে
সর্বজন।
৩। কাজের নামেতে গায়ে জ্বর আসে যার,
অলসা অথচ করে প্রচুর আহার।
কোপনা, দুর্মুখ অতি, নাহি দয়া
কারো প্রতি,
দাস দাসী জনে কর নিয়ত পীড়ন।
‘আর্যা’ সেই ভার্যা ইহা বলে
সর্বজন,
৪। চিত্ত যার সদা হিত ব্রত পরায়ণ।
পতির সম্পত্তি যত্নে করে
সংরক্ষণ,
যেরূপ যতনে মাতা পুত্রের পালনে
ব্রতা।
পতির শুশ্রুষা তথা করে অনুক্ষণ,
‘মাতৃসমা হেন ভার্যা বলে
সর্বজন।
৫। কনিষ্ঠা ভগিনী যথা জ্যেষ্ঠ সহোদরে
নিয়ত সম্মান করে প্রফুল্ল
অন্তরে
সেই রূপ যে গৃহিনী পতির বশ বর্তিনী
লজ্জাবশে মুখে যার সলাজ বচন
সে ভার্যা ‘ভগিনী সমা’ বলে
সর্বজন।
বিলম্বে সখার সঙ্গে ঘটিলে মিলন
সখী যথা সুখী তাঁর নেহারি বদন
হেরিলে পতির মুখ তেমনি যে পায়
সুখ
সুজাতা সুশীলা সাধ্বী রমণীরতন
হেন ভার্যা ‘সখী সমা’ বলে
সর্বজন।
৭। উৎপীড়নে অসন্তোষ না উপজে যার
দন্ড ভয়ে কম্পমান সদা দেহ তাঁর।
সুশীলা তিতিক্ষাবতী ক্রোধ হীনা
হেন সতী
তুষিতে পতির মন রত অনুক্ষণ
‘দাসীসমা’ সেই ভার্যা বলে
সর্বজন।
৮। বধক, প্রচণ্ড, চৌরী অতীব দুঃশীলা
দয়া মায়া নাহি জানে গুরু জনে
নাহি মানে।
নরকে যাইবে সাঙ্গ করি ভবলীলা!
৯। জননী, অনুজা, সখী, দাসীসমা যারা
নিজের সুশীলতা বলে নিত্য
সংযমের ফলে
দেহান্তে স্বর্গে স্থান লভিবে
তাহারা।
সুজাতা, তোমায় আবার জিজ্ঞাসা
করছি এ সাত
প্রকার ভার্যার মধ্যে তুমি কোন
প্রকারের ভার্যা?”
তখন সুজাতা, গম্ভীর অথচ বিনীত
বাক্যে বলল “ভগবান, আজ থেকে আমায় স্বামীর দাসীসমা ভার্যা বলে মনে করুন। প্রভু, আমি এত দিন ছিলাম অন্ধকারে আবৃত, এখন
পেয়েছি আলোকের সন্ধান। এখন আমার ধ্বংস হয়েছে। ঐশ্বর্যের অহঙ্কার, আত্মাভিমান। করুণা ময়ের কৃপায় আমার ভ্রান্তির হয়েছে নিরসন। ভগবান, মহান বৌদ্ধ পরিবারের কুল বধূ হয়ে আমার এ
বিচ্যুতির জন্য আমি খুবই লজ্জিত অনুতপ্ত। আপনার
অমৃত ময়ী বাণী আমার হৃদয়ে জ্বেলে দিয়েছে জ্ঞানের আলোক বর্তিকা, পেয়েছি পথের
সন্ধান! করুণাময় প্রভু, আমায় ক্ষমা করুন। ” এ বলে সুজাতা সুগতের চরণ প্রান্তে
লুটিয়ে পড়ল। শান্তা আশীর্বাদ করলেন “সুখী
হও সুজাতা।সুজাতা সুগতের পদ প্রান্ত থেকে
উঠে শ্বশুরের পায়ে মস্তক রেখে ক্ষমা প্রার্থনা করল। মহা শ্রেষ্ঠী প্রসন্ন হাস্যে পুত্র বধূর মস্তকে
হস্ত রেখে আশীর্বাদ করলেন। তারঁ পর
শাশুড়ী ও স্বামীর নিকটও এভাবে ক্ষমা চাইল সুজাতা!
সেদিন থেকে সুজাতার জীবনে এলো
নব বসন্ত। তাঁর জীবন লতিকার পুরাতন দোষ দুষ্ট পত্র নিচয় ঝরে পড়ল, সুশোভিত হলো
সুন্দর সুবাসিত নতুন পুষ্প পল্লবে তাঁর নব জীবন।
যে সুজাতা ছিল চন্ডা, মুখরা, চঞ্চলা, দুর্বিনীতা, দুর্ভাষিণী, সে সুজাতা আজ
ভদ্র, বিনীতা, শান্ত শীল প্রিয় ও মধুর ভাষিণী হয়ে সকলের প্রাণে দান করল প্রীতি ও
আনন্দ! তথাগত বুদ্ধের প্রভাবে আমূল পরিবর্তন ঘটলো সুজাতার। দেব নরের শাসন কর্তা সর্বজ্ঞ বুদ্ধের এমনি মহিমা
ময় প্রভাব!
সমুদ্ধের প্রধান দায়ক, বৌদ্ধ কুলের গৌরব কেতন অনাথপিন্ডিকের পুত্র বধূ তাঁর কুল মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখল রত্নত্রয়ের উপাসিকা হয়ে, দানে আত্ম নিয়োগ করে শীল সমাধি প্রজ্ঞার অনুশীলন করে। আনন্দ ময়ী আনন্দ দায়িনী সুজাতা, শ্বশুর শাশুড়ীর অনুগতা, সুজাতা, পতি ব্রতা পতি অনুরাগিনী সুজাতা, সুভদ্রা প্রিয়ম্বদা সুজাতা, স্নেহশীল করুণাময়ী সুজাতা সংসারকে মধুময় শান্তি ময় করে তুললো। আনন্দ ভুবন আর আনন্দ মুখর হয়ে উঠল। সুজাতা কাহিনী সমাপ্ত।