ত্রিশরণাপন্না

ত্রিশরণাপন্না

“নাম, গাড়ি থেকে নাম। ” “কেন, ব্যাপার কি? নামবো না আমি। ” নাবি না? আচ্ছা, “আমি তোকে নামাতে পারি কি না দেখ” বলে দণ্ডায় মান একটি যুবক গাড়িতে উপবিষ্টা এক সুন্দরী যুবতীর চুলের গোছা ধরে টান দিয়ে দুম করে ভূমির উপর বসিয়ে দিল।  অপ্রশস্ত সমতল ভূমি।  এর চার পাশে খোলা বিজন অরণ্যানী।  গহন অরণ্যের ঝিঁ ঝিঁ শব্দে প্রাণে শঙ্কার সঞ্চার হয়।  অদূরে বিশাল এক বট তরু।  ভূপৃষ্ঠে উপবিষ্টা কিং কর্তব্য বিমূঢ়া এক আসন্ন প্রসবা নারী সম্মুখে সম্রান্ত অথচ নির্মম হৃদয় এক বলিষ্ঠ যুবক, পেছনে আরোহী শূন্য এক গো শকট, উর্ধ্বে অনন্ত নীলা কাশ, নিম্নে নিশ্চল মেদিনী।


আরো দেখুন: সুপ্রিয়া

আরো দেখুন: পঞ্চগতি


ত্রিশরণাপন্না

ত্রিশরণাপন্না

যুবক যুবতী উভয়ের মধ্যে কিছু কাল কথা কাটা কাটি হলো যুবতী অনেক অনুনয় বিনয় করে জিঘাংসায় উন্মোত্ত যুবককে প্রকৃতিস্থ কর বার চেষ্টা করল, কিন্তু, সুফল হবে বলে মনে হলো না।  যুবতী প্রসব বেদনায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ল এবং অল্প ক্ষণের মধ্যে তার একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো! সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে যুবক শেষ অস্ত্র নিক্ষেপের জন্য বস্ত্রাভ্যন্তর হতে ছোরা বের করতেই যুবতী সদ্য প্রসূত শিশু সন্তানকে যুবকের পদ প্রান্তে রেখে দিয়ে পরিহিত রক্ত রঞ্জিত বসনে নিজেও তার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ল।

 

শ্রাবন্তীর এক পল্লী গ্রাম।  সেখান কার অনেক ধনাট্য পরিবারের মধ্যে অন্যতর এক পরিবার কর্তা, সুমন, পত্নী সুজম্পতিকে নিয়ে সংসার পেতেছেন।  তাঁদের মিলনের কয়েক বৎসরের মধ্যেই ক্রমে ছেলে মেয়ে দুইটি সন্তান তাঁদের সংসার আলো করল।  বড় ছেলে সত্য ব্রত, ছোট মেয়ে সাধনা।  সাধনার জন্মের কিছু কাল পরেই গৃহপতি সুমন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।  স্বামীর মৃত্যুতে সুজম্পতি আঁধার দেখলেন।  তিনি অবশ্য ভেঙ্গে পড়লেন না।  কারণ সত্য ও সাধনাকে তার মানুষ করতে হবে।  স্বামী স্ত্রী দুই জনে মিলে যে বোঝা বহন করতেন, তা এখন এই একলাই তাঁকে বহন করতে হবে।

 

এক যুগ পরের কথা।  সত্য ব্রত ও সাধনা অনেক টা বড় হয়ে কৈশোরে পা দিয়েছে।  কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এ বৎসর হতে সুভাম্পতি দেবী রোগে শয্যা নিয়েছেন।  অবশ্য তিনি বুঝতে পারলেন যে এই শয্যা গ্রহণই তাঁর শেষ শয্যা।  আশা ছিল ছেলে মেয়ে দুই টিকে তিনি অনেক কিছু করে যাবেন, কিন্তু তা করা বোধ হয় আর হয়ে উঠল না।  সব বুঝে তিনি সত্য ব্রত ও সাধনাকে ডেকে তার রোগ শয্যায় বসিয়ে বললেন ‘মণি আমার, সংসার দুঃখ ময় মানব মরণ শীল।  আমি এই যাত্রা হয়তো আর বেঁচে নাও উঠতে পারি, তোদের হয়তো এবার চির তরে ছেড়েই যাবো।  চিন্তা নেই আমার অভাবে শোক দুঃখে তোরা ভাই বোন উভয়ে ভেঙ্গে না পড়ে আমার অসম্পূর্ণ কর্তব্য পালন করে যাবি। তোদের ছন্ন ছাড়া জীবন দেখলে স্বর্গেও আমি শান্তি পাবো না।

 

এই কথা কয়টি বলতে সুজম্পতির আঁখি অশ্রু পূর্ণ হয়ে এল।  তিনি আপনার ক্ষীণ দুর্বল হাতে চোখ মুছে ফেলেন এবং মেয়ে সাধনার হাত সত্য ব্রতের হাতের উপর রেখে বললেন “সত্য আমার, এই সংসারে মাত্র তোরা দু’টি ভাই বোন।  তোর এই ছোট বোন সাধনাকে তোরই হাতে রেখে যাচ্ছি।  সাধনা যে কতো সরল, তা তুইও জানি।  তোর এই সরলা বোনকে তুই দেখিস স্নেহ করিস, এর প্রতি যত্ন নিস।  এর সংসারে প্রবেশের পথ তোকেই করে দিতে হবে। ”

 

এই কথা কয়টি বলতেই রোগি ণীর অবশ হাত শিথিল হল।  তার রোগ পান্ডুর মুখে একটু হাসি খেলে তিনি চক্ষু মুদিত করলেন চিরতরে।  মৃতের মুখে কিন্তু প্রসন্ন তার ছাপ রয়ে গেল।  সত্য ও সাধনা নিরাশ্রয় হলো তাদের শেষ সম্বল মাতাকে হারিয়ে তারা ভাই বোন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ল।  পাঁচ ছ’মাস পরের কথা।  এখনো পর্যন্ত মায়ের কথা স্মরণ করে সাধনা সময় সময় কাঁদতে থাকে।  ছোট বোনের অশ্রু সত্য ব্রতকে আকুল করে তোলে।  কারণ সাধনা দাদাকে কত খানি ভক্তি করে, ভলো বাসে মম তার চোখে দেখে মায়ের মৃত্যুর পর সে তার প্রমাণ পেয়েছে। দাদার সুখের জন্য, মঙ্গলের জন্য সাধনা না করতে পারে, জগতে এমন অসম্ভব কিছু নেই।

 

এক দিন নিরালায় বসে কাদছে সাধনা।  সত্য ব্রত দেখে তাকে আদর করে বলল “এতো কাদিস কেন বোন? তোর অশ্রু যে আমায় কত খানি ব্যথা দেয়, তা তুই বুঝবি না! মার অন্তিম কথা কি তুই ভুলে গেছিস? মা যা বলে গেছেন  ‘সংসার দুঃখ ময়, মানব মরণ শীল।  মার এ শেষ কথাটি জীবনে ভুলিস না বোন, এতেই পাবি হৃদয়ে বল, মনে সাহস।” সুখ দুঃখের মধ্য দিয়ে ভাই বোন দু’জনেরই দিন কেটে যায়।  সত্য ব্রত তার সরল মতি বোনকে সংসারের কাজে ও কথায় ভুলিয়ে রাখতে চায়।  অবশ্য তার এ চেষ্টা অনেকাংশে সফলও হয়েছে।  সে নিজে কিন্তু ভুলে থাকতে পারে না বোনের বিবাহের কথা।  সাধনার সংসার প্রবেশের পথ তাকেই যে করে দিতে হবে।  অবশ্য সত্য ব্রত নিজেও বিবাহের উপ যুক্ত হয়েছে; তবুও সে নিজের জন্য বিন্দু মাত্রও ভাবে না।  সে কেবল বোনকে পাত্রস্থ করতে পারলেই বেঁচে যায়।  এই হেতু সে সাধনার অজ্ঞাত সারেই তার উপযুক্ত বরের অনুসন্ধানেই আছে।

 

এই বিষয় কিন্তু সাধনার অবিদিত রইল না।  সে এক দিন সত্য ব্রতকে জিজ্ঞাসা করল “দাদা, আমি কি তোমার খুবই বোঝা হয়েছি?” সত্য ব্রত সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল “কেন বোন, আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? আমার কোন লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে যে আমি তোমায় বোঝা মনে করছি?” “নয় তো কি তোমার সব কিছুতেই ব্যস্ততা নতুবা আমায় তাড়িয়ে তোমার কাছ ছাড়া করবার এতো প্রচেষ্টা কেন?” সত্য ব্রত বুঝতে পেরে বল্ল “ও তাই এতো তাড়ন নয় বোন এই যে মায়ের অন্তিম আদেশ রক্ষা করা, এই যে তোর সুরক্ষার ব্যবস্থা করা বোন।” “সম্প্রতি এ সুরক্ষার কাজ নেই, যেমন আছি বেশ আছি।  তোমায় একলাটি দুঃখে ফেলে, আমি কোথাও যেয়ে থাকতে পারবো না। ” “তা কি হয় বোন? সংসারী মানুষ, সংসারকে বুঝ বার চেষ্টা কর।  মার অন্তিম বাক্য তো আমি রক্ষা না করে পারি না, তা কি তুই জানিস না?”

 

“হ্যা, আমি জানি, কিন্তু সে পরে হবে।  এর আগে তুমি বিয়ে করে একটি সুন্দর বৌ ঘরে না আনলে, আমি কোথাও যাবো না। ” বলে সে তার কাজে চলে গেল।  সত্য ব্রতের ইচ্ছা ছিল সম্প্রতি সে বিবাহ করবে না।  কারণ, সে বিবাহ না করে আরও কয়েক বৎসর কাটিয়ে নিতে পারে।  কিন্তু, তার বোন সাধনাকে তা আর বিবাহ না দিয়ে রাখা যায় না। যৌবন লালিত্য তার সর্বাঙ্গে ফুটে উঠেছে  তার মুখ মণ্ডলে, তার চক্ষে, তার হস্ত পদে, তার কুঞ্চিত কেশ রাশিতে, তার চলায়, তার সব কিছুতেই।  কিন্তু, সাধনা তো সেদিন স্পষ্টই বলে দিলো যে  সত্য ব্রত ঘরে বৌ না আনলে, সে স্বামী গ্রহণ করবে না।  হ্যা, সাধনাকে তো সে জানে, সে অবশ্য খুবই সরলা, কিন্তু সে যা এক বার ধরে বসবে, তা না করে আর ছাড়বে না, তাই সত্য ব্রত অগত্যা সিদ্ধান্ত করল যে সেই প্রথম বিবাহ করবে।  নতুবা সাধনাকে মানান যাবে না।

 

বিবাহের জন্য সত্য ব্রতকে কোনও বেগ পেতে হলো না এবং সময়ের জন্য প্রতীক্ষা করতে হলো না।  কারণ, মাতা পিতার অবর্তমানেও সে যথেষ্ট অর্থের অধিকারী।  কিছু দিনের মধ্যেই সে একটা বৌকে বরণ করে ঘরে আনল এবং বোন সাধনাকেও এক সুপাত্রে সম্প্রদান করে নিশ্চিন্ত হলো।  সত্য ব্রত যাকে নব বধূ রূপে বরণ করে ঘরে নিয়ে এসেছে, সে কেমন।  হবে, তা বলা যায় না; কিন্তু, সাধনাকে যে সে সৎপাত্রে অর্পণ করতে পেরেছে, স্বর্গীয় মার যে আদেশ রক্ষা করতে পেরেছে এতে তার তৃপ্তির সীমা নেই।  এতদিনে তার ‘সত ব্রত’ নাম সার্থকতায় ভরে উঠল।  সাধনার স্বামী অনু পম বেশ সুদর্শন যুবক।  অনুপম বাস্তবিক অনু পমই বটে; রূপে গুণে, জ্ঞানে ধর্মে, ভক্তি ভাল বাসায় সব কিছুতেই সে অনু পম।  সাধনার উপযুক্ত স্বামীই হয়েছে। স্বামী স্ত্রী উভয়ে একে অপরকে মনের মত করেই পেয়েছে।

 

দুই বৎসর পরের কথা।  এর মধ্যে সত্য ব্রত পিতৃত্বের গৌরব অনুভব করতে পারেনি।  কিন্তু, সাধনা মাতত্বের গৌরব অনুভব না করলেও আসন্ন।  এক অনাগত সুখ স্বপ্নে সাধনার মুখ মণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।সন্তানের প্রতি মাতার যে অপরিমেয় স্নেহ মমতা করুণা, সাধনার অন্তরেও তা সঞ্চিত হয়ে উঠেছে ক্রমশঃ।  সাধনা তার আবির্ভাব কাল থেকেই পিতৃ গৃহে দাদা ও বৌদির কাছে গিয়ে এ সঙ্কট ত্রাণের আশা করেই আছে।  মাতা পিতা বেঁচে না থাকলেও, দাদার আন্তরিক স্নেহ হতে সে বঞ্চিত হবে না, এ বিশ্বাস তার আছে।  আর বৌদি সে তো দাদারই অনুগামীনী।  দাদার সহ ধর্মিণী হিসাবে সেও স্নেহ মমতা না করে পারবে না।  শত হলেও সে নারী, সে তার ভ্রাতৃ বধু, সে তার বৌদিদি।  বিশেষতঃ সাধনা তাদের দেখেছে  সে অনেক দিন।

 

এক সময় সাধনা স্বামীকে বলল “চল না, এক বার গিয়ে দাদা ও বৌদিকে দেখে আসি।  অনেক দিন তাদের দেখিনি, আমার প্রাণ কেমন করে। ” অনু পম বল্ল  “চল না, মন্দ কি।  আমার কোন আপত্তি নেই, থাকাও উচিত নয়। ” “যদি যাও, আজই চল।” “আমি তো আগেই বলেছি যে আমার আপত্তি নেই।” “যথা শীঘ্র প্রস্তুত হয়ে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সাধনা পিত্রালয়ে যাত্রা করল।  পথি মধ্যে দেখতে পেলো ভগবান গৌতম বুদ্ধ সশিষ্য ভিক্ষায়।  বের হয়ে ছেন।  অনু পম ও সাধনার অন্তরে বুদ্ধ ধর্ম সংঘ এ রত্নত্রয়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা।  উভয়ে বুদ্ধের নিকট বর্তী হয়ে ভক্তি সহকারে বন্দনা করল।  ভগবান তাদের ভাবী অবস্থা জ্ঞাত হয়ে উভয়কে ত্রিশরণ সহ পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠা পিত করে নিম্নোক্ত উপদেশ প্রদান করলেন।


১।  “তোমাদের বিপদ কালে সম্যক সমুদ্ধের শরণ নিও।


২।  রাজ্য ভয়, দস্যু ভয় ও যক্ষ প্রেতাদির উপদ্রব থেকে যদি রক্ষা পেতে চাও, তবে ভগবান তথাগতের শরণ নিও।


৩।  সিংহ ব্যঘ্রাদি হিংস্র জন্তুর ভয় থেকে যদি রক্ষা পেতে চাও, তবে সমুদ্ধের শরণ নিও।


৪।  রৌদ্র, বায়ু, অগ্নি ও জল ভয় এবং ঋতুজ রোগাদি হতে মুক্তি লাভের ইচ্ছা করলে, সুগতের শরণ নিও।


৫।  মৃত্যুর সঙ্গে যখন যুদ্ধ করবে, তখন মৃত্যুঞ্জয় ভগবান বুদ্ধের শরণ নিও, শরণ নিও ধর্ম ও সংঘের। ”

 

শাস্তার ধর্মো পদেশ স্বামী স্ত্রী উভয়েই একা গ্রমনে শুনল।  ভগবান চলে গেলে তারা আবার সত্য ব্রতদের বাড়ীর পথ ধরল।  তারা অভীষ্ট স্থানে পৌছতেই সত্য ব্রত ও তার স্ত্রী উভয়েই বের হয়ে তাদের গলা গলি করে আগু বাড়িতে নিল।  আজ বহু দিনের পর দেখা, তাই এ চার জন নর নারীর মধ্যে বহু সুখ দুঃখের আলাপ হলো।  স্ত্রীকে রেখে অনু পম পরদিন স্বগৃহে ফিরে এলো সত্য ব্রত তার স্নেহের বোন সাধনার অন্তঃসত্ত্বাবস্থা জেনে, তার সেবা যত্নের উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিল।  তার স্ত্রীকেও বলে রাখল “সাধনাকে যেন কোন প্রকার অসুবিধা ভোগ করতে না হয়।” বৌদি ননদিনীর সকল প্রকার সেবা পরিচর্যার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে।  স্নান ও খাওয় পরা প্রত্যেক বিষয়ে বৌদির দৃষ্টি না পড়লে, তা যেন সুচারু রূপে সম্পাদিত হয় না।  বহু দিন পর তারা পরস্পরকে নিবিড় ভাবে পেয়ে মনের মত মিলনের সুযোগ পেল এবং এ মিলনের ফলে তাদের মধ্যে সখীত্বের সৃষ্টি হলো।

 

দিনের পর রাত, রাতের পর দিন চলে যায়।  কিন্তু এই সখ্যতার মধ্যেও সাধনার প্রতি বৌদির কেমন যেন একটা মানসিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়।  এর এক মাত্র কারণ  ননদিনীর অভিনব ধরণের গড়া বহু মূল্য স্বর্ণালঙ্কার।  সাধনার এ বিচিত্র স্বর্ণালঙ্কার বৌদির সুখ পথের কন্টক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার নারী জীবনকে নিষ্ফলতায় পর্যবসিত করতে বসেছে।  আজীবন তার কোন সন্তান না হোক, আজীবন সে মাতৃত্বের গৌরব থেকে বঞ্চিত থাকুক ক্ষতি নেই, কিন্তু সাধনার মনোরম অলঙ্কার থেকে সে বঞ্চিত থাকবে এটা তার জীবনে সহ্য হবে না।  স্ত্রীলোকেরা সাধারণতঃ নিত্য নতুন অলঙ্কার পর তেই অধিক ভালো বাসে। ভোগৈশ্বর্যে ডুবে থাকলেও অলঙ্কার যদি এক পদ কম হয়, অথবা বৈচিত্র হীন হয়, তা হলে তাদের জীবন যেন বৃথা গেল।  অলঙ্কারের প্রাচুর্যে তাদের তৃপ্তি মিটে না; যত পায় তত চায়।  এমন কি, মনের মত করে অলঙ্কার পরতে পেলে, কোন কোন নারী পুত্রশোকও যে ভুলতে পারে এরূপ দৃষ্টান্তও দেখা যায়।

 

ভ্রাতৃ বধূর অলঙ্কারের অভাব না থাকলেও, সাধনার হাতে দেখা নতুন ধরণের অলঙ্কার প্রাপ্তির বল বতী ইচ্ছা তাকে পেয়ে বল।  তার সে অতৃপ্ত বাসনা এমন প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেল যে, তার পক্ষে তা অসহ নীয় হয়ে উঠল।  কিছু দিন থেকে এ দুরাকাখার বিষময় জ্বালার মধ্য দিয়েই তার দিন অতীত হতে লাগল।  তার পূর্বের সে শান্তি নেই, সে স্বাচ্ছন্দ্য নেই, সে উৎসাহ নেই আছে কেবল সুরহারা, ছন্দ হীন, ভাব শূন্য ব্যথা ভারাক্রান্ত দুঃসহ জীবন।  স্বামী সত্য ব্রতের অর্থের তেমন অভাব নেই। স্ত্রী ইচ্ছা করলে, স্বামীকে বলে সেই ধরণের অলঙ্কার অনায়াসে গড়িয়ে নিতে পারতো।  কিন্তু সে তা চায় না চায় সাধনারই অলঙ্কার।

 

আজ তার মোটেই ভাল লাগছে না।  সত্য ব্রত প্রতি দিনের মতো আজ প্রাতেও কর্ম স্থলে চলে গেছে।  দুপুরে অবশ্য খেতে আসবে।  তার বের হয়ে যাবার পর থেকেই স্ত্রী শুয়ে পড়েছে।  সাধনা পূর্ব হতেই লক্ষ্য করে আসছে বৌদির বিমর্ষভাব।  আজ কিন্তু তাকে শয্যা নিতে দেখে এর কারণ জানতে চেয়ে ছিল সে।  নরম গরম প্রত্যুত্তর পেয়ে ব্যথিত চিত্তে সে ফিরে এলো।  দুপুরে সত্য ব্রত খেতে এলো।  স্ত্রীর দেখা না পেয়ে সাধনাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল, সে কি জানি কেন শুয়ে আছে। সত্য ব্রত খেয়ে উঠে শোবার ঘরে গিয়ে দেখে স্ত্রী সত্যই শুয়ে আছে। স্ত্রীর গায়ে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল “ঘুমিয়েছ কি?” স্ত্রী কোনো উত্তর না করে কেবল পাশ ফিরেই শুলো।  সে আবার জিজ্ঞাসা করল  “অসময়ে শুয়ে আছ কেন, কোনো অসুখ করে নি তো?”

 

উত্তর হলো “না। ” “তবে শুয়ে আছ কেন?” “কেন, এ প্রশ্ন এত দিনে বুঝি? মাগো, পুরুষ মানুষ নারীর উপর এত খানি অবিচার করতে পারে!” “কি, হয়েছে কি? খুলে বলো না কেন? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।” বুঝতে হবে না, না বোঝাই ভালো, খুলে বলায় কাজ নেই।” “তবে তুমি আমায় অবিশ্বাস কর? আমার ভালো বাসার কোনও মূল্য?” “তোমার ভালো বাসার প্রমাণ তো খুবই পাচ্ছি।” “বলো দেখি, তোমার কি করলে ভালো বাসার প্রমাণ দেওয়া যায়?” “বলে কাজ নেই, সে তুমি পারবে না।” “পারবো না? নিশ্চয়ই পারবো, প্রাণ পণ চেষ্টা করবো।” “সত্যি?” “সত্যি।” “তবে প্রতিজ্ঞা করো কাউকে বলবে না। ” “প্রতিজ্ঞা! হ্যা, প্রতিজ্ঞা কর লাম, কাউকেও বলবো না। ”

 

এ নরপি শাচিনী নারী কিন্তু সাধনার অলঙ্কার আত্ম সাতের লালসা সম্প্রতি গোপন রাখল।  এ অলঙ্কার সে পেতে চায় স্থায়ী ভাবে।  তা করতে হলে, সাধনাকে এ পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হবে।  এ দুর্বুদ্ধি এঁটে সে বলল আমি সাধনার হৃৎপিণ্ড চাই।  হয় বাসনা পূর্ণ করো, না হয় আমার মৃত্যু পথ প্রশস্ত করো। ” সত্য ব্রত স্ত্রীর মুখে এমন নিষ্ঠুর লোমহর্ষকর কথা শুনে শিউরে উঠল, বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো চক্ষু, ললাট কুঞ্চিত হলো, চোখে অন্ধকার দেখলে।  স্বামীর অবস্থা দেখে পত্নী বলল “এই তো, আমি কি বলি নি সে তোমার দ্বারা হবে না? সত্য ব্রত একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বল্ল “হ্যা, ঠিকই বলেছো, হবে না।  ভাই হয়ে ছোট বোনকে হত্যা করা! অসম্ভব, তা হবে না।  জানতে পারি, তোমার এমন নির্মম দুর্বাসনার কারণ কি?”

 

“দুর্বাসনার কারণ? ‘দুর্বাসনা’ আমি বুঝি না, আমি বুঝি শুধু কারণ। কিন্তু, সে কারণ পরে হবে। আগে বলো, সাধনাকে হত্যা করে তার সদ্য হৃৎপিণ্ড দিয়ে আমায় বাঁচাতে চাও কি না?” সত্য ব্রত আবার শিউরে উঠল।  স্ত্রীর রাক্ষসী মূর্তির দিকে চেয়ে সে।  প্রমাদ গুণল; তার মুখ হয়ে গেল ফ্যাকাসে।  বল্ল গাঢ় স্বরে “বাচাতে? হ্যা, তোমায় বাঁচাতে চাই, কিন্তু আমার এক মাত্র স্নেহের বোন সাধনার হৃৎপিণ্ড দিয়ে নয় আর যা দিয়ে পারি তোমায় বাঁচাতে চেষ্টা করবো, প্রাণ পণ চেষ্টা করবো। তোমার কি হয়েছে বলো।  একটু স্থির হও, চিন্তা করে দেখো তুমি কি বলছো মনে হয়, তুমি বিভ্রান্ত হয়েছে। ” “বিভ্রান্ত! কে বিভ্রান্ত, আমি? না, আমি ঠিকই আছি।  বলো, তোমার প্রতি শ্রুতি তুমি রক্ষা করবে কি না?”

 

“না, আমার প্রতি শ্রুতি এর জন্য নয়।  সে প্রতি শ্রুতি এমন নিদারুণ নয়।  সে যে আমার এক মাত্র স্নেহ ময়ী বোন, সে যে তোমার প্রিয় সখীন নদিনী সে যে পরের স্ত্রী, সে যে অন্তঃসত্ত্ব, সে যে আমার মরণ পথ যাত্রী মায়ের দান।  না, না, তোমার এ দারুণ পাপ বাসনা আমি পূর্ণ। করতে পারবো না, ভাই হয়ে বোনের হন্তারক সাজতে পারবো না।” এসব কথা বলতে বলতে সত্য ব্রতের চোখ অশ্রুসিক্ত হলো।  স্ত্রী ভ্রকুঞ্চিত করে তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে বলল “পারবে না? তবে কি তুমি আমার মৃত্যুই কামনা কর?” “আমি কারো মৃত্যু কামনা করি না।  তুমি স্বেচ্ছায় যদি মৃত্যুকে ডেকে আনো, আমি কি করবো?”

 

স্বামীর একথায় স্ত্রী রুখে উঠে বলল “নিষ্ঠুর পাষাণ, এ বুঝি আমার প্রতি তোমার ভালো বাসা? এ ছাই ভালো বাসা আমি চাই না।  যাও, এখান থেকে চলে যাও।  আমার পথ আমি দেখবো তবে মনে রেখো আমার এ মৃত্যুর জন্য এক মাত্র দায়ী তুমিই।” এ বলে সে পাশ ফিরে শুলো।  স্ত্রীর এ জঘন্য ব্যবহারে সত্য ব্রত সত্যই ব্যথিত হলো! সে কিছু ক্ষণ পাপাভি মানিনী পত্নীর দিকে চেয়ে থেকে চকিতে বেরিয়ে চলে গেল।  রাত্রে আহারের সময় সে বাড়ী ফিরল।  বোন সাধনা তাকে ভাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করল “বৌদির আজ কি হয়েছে দাদা? কয় দিন থেকে তাকে বিমনা দেখাচ্ছে, আজ কিন্তু সকাল থেকেই একে বারে শয্যা নিয়েছে।  আমি তাকে অনেক অনু নয় করলেও কিছু হলো না।  তাকে আজ তুল তেও পার লাম না, খাওয়া তেও পার লাম না।  দাদা, বৌদি তোমায় কিছু বলল না?”

 

সত্য ব্রত জানে সাধনা চির কালই সরলা।  সে এর কিছুই জানে না এবং বুঝে না।  সত্য গোপন করে সে বলল “কি জানি সে যে কিছুই।  বলে না।  কয়েক গ্রাস ভাত তাড়া তাড়ি খেয়েই তাকে উঠতে দেখে সাধনা বলল “কি দাদা, খাবার সব রেখে এতো তাড়া তাড়ি উঠে পড়লে যে?” “আজ তেমন ক্ষুধা নেই।” বলে সে বেরিয়ে গেল।  পত্নী প্রিয় ধরণের লোক সত্য ব্রত।  যে কোনো প্রকারে হোক স্ত্রীর সন্তোষ বিধানের মাধ্যমেই তার কর্তব্যের মর্যাদাকে সে অক্ষুন্ন রাখতে চায়।  কিন্তু, এমন বিপদে সত্য ব্রত আর কোন দিন পড়েনি।  তার ব্যথা ভারাক্রান্ত মন আসন্ন বিপদের শঙ্কা দোলায় দোলায় মান।  এক দিকে প্রিয় পত্নীর জীবনাশঙ্কা অন্য দিকে আদরের স্নেহ শীলা বোনের হত্যাশঙ্কা।  এ দুই আশঙ্কায় সে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়ল।

 

আবার সত্য ব্রত ভাবে “না, সাধনার জন্য আমার শান্তি প্রস্রবণ পত্নীকে আত্ম হত্যা করতে দিয়ে আমি শান্তি হারা হতে পারবো না।  সেই যে আমার শান্তি, সেই যে সুখ, সেই যে আমার আনন্দ।  দুর্বহ হয়ে উঠবে আমার শান্তি হারা জীবন।  আর সাধনা সে তো অমর নয়, তার জন্য আমার প্রেম মন্দা কিনী।  কেন শুকিয়ে যাবে? সাধনা মরবে।  আজ না মরে দুই দিন পরে মরবে।  তবে কেন তার জন্য আমার সুখ শান্তিকে চির নির্বাসন দেবো? সাধনা।  রোগে না মরে ছোরার বিষে মরবে, অন্যের হাতে হত না হয়ে ভাইয়ের হাতেই হত হবে, এই তো বিশেষত্ব? এতো ভাবলে আর চলে না। ”


দুপুর রাত্রি।  চার দিক ঝিম ঝিম করছে।  সত্য ব্রত আস্তে আস্তে পত্নীর ঘরে গেল।  দেখল সে ঘুমায় নি। পত্নীরত্বটি বসল সহ ধর্মিণীর পাশের গায়ে একখানা হাত রেখে বল মৃদু স্বরে “প্রিয়ে, তোমার বাসনাই পূর্ণ করবো।  তুমি নিশ্চিন্ত হও। সিদ্ধান্ত করেছি সাধনার জন্য তোমায় হারাতে পারবো না।  তুমি আমার অমিয় নিরিণী। ” স্ত্রীর মুখ মণ্ডল কপট গাম্ভীর্য পূর্ণ।  বল ভ্রকুঞ্চিত করে “হয়েছে, রাত দুপুরে আর ন্যাকামি করতে হবে না।  মিথ্যা প্রবোধে আমায় ভুলাতে পারবে না।  এসেছো স্তুতি বাক্যে আমার মন যোগাতে!” ‘মিথ্যা প্রবোধ নয়, একান্ত সত্য।  এর প্রমাণ পাবে কাল, দেখবে তার সদ্য হৃৎপিণ্ড এনে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি।” সত্য ব্রত স্ত্রীর কি রূপ বশী ভূত, কেমন আসক্তি পরায়ণ, স্ত্রী তা ভাল রূপে অবগত আছে।  সে জানে স্ত্রী হিসাবে স্বামী তাকে কোনো দিনই বিমুখ করতে পারবে না।  এ কথা মনে পড়তেই সে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। 

 

পত্নী অনুরক্ত স্বামী পত্নীর জন্য করতে পারে না, জগতে এমন কাজ খুবই বিরল।  যে স্বামী স্ত্রীর বশী ভূত, তার দ্বারা স্ত্রী ষোল আনার উপর আঠার আনা অমঙ্গলের পথ প্রশস্ত করে নেয় সোনার সংসার, মিলন মন্দির অন্তর্দ্বন্দ্বের তীব্র আগুনে ভস্মী ভূত হয়ে যায়।  সে কী ভয়ঙ্করী স্ত্রী বুদ্ধি, কী মোহিনী শক্তি যার কলঙ্ক মলিন প্ররোচনায প্ররোচিত হয়ে পুরুষ পথ ভ্রষ্ট হয়, বিষময় করে তোলে মধুময় জীবনকে।  অদৃষ্টের একি পরিহাস! একটি মাত্র নারীর মন্ত্র শক্তি তেই ভ্রাতায় ভ্রাতায় বিরোধ, পিতা পুত্রে বিচ্ছেদ, পরস্পর পরস্পরে কলহ বিবাদ, তিক্ত স্বার্থ পরতা, এমন কি হত্যা ষড়যন্ত্র ও হয় সংঘটিত।  এ কারণে বিজ্ঞজন বলে থাকেন

 

১।  যে ব্যক্তি স্ত্রীর বশী ভূত হয়, সে তার ইহ পরকাল নষ্ট করে, মহান উদ্দেশ্য তার ব্যর্থ হয়ে যায়।


২।  যে ব্যক্তি স্ত্রীর বশী ভূত হয়, মাতা পিতা ও ভ্রাতা ভগ্নীর প্রতি তার গৌরব সম্মান লুপ্ত হয়ে যায়, তাদের প্রতি অন্যায় অত্যাচার, এমন কি তাদের হত্যা করতেও সে কুষ্ঠিত হয় না।


৩।  যে ব্যক্তি স্ত্রীর বশী ভূত হয়, কাম তৃষ্ণা হেতু তার কর্তব্যা কর্তব্য জ্ঞান লুপ্ত হয়ে থাকে।


৪।  যে ব্যক্তি স্ত্রীর বশী ভূত হয়, প্রাণী হত্যাদি এমন কোনো অকরণীয় দুষ্কর্ম নেই, তার দ্বারা যা সম্পাদিত হতে পারে না।


৫। যে ব্যক্তি স্ত্রীর বশী ভূত হয়, চুরি, মিথ্যা ভাষণ, মদ্য পান ও পিশুনাদি সমস্ত দুঃসাহসিক কাজই তার দ্বারা সম্পাদিত হতে পারে।

 

সম্পূর্ণ ভোর না হতেই প্রভাতী পাখীর কাক লীতে সাধনার ন্দ্রিা ভেঙ্গে গেল তখনও পৃথিবীর বুক অন্ধকারে ছেয়ে আছে।  এতো সকালে সাধনা শয্যা ছেড়ে না উঠে বিছানায় পড়েই রইল।  কিন্তু, এ সময় কত শত কথা মনে উদিত হয়ে আকুল করে তুলল তাকে।  সে ভাবে “তার সন্তান আবির্ভাবের দশ মাস পূর্ণ হতে চলল।  সন্তান আজ আসে কি কাল আসে তার সঠিক কিছু বলা যায় না।  কিন্তু, মাতৃত্বের গৌরবে তার নারী হৃদয় যে এবার ভরে উঠবে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।  স্বামী কখন সন্তানকে দেখতে পাবে, তার সাধনার নবাগত অতিথির কি নাম রাখবে, তার দেওয়া নাম সন্তানের পিতার পছন্দ হবে কি না এসব বিষয়ে চিন্তা করতে সে উঠে পড়ল।

 

সবে মাত্র প্রভাত হয়েছে।  সত্য ব্রতের স্ত্রী কিছুদিন যাবৎ মানসিক অস্বস্তির দরুণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপন করণীয় কাজ সম্পাদন করলেও, কিন্তু গত কাল থেকে সে যে গোঁ ধরে দিন রাত শুয়ে আছে, এতে আসন্ন প্রস্রবা ননদিনীর সেবা যত্নের কথা দূরে থাক, উপরন্তু ননদিনীকে সম্পাদন করতে হচ্ছে যা না করলে নয়, এমন সাধ্যায়ত্ত দুই একটা কাজ।  সকালেই দাদার প্রাতরাশের বন্দোবস্ত করে দিল।  সত্য ব্রত তার খাওয় শেষ হতেই সাধনাকে ডাকল।  সে এসে জিজ্ঞাসা করল “কি দাদা, আমায় ডেকেছো?” “হ্যা, বলি শো মা যে সেবার কয়েক জন লোককে সরল বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে অতগুলি টাকা হাওলাত দিলেন, তা কি তোর মনে পড়ে?” সাধনা আশ্চর্য ও চিন্তিত হয়ে বলল “না দাদা, কই মার এমন টাকা ধার দেওয়ার কথা তো আমার মনে পড়ছে না। ” অগ্রজের কপটতায় ভ্রাতৃপ্রেম মুগ্ধ সাধনার পক্ষে সন্দেহ করবার মতো কিছুই থাকতে পারে না।  কারণ, সরলা সাধনা শিশু কাল থেকে সরল তারই যেন সাধনা করে আসছে।

 

সত্য ব্রত বলল “হ্যা, তোর মনে না পড়ারই কথা।  কারণ, তখন তুই খুবই ছোট ছিলি কি না। আমি কিন্তু, শত চেষ্টা করেও এযাবৎ তা আদায় করতে পারছি না।  টাকা গুলি মাটি হতে বসেছে।  চল আজ আমরা ভাই বোন দুই জনেই গিয়ে দেখি।  হয়তঃ আমাদের দেখলে পাওনা টাকা তারা চুকিয়ে দেবে।” সরল সাধনা এর কিছুই বুঝতে পারল না।  সে কেবল নিজের পূর্ণ গর্ভাবস্থার কথা ভেবে বলল  “আমরা এ অবস্থায় আমি কি করে যাই।  দাদা? “গো শকটে যাওয় যাবে।  তাতে তোর কোনো অসুবিধা হবে না।  অল্প ক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবো। ”

 

বলা বাহুল্য, গতকল্য রাত্রেই সত্য ব্রত গো শকটের জন্যে বলে।  রেখে ছিল।  দাদার আদেশ সাধনা জীবনে কখনও লংঘন করতে পারেনি।আজও পারলনা সুতরাং তারা ভ্রাতা ভগ্নী উভয়ে গো যানে যাত্রা করল। শকট রাস্তা বেয়ে অগ্রসর হলো।  ক্রমে শ্রাবস্তীর পল্লী প্রান্তর অতিক্রম করে অরণ্যের পথ ধরল।  সাধনা তখন পর্যন্তও বুঝতে পারল যে সত্য ব্রতের মনে কোনো প্রকার অসত্যের ছাপ থাকতে পারে।  গাড়ী তাদের নিয়ে জন শূন্য বনে প্রবেশ করতে দেখে সাধনা জিজ্ঞাসা করল “এ যে গহন অরণ্য দাদা, আমরা এ পথে কোথায় যাবো?”

 

সত্য অবিচলিত কন্ঠে বলল “কোথা যাবো? আমি যাবো জীবনের পথে, আর তুই যাবি মরণের পথে।” সাধনা আশ্চর্য হয়ে বলল “একি বলছো দাদা? এখানে আসবে কেন জীবন মরণের কথা? আমি যে এর কিছুই বুঝতে পারছি না! আমরা কি মার লগ্নীকৃত অর্থ আদায় করতে যাবো না?” “ঋণের অর্থ আদায়! মিথ্যা কথা, সত্য হলেও অর্থ সামান্য বিষয়, কিন্তু তার চেয়েও যা অসামান্য, আমি সেই অশান্তির শোধ নিতে চাই তোকে হত্যা করে। ”

 

সরলা সাধনা শিউরে উঠে বলল “হত্যা! আমায় হত্যা করবে?” তোমার পায়ে আমি কোন অপরাধে অপরাধিনী যে, আমায় হত্যা করবে দাদা?” “রেখে দে তোর দাদা সম্বোধন, এখন আমি তোর দাদা নই।  বোনের জন্য যে স্নেহের উৎস বিরাজ করে দাদার বক্ষে, আমার এ তপ্ত। বক্ষে তা নেই, হিংসার তীব্র দাহনে নিঃশেষে শুকিয়ে গেছে আমার সে স্নেহের উৎস।  কিছু ক্ষণ এরূপ কথা কাটা কাটি চলল।  গো শকট আরো কিছু দূর সম্মুখে অগ্রসর হলো।  “বলল “এসব যে কি বলছো দাদা, তার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।  আমি তো কোনো অপরাধ করিনি দাদা! আর যদি নির্বিচারে অপরাধিনী বলে আমায সাব্যস্ত করে থাকো, তবে আমায় হত্যা করো ক্ষতি নেই; কিন্তু আসন্ন জন্ম নিরা পরাধ আমার গর্ভস্থ যে সন্তান তার দোষ কি? সে তো অপরাধী নয়, আমার অপরাধে সে কেন মৃত্যু দন্ড ভোগ করবে?”

 

সাধনার ক্রন্দন ও এমন কাতর আবেদনও নিষ্ঠুরের কোনো ভাবান্তর দেখা গেলনা।  সে যেন পাষাণে বুকে বেঁধেছে।  অসহায় নারীর কাতরোক্তির দিকে তার বিন্দু মাত্রও ভ্রুক্ষেপ নেই, তার যে জঘন্য উদ্দেশ্য এখনো সিদ্ধ হয় নি।  মঙ্গলের জন্য হোক বা অমঙ্গলের জন্য হোক উত্তাল তরঙ্গায়িত অকূল সাগরে ভাসমান অসহায় সাধনা জিঘাংসু পাষন্ডের হাত থেকে নিস্তার না পেতেই তার প্রসব বেদনার সঞ্চার হলো।  দুঃখ আর কত সহ্যকরাযায়! প্রসবের পূর্বে সতর্বতের হাতে সে নিহত হলে, অন্ততঃ প্রসব যন্ত্রণা হতে সে বেঁচে যেতো।  কিন্তু, তা হয় না, তার ব্যাথার বোঝা তাকেই বয়ে যেতে হবে।

 

সাধনা প্রসব বেদনায় অস্থির হয়ে সত্য ব্রতকে বলল দাদা, বলতে লজ্জা হয়, কিন্তু না বলেও উপায় নেই আমার সন্তান প্রসবের সময় এসেছে, প্রসব বেদনায় আমি অস্থির হয়ে পড়েছি।  একান্তই হত্যা করলে, প্রসব কাল পর্যন্ত আমায় সময় দাও, নারী হয়ে যুগপৎ দ্বিবিধ যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারবো না।  এসব কথা নিষ্ঠুরের কানে গেল না।  সেদিকে তার লক্ষ্য নেই, সে চায় তার দুর্দান্ত বাসনা চরিতার্থ করতে।  ন্যায়ের কাছে সত্যব্রত অস্থির হয়ে উঠলেও এতো দুর্দৈবের মধ্যেও সাধনা ছিল স্থির; সেই অসীম স্থৈৰ্য্যের মধ্যে সাধনা প্রসব করল এক সুন্দর পুত্র সন্তান।

 

সদ্য প্রসূত শিশু সন্তানকে দেখিয়ে নির্দয় ভ্রাতাকে প্রকৃতিস্থ করবার আশায় সাধনা বলল “দাদা, তোমার এ নিরপরাধ ভাগিনার মুখ চেয়েও কি আমায় ক্ষমা করতে পারো না? এ অবোধ শিশুর মুখও কি তোমার প্রাণে দয়ার সঞ্চার করতে পারে না? আমি অভাগিনী মা ব্যতীত এ অসহায় শিশুকে রক্ষা করে মানুষ করবার যে আর কেউ নেই; আমার অভাবে এ সুমকলি যে কোরকেই শুকিয়ে অকালে ঝরে পড়বে।  তোমার ছোট বোনের শেষ অনুরোধ রক্ষা করো দাদা! আমার প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে সুযোগ দাও একে বাঁচিয়ে তুলবার। ”

 

কিছুতেই কিছু হলো না।  রক্তোল্লাসী সত্য ব্রতকে সাধনা কিছুতেই প্রকৃতিস্থ করতে পারল না।  এ পাষন্ড অধৈর্য হয়ে উঠল।  তার শেষ অস্ত্র নিক্ষেপের জন্য বস্ত্রাভ্যন্তর হতে শাণিত ছুরিকা বের করতেই অসহায় সাধনার স্মরণ হলো মহাকারুণিক বুদ্ধের করুণাঘন উপদেশ অশরণের শরণ ত্রিশরণ। তখন সাধনা আকুল কণ্ঠে বলে উঠল

বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি  আমি বুদ্ধের শরণাপন্না হচ্ছি,

ধম্মং সরণং গচ্ছামি  আমি ধর্মের শরণাপন্ন হচ্ছি,

সংঘং শরণং গচ্ছামি  আমি সঙ্ঘের শরণাপন্না হচিছ।

যুগপৎ রত্নত্রয়ের গুণ স্মরণ করতে করতে সদ্য প্রসূত শিশু সন্তানকে সত্য ব্রতের পদ প্রান্তে রেখে দিয়ে গর্ভমল রঞ্জিত বসনা সাধনা আর্তকণ্ঠে কেঁদে উঠে তার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ল।  তখনি অদূরে সম্মুখে হঠাৎ সাধনার স্বামীর বস্তু গম্ভীর সাবধান বাণী শুনে সত্য ব্রত চমকে উঠতেই তার মুষ্ট্যাবদ্ধ ছুরিকা হস্ত থেকে খসে পড়ল।  শুনল সে কে রে নরাধম পাষন্ড, বোনের প্রতি তোর এ অবিচার! দাঁড়া, এখনি এর সমুচিত শিক্ষা দিচ্ছি।” তা শুনেই সত্য ব্রতের সর্বাঙ্গ থর থর কেঁপে উঠল, ভীত ত্রস্তপদে দৌড়ে সে গভীর অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

 

সাধনা সঠিক জানতে পারেনি নিষ্ঠুর সত্যব্রত তার পৃষ্ঠদেশে ছোরা বসিয়েছে কি না।  কারণ, মৃত্যু বিভীষিকায় তখন তার কোমলদুর্বল তনু মন সমাচ্ছন্ন।  পরে সাধনা একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বুঝতে পারল যে সে ছুরিকাহত হয়নি।  হলে, নিশ্চয়ই অনুভূত হতো তার শরীরে যন্ত্রণা।  তবে এ মৃত্যুর হাত থেকে যে সে বেঁচে গেল তা অন্য কারণে নয়, এতমাত্র তার অনাবিল ভ্রাতৃ প্রেম এবং সর্বজ্ঞ তথাগতের তথা ধর্ম ও সংঘের অতুলনীয় গুণ প্রভাবে।  ত্রিরত্নের অপার মহিমার কথা মনে পড়তেই সাধনা আবার বিষয় বিষ্ট অন্তরে মস্তক অবনমিত করল বন্দনা নিবেদনের উদ্দেশ্যে।

 

সাধনার এই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যাঁর আবির্ভাবে ব্যর্থকাম সত্যব্রত গহন অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল সে সাধনার স্বামী অনুপম নয়।  তিনি অনুপম রূপী ছদ্ম বেশী এক দেব পুত্র।  সত্য ব্রত সাধনাকে লক্ষ্য করে যে অমানুষিক কার্যে অগ্রসর হয়ে ছিল, দেবতার দেব হৃদয়ে তা সহ্য হলো না।  এমন এক মৈত্রী পরায়ণা ও ত্রিরত্নের শরণাপন্না নিরপরাধিনী নারী তাঁরই দিব্য দৃষ্টির মধ্যে অবমানিত ও নিহত হবে, দেবতার প্রাণে তা সহ্য হলো না।

 

সাধনার স্বামী রূপী ছদ্মবেশী দেব পুত্রকে মানবী সাধনার চিনতে পারার কোনো উপায় নেই। দেবতার সাব ধান বাণী শোনা মাত্রই সতাব্রত পালিয়ে বাঁচল।  তড়িৎ বেগে দেবতা এসে ভুমিতে অবলুণ্ঠিতা সাধনাকে বললেন “ভয় নেই, ভয় নেই, এই যে আমি ওঠো।” স্বামী অনুপমের কণ্ঠস্বর শুনে সাধনা কম্পিত কলেবরে উঠে বল এবং ভীত চকিত নেত্রে দেখতে লাগল চারিদিকে।  সম্মুখে দেখল অনুপম বেশী সেই দেব পুত্রকে।  সে তখন আর্তকন্ঠে কেঁদে উঠে বলল “তুমি? তুমি এসেছো! বাঁচাও প্রিয়তম। আমাকে বাঁচাও; রক্ষা করো তোমার বাছা ধনকে, দুধের শিশুকে। ” একথা বলতেই রমণী মুচ্ছিতা হয়ে ঢলে পড়ল।  দৈবশক্তির প্রভাবে অল্পক্ষণের মধ্যে সাধনার সংজ্ঞা ফিরে এলেও তার চোখে মুখে এখনও পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে ভয় বিভীষিকার ছাপ।  ভীতি বিহ্বল কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করল “আমার দাদা কোথায়?” ছদ্ম বেশী দেবতা উত্তর করলেন “তোমার দাদা! এখনও তাকে দাদা বলছো! সে পাষন্ড পালিয়ে গেছে।  আর কোনো ভয় নেই। ”

 

“প্রিয়তম, দাদা আমার এমন ছিলো না।  আমার প্রতি ছিল তার অগাধ স্নেহ।  সাধনা বলতে তার স্নেহ, মমতা, আদর ঝর্ণার মতো ঝরে পড়তো। আমার এ দেহ তার স্নেহ পুষ্ট, এক মাত্র তারই দয়ায়।  আমি লাভ করেছি তোমার মতো দেবদুলভ স্বামী।  সে নয়, তাকে প্ররোচিত করেছে, নিয়োজিত করেছে তার শয়তানী নরপিশাচী স্ত্রী।  বলো প্রিয়তম, আমার স্নেহময় দাদা নিরাপদে আছে তো?” “হ্যা, হ্যা আছে। আর বলো না সে ভগ্নী দ্রোহী পাতকীর কথা।  এখন চলো ঘরে ফিরে যাই। ” “হ্যাঁ, যাব প্রিয়তম, আমিও যেতে চাই; এখানে আর কিছু ক্ষণ থাকলে, আমি বাঁচবো না। ”

 

অনুপম রূপী দেবতা সাধনাকে হাত ধরে গো শকট তুলে দিলেন। দেবতার দিব্য স্পর্শে সাধনার শরীরে অপূর্ব শক্তির সঞ্চার হলো।  সে অনুভব করল পূর্ণ শান্তি ও স্বস্তি! শিশুকে কোলে করে দেবতাও গাড়ীতে উঠে বসলেন।  গাড়ী অনুপমের গৃহ অভিমুখে অগ্রসর হলো।  সতব্রতের আর গৃহে ফেরা হলো না।  সে যখন হাতে নাতে ধরা পড়ে গেল, তখন অনুপম এর প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না, এটাই সে ধারণা করে নিল।  সেই ভয়ে সত্য ব্রত অনাহারেই সারাটা দিন গহনারণ্যে আত্মে গোপন করে অতিবাহিত করল।


গাড়ী দেব মহিমায় অরণ্য ও প্রান্তির পথ অতি ক্রম করে অনতি বিলম্বে পল্লী প্রান্তে এসে পৌছল।  এত খানি দূরবর্তী পথ আসতে গাড়ীর কত সময়ের প্রয়োজন এবং কতটুক সময়ের মধ্যে যে গ্রাম প্রান্তে এসে পৌছল, সেদিকে সাধনার বিন্দু মাত্র লক্ষ্য নেই।  তার নারী জীবনে সদ্য সংঘটিত দুঃখময় ও বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের দারুণ উত্তেজনায় তার অন্তর তখন আলোড়িত হচ্ছে।  পথি পার্শ্বস্থ এক পান্থশালার সম্মুখে এসে গাড়ী থামল।  দেবতা শিশুকে কোলে করে গাড়ী থেকে নেমে পান্থশালায় প্রবেশ করলেন।  সাধনও এলো।  দেবতা তাকে বললেন “তুমি বড়ো ক্লান্ত হয়েছে; এক দিকে নয় শারীরিক মানসিক উভয় দিকে।  এই তো আমরা গ্রাম সীমায় এসে পৌছেছি, আর একটু পরেই বাড়ী পৌছা যাবে।তুমি খাকোকে নিয়ে একটু বিশ্রাম করো; আমি এই আসৃছি। ” বলে দেবতা কোথায় চলে গেলেন। 

 

দেবলীল সহজে বোঝা যায় না।  দেবতা চলে যাবার অল্প কালের মধ্যেই সাধনার প্রকৃত স্বামী অনুপম পান্থ শালার নিকট দিয়ে কোনো কাজে যাচ্ছিল।  সে দেখল পান্থ শালায় শিশু ক্রোড়ে স্ত্রী সাধনা বসে আছে।  তার বসন রক্ত রঞ্জিত।  দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল অনুপম।  কোনো এক নিদারুণ বিপদাশঙ্কায় তার হৃদয় কেঁপে উঠল।  রুদ্ধ উচ্ছাসের এক প্রবল বাধায় সহসা কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারল না।  ক্ষণকাল নীরব থেকে সে বলল “তুমি এবেশে এখানে কেন? খোকা এলো কখন? পান্থ শালার আশ্রয়ে কেন?”

 

স্বামীর এমন ধারা কৌতুক প্রশ্ন সাধনার একটুও ভালো লাগল না।  শরীর ও মনের কেমন একটা বিশ্রী অবসাদে সত্যই তার মধ্যে গ্লানি ভাব এসেছে।  সে বিরক্ত হয়ে বলল  “কি বলছো কিছুই বুঝতে পারছি না।  কৌতুকের একটা স্থান কাল আছে।  এসব এখন ভাল লাগে না।  সে পরে হবে, আগে আমাদের ঘরে নিয়ে চল।  এখন ঘরে পৌছতে পারলেই আমি বাঁচি। ” কৌতুক! এতে কৌতুকের কি আছে? তোমায় এবেশে, এ রক্ত রঞ্জিত বস্ত্রে পান্থ শালায় দেখে সত্যি আমি বিস্মিত হয়েছি।  তোমার দাদা ও বৌদি তোমায় তাড়িয়ে দেয়নি তো?”

 

কথা আর অধিক বাড়তে না দিয়ে সাধন বলল “খোকাকে তোমার কোলে করে, এই যে এক সঙ্গেই গাড়ী করে এলাম, আবার তোমার এতো প্রশ্ন কেন?” অনুপম সবিস্ময়ে বলল “আমি খোকাকে কোলে করে এক সঙ্গে গাড়ী করে এলাম, এ তো বড়ো আশ্চর্য কথা! তুমি তো আমায় বড়ো অবাক করলো! এ কি বলছো তুমি? সে কোন শে চার মাস পর এই মাত্র যে তোমার সঙ্গে আমার দেখা! তোমায় যে এখানে এমন সময, এ অবস্থায় এবেশে দেখবো, তা তো আমার চিন্তার অতীত ছিল।  ব্যাপার কি, সব খুলে বলো দেখি!”

 

সাধনা সবিস্ময়ে বলল “কি? তবে তুমি নও? যে আমার খোকাকে কোলে করে আমাকেও এক সঙ্গে গাড়ী করে নিয়ে এলো সে তুমি নও! মরণের পথ থেকে যে আমায় জীবনের পথে টেনে আনল, মৃত্যুর হাত থেকে যে আমায় রক্ষা করল, অভাগিনীর বিপদাপন্ন জীবনে যে অভয় মন্ত্র প্রধান করল  সে তুমি নও? তবে কে সে? কোন সে আমার জীবনের বন্ধু, কোন সে আমার জীবন দাতা? সে কি মানব না দেবতা! কিন্তু, সে যে তোমার মতো, তোমার আকৃতি, তোমার স্বর, তোমার চোখ, তোমার মুখ, তোমার বসন, তোমারই সব কিছু? না তবে সে।  মানব নয়? মানবে মানবে এতো মিল, এত সামঞ্জস্য সম্ভবই না। ” এসব বলতে বলতে সে ভক্তি বিস্ময়ে অবিভুত হয়ে পড়ল, অনুপমও।

 

সাধনা তার দুঃখ ভারাক্রান্ত কাহিনীর আদ্যন্ত স্বামীর নিকট প্রকাশ করল।  তা শুনে অনুপমের চোখ সজল হয়ে উঠল, যুগপৎ হর্ষ বিষাদ ও বিস্ময়ে পূর্ণ হলো তার অন্তর।  খোকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সাধনাকে বলল  যাক, যা হবার হয়ে গেছে; আমার খোকন মণির পুণ্যে সকল দিক রক্ষা পেয়েছে।  চলো এখন ঘরে যাই।” এ বলে খোকাকে নিয়ে।স্বামী স্ত্রী উভয়েই গৃহে প্রত্যাবর্তন করে স্বত্বির নিঃশ্বাস ফেলল।  সন্ধ্যা গত হলো সত্যব্রত এখনো বাড়ী ফেরেনি।  তার স্ত্রীর। উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পেল। কি করল, কি হল, চিন্তায় অস্থির গভীর রাত্রে সে চুপি চুপি বাড়ী ফিরে দেখল তার রাক্ষসী স্ত্রী গৃহদ্বারে বসে বাইরের দিকে শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। স্বামীকে এত রাত্রে বাড়ী ফিরতে দেখে সমুৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল “কেমন সাধনা সিদ্ধ তো?”

 

সত্যব্রত অনুচ্চ কণ্ঠে বলল “হ্যা, সাধনা সিদ্ধ বটে, কিন্তু সত্যব্রত অসিদ্ধ। ” বলে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল।  মুহূর্তেই হাস্যময়ী স্ত্রীর মুখ বিমর্ষ হয়ে উঠল দেখে সত্যব্রত বলল “দুঃখিত হয়ে মুখ ভার করো না, বরং সুখী হয়ে ভগবানকে ধন্যবাদ দাও যে তোমার স্বামী দেহে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছে। ”  স্বামীর এ উক্তিতে স্ত্রী ক্ষুব্ধ অন্তরে বলল “হয়েছে কি? পুরুষ মানুষ হয়ে সামান্য একটা কাজে গোটা দিন কাটিয়ে দিয়ে  এলে আধো রাত করে। ” “তোমার জন্য একাজ সামান্য হতে পারে, আমার নিকট কিন্তু।  অসামান্যের চেয়েও বড়। ” বলে সে সমস্ত বিবরণ স্ত্রীকে খুলে বল।  শুনে স্ত্রী যার পর নেই দুঃখিত হলো স্বামীর বিপদের জন্য নয়, সে যে এমন সুন্দর অলঙ্কার লাভে বঞ্চিত হলো সেই জন্য।

 

অপরদিকে অনুপম সতব্রতের এ ব্যবহারে যৎপরোনাস্তি ব্যথিক হলো। সে ইচ্ছা করল– রাজ দরবারে এর সুবিচার না চেয়ে ছাড়বে না।  কিন্তু ভ্রাতার প্রতি মমতা পরায়ণ সাধারণ অনুনয় ও বাধার এ ব্যাপারে আর কিছু করা হলো না।  বোনের অন্তর স্বর্গীয় স্নিগ্ধ প্রেমের উৎস, আর ভ্রাতার অন্তর নারকীয় নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ।  কিছু দিন গত হলে অনুপম ও সাধনা উভয়ে পরামর্শ করে ভগবান বুদ্ধকে তাদের গৃহে নিমন্ত্রণ করল।  যথা সময় তিনি উপস্থিত হলে সুস্বাদু খাদ্য ভোজ্য পরিবেশনে তাঁকে তৃপ্ত করলেন।  আহার কৃত্যের অবসানে স্বামী স্ত্রী উভয়ে খোকাকে নিয়ে ভগবানকে বন্দনা করল।  খোকার মাতা খোকার দ্বারাও কৃতাঞ্জলি পুটে সুগতের পাদ পদ্মে বন্দনা করাল।

 

তার পর সাধনা ভগবৎ সমীপে বিবৃত করল সমস্ত ঘটনা।  পরিশেষে নিবেদন করল  “ভগবান, আপনার প্রদত্ত ত্রিশরণ ও পঞ্চশীল ধর্ম সম্যক গ্রহণ ও প্রতি পালন জনিত মহা পুণ্য প্রভাবে আমার ও আমার খোকার জীবন রক্ষা পেয়েছে।  পরম শান্তির আকর বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের শরণ গুণের মহা প্রভাবে আমরা রক্ষা পেয়েছি, তাই আপনারই সম্মুখে আমার খোকার নাম করণ করা হলো ‘শরণ কুমার।  ভগবান বুদ্ধ তাদের অন্তরে চিত্তানুরূপ ধর্ম দেশনা করলেন।  নৈর্বণিক সত্য ধর্ম তাদের অন্তরে এমন এক অপূর্ব আলোক সম্পাত করল যে এতেই তাঁরত্রিবিধ সংযোজন হতে মুক্ত হলেন।  অনুপম ও সাধনা হলেন স্রোতাপন্ন।  শরণ কুমারের বযঃক্রম যখন বিশ বৎসর, সংসার ধর্মের প্রতি তাঁর বিরাগ উপস্থিত হলো।  অচিরে তিনি গৃহত্যাগ করে জিন শাসনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন।  বিদর্শন সাধনায় তিনি মনঃসংযোগ করে অর্হত্ত্ব ফল প্রত্যক্ষ করলেন।  কালে তিনি অর্হৎ শরণ স্থবির নামেই হলেন প্রসিদ্ধ।  ত্রিশরণাপন্না কাহিনী সমাপ্ত। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url