পঞ্চগতি

 পঞ্চগতি

গতি অর্থ গমন, মৃত্যুর পরবর্তী স্থানে গমন করা; সুগতি দুর্গতি অবস্থাতে গমন বুঝায়।  ইহা পাঁচ প্রকার, যথা: তির্যক গতি, প্রেত গতি, নির গতি মনুষ্য গতি ও দেব গতি।  মৃত্যুর পর (অহৎ ব্যতীত) সত্ত্বগণের চিত্ত এই পাঁচ প্রকার গতির মধ্যে যে কোনো একটি গতি লাভ করিয়া পুনর্জন্ম ধারণ করে।  উক্ত পাঁচ প্রকার গতি ব্যতীত সত্ত্বগণের জয় লাভের আর অন্য কোনো গতি নাই।  ভগবান বুদ্ধ স্বচক্ষে এই পাঁচ প্রকার গতি অবলোকন করিয়া বিস্তারিত বর্ণনা করিয়াছেন।  যেমন দ্বার বিশিষ্ট দুইটি গৃহের মাঝ খানে অবস্থান করিয়া কোনো চক্ষুষ্মন ব্যক্তি দেখিতে পায় কী রূপে মনুষ্যগণ গৃহে প্রবেশ করিতেছে, গৃহ হইতে বাহির হইতেছে, গৃহের মধ্যে চলা ফেরা করিতেছে এবং গৃহ মধ্যে উপবেশন করিতেছে, ঠিক তেমনই সর্বজ্ঞ বুদ্ধ দিব্য চক্ষুতে বিশুদ্ধ লোকাতীত দৃষ্টিতে দেখিতে পান সত্ত্বগণ মরিতেছে, মৃত্যুর পর কোথায় পুনর্জন্ম হইয়াছে এবং যাহারা জন্ম গ্রহণ করিয়াছে তাহারা কোথা হইতে আসিয়াছে। 


আরো দেখুন: ত্রিশরণাপন্ন


আরো দেখুন: নেশা পান করা কর্ম ফল


পঞ্চগতি

পঞ্চগতি

তিনি আরও দেখিতে পান সত্ত্বগণ স্ব স্ব কর্মানু সারে হীন উৎকৃষ্ট যোনিতে জন্ম গ্রহণ করিতেছে, সুবর্ণ দুর্বর্ণ, সুগতি দুর্গতি প্রাপ্ত হইতেছে; এই সকল সত্ত্ব কায় দুশ্চরিত, বাক দুশ্চরিত ও মনো দুশ্চরিত দ্বারা সমন্বিত হইয়া (অর্থাৎ ত্রিদ্বারে পাপ কর্ম সম্পাদন করিয়া) আর্যদের বা সৎপুরুষদের নিন্দাকারী হইয়া, মিথ্যা দৃষ্টি সম্পন্ন হইয়া মিথ্যা দৃষ্টি হেতু তদনু রূপ কর্ম সম্পাদন করিয়া দেহাবসানে মৃত্যুর পর তির্যক যোনিতে উৎপন্ন হয়।  এই সকল সত্ত্ব কায় দুশ্চরিত, বাক দুশ্চরিত ও মনো দুশ্চরিত দ্বারা সমন্বিত হইয়া (অর্থাৎ ত্রিদ্বারে পাপ কর্ম সম্পাদন করিয়া) আর্যদের বা সৎপুরুষদের নিন্দাকারী হইয়া, মিথ্যা দৃষ্টি সম্পন্ন হইয়া এবং মিথ্যা দৃষ্টি হেতু তদনুরূপ কর্ম সম্পাদন করিয়া দেহাবসানে মৃত্যুর পর প্রেত লোকে উৎপন্ন হয়া।  


এই সকল সত্ত্ব কায় দুশ্চরিত, বাক দুশ্চরিত, ও মনো দুশ্চরিত দ্বারা সমন্বিত হইয়া (অর্থাৎ ত্রিদ্বারে পাপ কর্ম সম্পাদন করিয়া) অর্যদের বা সাধু সৎপুরুষদের নিন্দাকারী হইয়া, মিথ্য দৃষ্টি সম্পন্ন হইয়া এবং মিথ্যা দৃষ্টি হেতু তদনু রূপ কর্ম সম্পাদন করিয়া দেহাবসনে মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি বিনি পাত নরকে উৎপন্ন হয়।  আর এই সকল সত্ত্ব কায় মনো বাক্যে অর্থাৎ ত্রিদ্বারে কুশল কর্ম সম্পাদন করিয়া আর্যদের বা সৎপুরুষদের নিন্দাকারী না হইয়া, সম্যক দৃষ্টি সম্পন্ন হইয়া এবং সম্যক দৃষ্টি অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করিয়া দেহাবসানে মৃত্যুর পর মনুষ্য লোকে উৎপন্ন হয়।  এই সকল সত্ত্ব কায় মনো বাক্যে অর্থাৎ ত্রিদ্বারে কুশল কর্ম সম্পাদন করিয়া আর্যদের বা সৎপুরুষদের নিন্দাকারী না হইয়া, সম্যক দৃষ্টি সম্পন্ন হইয়া এবং সম্যক দৃষ্টি অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করিয়া দেহাবসনে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়।


তির্যক: সত্ত্বগণের মধ্যে যাহারা অকুশল কর্ম (পাপ কর্ম) সম্পাদন করে, তাহারা মৃত্যুর পর তির্যক, অসুর, প্রেত ও নিরয় এ চারি অপায়ে জন্ম গ্রহণ করে।  অপায়স্থ সত্ত্বগণের আয়ু কর্মানু সারে হইয়া থাকে।  যে কর্ম বলে অপায়ে জন্ম হয়, সেই কর্ম ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত তাহার দুর্গতি ভোগ করে।  ভূমিবাসী প্রাণীদের মধ্যে যাহাদের মেরু দণ্ড সোজা উর্ধ্বমুখী নায়, অর্থাৎ সর্বদা তির্যক ভাবে পৃথিবীর সঙ্গে সমান্তরাল হইয়া চলাচল করে, তাহারাই তির্যক প্রাণী।  যেমন: পশু পক্ষী, কীট পতঙ্গ, জলচর প্রাণী ইত্যাদি।  তির্যক জাতির মধ্যে আহার, মৈথুন ও ভয় এই তিন সংজ্ঞা মাত্র বিদ্যমান।  তাহা ছাড়া তাহারা ভালো মন্দ কিছুই জানিতে পারে না।  কাজেই তাহাদের পক্ষে সদ্ধর্ম জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়।  তাহাদের জীবন সর্বদা মৃত্যু ভয়ে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত থাকে।  দণ্ড ভয়, অস্ত্র ভয়, হিংস্র প্রাণীর ভয় সহ নানা বিধ ভয়ের কারণে অরণ্যে, জলে, গুহায় ইত্যাদির আড়ালে তাহারা লকিয়ে লুকিয়ে বিচরণ কর। 


অন্য দিকে তির্যক প্রাণীদের গো যানে, অশ্ব শকটে ও লাঙলে যোজিত আত ভারী বোঝা কাঁধ নোয়ায়ে বহন করিতে বাধ্য হয়।  ভারী বোঝা বহনে অসমর্থ হইলেও বলিতে পারে না যে ‘আমি বহন করিতে অসমর্থ। অতি গরম, অতি শীত অবস্থায় এমনকি ক্ষুধার্ত ও পিপাসিত অবস্থায়ও ভীষণ কষ্ট সহ্য করিয়া তাহা নীরবে বহন করিতে হয়।  যখন বহনে অসমর্থ হয় তখন কশা ঘাত, বেত্রা ঘাত ও প্রহারে জর্জরিত হইতে হয়; অনাহারে, অর্ধাহারে থাকিতে হয় জীবনে কত বার, কত দিন তাহার কোনো ইয়ত্তা থাকে না।  নানা বিধ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসা বিহীন অবস্থায় ভোগ করিতে হয় ভীষণ দুঃখ কষ্ট।  তাহা ছাড়া মাংস লোলু পদের রসনা তৃপ্তির জন্য তির্যক প্রাণীকে অকালে বধ করা হয়।  সেই বধ জনিত (তির্যক প্রাণীর) অনুভূত দুঃখ কষ্টের কথা তো বলি বার অপেক্ষা রাখে না।  আর তির্যক প্রাণীর বৃদ্ধ কাল তো কাহারও অজানা নয়।  


সুতরাং তির্যক জীবন কোনো ভাবেই সুখের বলা চলে না।  সর্বদা দুঃখে জর্জরিত, মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় তাহারা কী রূপে পুণ্য অর্জন করিবে? বুদ্ধ বলিয়াছেন, মানুষের মধ্যে যাহাদের ভালো মন্দ জ্ঞান নাই, পশু পক্ষীদের ন্যায় যাহাদের আচরণ এবং যাহারা অজ্ঞান বা অচেতন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহারা তির্যক কুলে জন্ম গ্রহণ করে। প্রেত: নিরন্তর ক্ষুৎপিপাসায় পীড়িত বলিয়া প্রেত।  ইহারা অদৃশ্য প্রাণি বিশেষ।  প্রেত গণ শত, সহস্র, অয়ুত, লক্ষ, কোটি বৎসর, এমনকি এক বুদ্ধান্তর কল্প কাল পর্যন্ত কোনো আহার এমনকি এক বিন্দু জলও খাইতেহ পায় না।  দীর্ঘ কাল ক্ষুৎপিপাসায় জর্জরিত হইয়া তাহাদের রক্ত মাংস শুষ্ক হয়। তাহাদের শরীর ভীতি জনক, কঙ্কালময় ও কিম্ভুত কিমাকার অবস্থায় করিণত হয়। 


দেহের বড় বড় স্নায়ু গুলি ভাসিয়া ওঠে, পৃষ্ঠের অস্থি অস্থায় সঙ্গে উদরচর্ম লাগিয় যায়; দেহে ফাটল ধরে, আলু লায়িত (এলো মেলো) কেশে মুখ মণ্ডল ঢাকিয়া যায়।  তাহারা স্বীয় পাপ স্মরণ করিয়া অনুতাপ ও রোদন দিন করিতে করিতে দিগবিদিক ছুটা ছুটি করে।  পরে নিরুপায় হইয়া শ্রান্ত দেহে কোনো ময়লা যুক্ত দুর্গন্ধ ময় নিভৃত স্থানে এলো মেলো হইয়া বিশ্রী ভাবে পড়িয়া থাকে।  আর দীর্ঘ কাল পরে দৈব বাণী তাহাদের কর্ণ গোচর হয়  আসো, আসো, জল খাও, ভাজোন করো ইত্যাদি।  ইহা শুনিবা মাত্র প্রেত গণ আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও উঠিতে সক্ষম না হইয়া গড়াগ গাড়ি ও হামা গুড়ি দিতে দিতে বহু যোজন অগ্রসর হয় বটে; কিন্তু কোথাও খাদ্য ও জল খুঁজিয়া পায় না।  


তখন প্রেত গণ চিৎকার করিয়া ওঠে দাও, দাও, জল দাও, আহার দাও। তখন আবার আকাশ বাণী প্রেত গণের কর্ণ গোচর হয় নাই নাই নাই।  এই অসার বাণী প্রেত গণের অন্তরে বিষমিশ্রিত শেলের ন্যায় বিদ্ধ করে, তখন ছিন্ন তরুর ন্যায় পতিত হয় ভূমিতে।  এই ভাবে প্রেত লোকে প্রেত গণ আমরণ অসহ্য দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করিতে থাকে প্রেত গণ যদিও দেহ ধারী হয়, কিন্তু সাধারণ চোখে তাহাদের দেখা যায় না।  প্রেতদের কোনো পৃথক ভূমি নাই।  তাহারা মনুষ্য ভূমিতে অরণ্যে কিংবা ময়লা যুক্ত স্থানে অথবা কোনো দুর্গন্ধ ময় নিভৃত স্থানে বাস করে। বুদ্ধ বলিয়াছেন, মনুষ্য লোকে যাহারা লোভ পরায়ণ ও কৃপণ; বস্তু সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও নাই বলিয়া যাচক দের প্রতারণা ও বঞ্চনা করে, তাহারা মৃত্যুর পর প্রেতলোকে উৎপন্ন হইয়া উপরি উক্ত রূপে দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে।

 

নরক: নরক বা নিরয় হচ্ছে পাপী সত্ত্ব গণের উৎপত্তি স্থান।  লৌহ কুম্ভী নিরয়, উস্সদ নিরয়, পহাস নিরয় প্রভৃতি নিরয় সহ ৮টি মহা নিরয় আছে।  যথা: সঞ্জীব মহা নিরয়, কাল সুত্ত মহা নিরয়, সঙ্ঘাত মহা নিরয়, রোরুব মহা নিরয়, মহা রোরুব মহা নিরয়, তাপন মহা নিরয়, মহা তাপন মহা নিরয় ও অবীচি মহা নিরয়।  প্রত্যেক মহা নিরয়ের প্রত্যেক পার্শ্বে চারিটি চারিটি উস্সদ নিরয় আছে।  এই হিসাবে একটি মহা নিরয়ে ১৬ টি উস্সদ নিরয় এবং ৮ টি মহা নিরয়ের চতুষ্পার্শ্বে মোট ১২৮ টি উস্সদ নিরয় আছে।  প্রত্যেকটি নিরয় ভীষণ দুঃখ পূর্ণ। সেই গুলির মধ্যে অবীচি মহা নিরয় হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক।  এ জগতে যাহারা মহা পাপী তাহা দিগকে নরকের যমদূতেরা আসিয়া ধরিয়া লইয়া যায়।  এতদ্ব্যতীত যাবতীয় নরক গামী।  পাপী গণ মৃত্যুর পর স্বাভাবিক ভাবেই উস্সদ নিরয়ের পার্শ্বে (উপপাতিক রূপে) একটি নারকীয় দেহ ধারণ করিয়া থাকে। 

 

উপরি উক্ত নরক সমূহে পাপী সত্ত্ব গণ জন্মা ধারণ করিয়া সীমা হীন দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে।  এক একটি নরকের অবস্থা বা দুঃখ যন্ত্রণা এক এক রকম।  এখানে শুধু মাত্র অবীচি মহানিরয় সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোক পাত করা হচ্ছে: সর্বজ্ঞ বুদ্ধ পৃথিবীর গভীরতা ২ লক্ষ ৪০ হাজার যোজন বলিয়া বর্ণনা করিয়াছে।  তন্মধ্যে ১ লক্ষ ২০ হাজার যোজন শিলাময় পৃথিবী, তদুপরি ১ লক্ষ ২০ হাজার যোজন পাংশু পৃথিবী।  শিলা পৃথিবীর উপরে অবীচি মহা নিরয় অবস্থিত।  এ নিরয় চতুষ্কোণ বিশিষ্ট।  তাহা প্রজ্বলিত তীব্র লৌহ প্রচীরে (দেওয়ালে) পরিবৃত ও আচ্ছাদিত। ইহার প্রত্যেক পার্শ্ব এক একটি দরজা বিশিষ্ট এবং নীচের ভূমি ভাগ অগ্নিতে প্রজ্বলিত তেজ যুক্ত লৌহ দ্বারা আচ্ছাদিত।  এ নিরয় অগ্নির প্রখর তেজ সর্বদা মহা নিরয়ের চতুর্দিকে শত যোজন ব্যাপী বিস্তৃত থাকে।  

 

মহা নিরয়ের পূর্ব প্রাচীরের তীব্র অগ্নি শিখা পশ্চিম প্রাচীরে আঘাত করে, দক্ষিণ প্রাচীরের অগ্নি শিখা উত্তর প্রাচীরে আঘাত করে, এই রূপে পশ্চিম প্রাচীরের অগ্নি শিখা পূর্ব প্রাচীরে আঘাত করে, উত্তর প্রাচীরের অগ্নি শিখা দক্ষিণ প্রাচীরে আঘাত করে, নিম্ন হইতে উপরে এবং উপর হইতে নীচে তীব্র তেজোময় অগ্নি শিখা সর্বদা দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে।  স্বভাবত পাপী গণ মৃত্যুর পর উপ পাতিক (অযোনি সম্ভবা) রূপে নিরয়ে উৎপন্নহয়।  ইহাতে পাপী গণ অবিরত নরকা গ্নিতে দগ্ধ বিদগ্ধ হইতে থাকে এবং অগ্নি সন্তাপ সহ্য করিতে না পারিয়া যখন এদিক ওদিক ছুটা ছুটি করিতে থাকে, তখন উক্ত চারি দিক ও উর্ধ্ব অধোদিক এই ষড়দিক হইতে অজস্র তাল বৃক্ষ প্রমাণ জ্বলন্ত লৌহশূল বৃষ্টির মতো সজোরে বর্ষিত হইয়া পাপী দের দেহ ভেদ করিয়া থাকে। 


ইহাতে পাপীরা অসহ্য দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে।  নারকীয় সত্ত্বদের সর্বাঙ্গ পকৃবিস্ফোটক (পাকা ফোঁড়া) এর ন্যায় সর্বদা তীব্র যন্ত্রণা ময় হয়।  এই জন্য তাহারা সামান্য স্পর্শেও মহা দুঃখ অনুভব করে।  নিরয়ে কোনো কোনো নারকীয় দেহ ৩ মাইল ৩২০ গজ, কাহারও অর্ধযোজন, আর কাহারও এক যোজন দীর্ঘ হয়, তদনুযায়ী শরীরও বড় হয়, দীর্ঘ প্রস্থে শত যোজন বিস্তৃত মহা নিরয়ের লৌহময় ভূমি ভাগে এমন একটুও খালি স্থান নাই, যেই খানে নারকীয় প্রাণী দুঃখ ভোগ করিতেছে না।  সেই বিস্তীর্ণ ভূমি ভাগ নারকীয় প্রাণীতে পরি পূর্ণ, এ হেতু এ নিরয়কে অবীচি নিরয় বলা হয়।  তীব্র অগ্নি বীচি মালার বিরাম নাই বলিয়া ইহাকে অবীচি বলা হয়।  অবাচি নিরয় ব্যতীত আরও নানা বিধ নরক আছে, যেই খানে পাপী গণ তাহাদের কুকর্মের ফল ভোগ করে।  তবে পাপী গণ চির কাল বা অনন্ত কাল নিরয়ে অবস্থান করে এরূপ নহে। অকুশল কর্মের ফল ভোগ শেষ হইলে, যদি পূর্বাৰ্জিত পুণ্য সঞ্চিত থাকে, তাহা হইলে নিরয় হইতে সুগতি ভূমিতে জন্ম গ্রহণের সম্ভাবনা থাকে।

 

দেবদত্ত অবীচি মহা নরকে পতিত হইলে, তাহার দেহটি একশত যোজন দীর্ঘ ও তদনুযায়ী বড় হইয়া ছিল।  তাহার হাঁটু পর্যন্ত প্রজ্বলিত লৌহ ময় ভূমিতে নিমগ্ন হইয়া ছিল।  হস্ত দ্বয়ের কনুই পর্যন্ত উভয় পার্শ্বের অগ্নি ময় প্রাচীরে প্রবিষ্ট হইয়া ছিল এবং চক্ষুর উপরি ভাগস্থ মস্তক প্রজ্বলিত লৌহছাদে প্রবিষ্ট হইয়াছিল; ভূমিতল হইতে তাল বৃক্ষ প্রমাণ এক জ্বলন্ত লৌহ শূল উত্থিত হইয়া গুহ্য দ্বারে প্রবেশান্তর মস্তক ভেদ করিয়া উপরি ছাদে প্রবেশ করিয়া ছিল।  এই রূপে পশ্চিম প্রাচীর হইতে জ্বলন্ত লৌহ শূল নির্গত হইয়া বক্ষঃস্থল ভেদ করত পূর্ব প্রাচীরে প্রবেশ করিয়া ছিল। উত্তর প্রাচীর হইতে জ্বলন্ত লৌহ শূল নির্গত হইয়া পার্শ্ব দেশ ভেদ করত দক্ষিণ প্রাচীরে প্রবিষ্ট হইয়া ছিল।  এই ভাবে নিশ্চল অবস্থায় দেবদত্ত অবীচি মহা নিরয়ে এখানে অবর্ণ নীয় দুঃখ ভোগ করিতেছে।  তাহার কৃত পাপ কর্মের ফল শেষ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত নিরয়ে সে মহা দুঃখ ভোগ করিবে।  উপযুক্ত চারি অপায়ের দুঃখ জ্ঞাত হইয়া শীল প্রতি পালন করা আমাদের একান্ত কর্তব্য নয় কি?

 

মনুষ্য লোকে: সত্ত্বগণের মধ্যে যাঁহারা অকুশল কর্ম (পাপ কর্ম) হইতে বিরত হইয়া কুশল কর্মে (পুণ্য কর্মে) রত হন, তাঁহারা মৃত্যুর পর কর্মানু সারে মনুষ্য লোকে উৎপন্ন হন।  মানব জন্ম অতি দুর্লভ।  বহু সঞ্চিত পূরিত পুণ্য পারমীর ফলে মানব জন্ম লাভ হয়।  জীব গণের মধ্যে জ্ঞানে প্রজ্ঞায়, বুদ্ধি বিবেচনায়, ধ্যান সাধনায় মানুষই অদ্বিতীয়।  মানুষ ইচ্ছা করিলে রাজা মহা রাজা, স্বর্গ ব্রহ্মাদি সহ নির্বাণ পর্যন্ত লাভ করিতে পারে।  এই জন্য মনুষ্য ভূমিই হচ্ছে দুঃখ মুক্তির সাধন ভূমি।  অতীতের পাপ পুণ্যানুসারে মানুষের মধ্যে কেহ গরিব, কেহ ধনী; কেহ সুশ্রী, কেহ বিশ্রী; কেহ রোগী, কেহ নীরোগী;  কেহ জ্ঞানী, কেহ মূখ; কেহ সুখী, কেহ দুঃখী এই রূপ নানা বিধ পার্থক্য হইয়া থাকে।  একত্রিশ লোক ভূমির সত্ত্বগণের এই রূপ নানা বিধ পার্থক্যের মূল কারণ তাহাদের স্ব স্ব কর্ম।  তবে অজ্ঞানের কারণে সকল মানুষ তাহা অবগত নহে।  

 

সত্ত্বগণের মধ্যে যাহারা চির কাল সুখে অবস্থান করেন, তাঁহাদের কিন্তু দুঃখ সম্বন্ধে কিছুই উপলব্ধি হয় না।  উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, দেবলোকে দেবগণ সহস্র অস্পরা।  পরিবৃত হইয়া কাম সুখে এতই মত্ত থাকে যে, পুণ্য কর্মের কথা একবারেই বুলিয়া যায়, কারণ, স্বর্গে শুধু সুখই বিদ্যামান।  সেই কারণে তাঁহাদের দুঃখ মুক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হয় না।  মনুষ্য লোকে সুখ দুঃখ উভয়ই বিদ্যামান বলিয়া মনুষ্যগণ সুখ দুঃখকে উপলব্ধি করিতে সক্ষম হয় এবং দুঃখের কারণ জ্ঞাত হইয়া মুক্তির প্রয়াসী হয়।  পুণ্য ফলে যুগে যুগে মহা পুরুষগণও এই মনুষ্য ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করিয়া থাকেন।  পুণ্য ব্যতীত মনুষ্য কুলে জন্ম নেওয়া অসম্ভ।  অন্য দিকে, শীল রক্ষা ব্যতীত এই মানব জীবন একেবারেই বৃথা।


দেবলোক: সত্ত্বগণের মধ্যে যাঁহার অকুশল কর্ম (পাপ কর্ম) হইতে বিরত হইয়া কুশল কর্মে (পুণ্য কর্মে) রত হন, তাঁহার মৃত্যুর পর কর্মানুসারে স্বর্গলোকে উৎপন্ন হন।  কাম সুগতি ভুমি ৭টি (স্বর্গ ৬টি, মনুষ্য লোক ১টি)  পুণ্য বান সত্ত্বগণ ষড়বিধ স্বর্গে উপাতিক দেবতা রূপে উৎপন্ন হন।  তথায় কোনো দুঃখ নাই, শুধু সুখই বিদ্যমান।  স্বর্গের দেবগণ মানুষ্যর ন্যায় মাতৃগর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন না।  প্রত্যেক স্বর্গে এক একটি ‘নন্দনকানন’ নামে দিব্য পুষ্পোদ্যান (ফুলের বাগান) আছে।ধার্মিক ও শীবান মানুষ্যগণ মৃত্যুর পর ষোড়শ বর্ষীয় ‍যুবক যুবতীর অবয়বে (চেহারায় বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে) দিব্য দেহে (মাতৃগর্ভ ব্যতীত) ঐ নন্দনকানন উদ্যানে হঠাৎ প্রাদুর্ভূত হন।  ইহাকে উপপাতিক জন্ম বলা হয়। 


তখন র্স্বীয় পুণ্য প্রভাবে অনু পমা দিব্য রূপ সজ্জায় সজ্জিত বহু অপ্সরা (দেব কন্যা) ও সেবিকা তাঁহার (দেব পুত্রের) চতুষ্পার্শ্বে পরিবেষ্টিত হইয়া দিব্য নৃত্য গীত বাদ্যে তাঁহাকে অভি রমিত করে।  আনন্দময়ী অপ্সরা গণ আনন্দের কলহাস্যে দিব্য নৃত্য গীত বাদ্য পুষ্পমাল্যে ও আভরণে তাঁহাকে সজ্জিত করিয়া এক অনু পম দিব্য প্রাসাদে লইয়া যায়, যাহা স্বীয় পুর্ণ প্রভাবে উৎপন্ন হয়।  পুণ্যের তার তম্যানু সারে দেব প্রত্রগণ দিব্য পঞ্চকাম গুণে পরম সুখে সেই খানে অভি রমিত হয়।  দেবলোকে দেবগণের শীতোষ্ণ কিছুই অনুভূত হয় না।  তথায় বিষাক্ত পোকামাকড় ও মশাাছির কোনো উৎপাত নাই।  মানুষের ন্যায় তাঁহাদের গো কৃষি কাজ, ব্যবসা বাণিজ্যাদি করিতে হয় না।  তাঁহার বিদ্য বস্ত্র পরি ধান ও দিব্য আহার পরিভোগ করিয়া থাকেন।  তাঁহাদের আহার জনিত পায়খানা প্রস্রাবও হয় না।  তাঁহারা আকাশ চারী ও দিব্য জ্যোতি জ্যোতিষ্মান। 


মৃত্যুর পর তাঁহাদের দেহ অদৃশ্য হইয়া যায়।  ষড় বিধ স্বর্গে স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী এবং অর্হত্ত মার্গ ফল পর্যন্ত লাভ করা যায়।  কিন্তু যাহারা অনাগামী মার্গ ফল লাভ করেন, তাঁহারা শুদ্ধা বাস রূপব্রহ্ম ভূমিতে উৎপন্ন হন।  আর যাঁহারা অৰ্হত্ত্ব মার্গ ফল লাভ করেন, তাঁহারা অচিরেই পরি নির্বাণ প্রাপ্ত হন।  রূপ ব্রহ্ম লোক: রূপ ব্রহ্ম লোক ১৬টি। চারি প্রকার রূপ ধ্যান ব্যতীত রূপ ব্রহ্ম লোকে উৎপন্ন হওয়া সম্ভব নহে। তথায় সত্ত্বগণ উপ পাতিক দেবতা রূপে উৎপন্ন হইয় থাকেন।  তাঁহারা ধ্যান শক্তির দ্বারা নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল পর্যন্ত তথায় অবস্থান করেন।  সেখানেও কোনো দুঃখ নাই এবং কোনো আহারেরও প্রয়োজন হয় না। ধ্যানই তাঁহাদের এক মাত্র আহার।  ধ্যান সুখেই তাহারা সেই খানে অবস্থান করেন।  


তথায় সত্ত্বগণের কাম ভোগের কোনো বাসনা নাই এবং সেই খানে স্ত্রী আকারের কোনো সত্ত্ব নাই।  ১৬ প্রকার রূপব্রহ্ম ভূমির মধ্যে পঞ্চ শুদ্ধাবাস রূপ ব্রহ্ম ভূমিতে পৃথগজন, স্রোতাপন্ন এবং সকৃদাগামী ব্যক্তিগণ উৎপন্ন হন না।  সেই খানে শুধু অনাগামী ও অর্হতগণ অবস্থান করেন এবং তথা হইতে তাঁহারা পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন।  অসংজ্ঞ সত্ত্বরূপব্রহ্ম ব্যতীত অবশিষ্ট ১০ প্রকার রূপব্রহ্ম ভূমিতে ও পৃথগৃজন সহ চারি আর্য পুদগলেরা অবস্থান করিয়া থাকেন।  এই ভূমিতে যাহারা অৰ্হত্ত্ব লাভ করেন, তাঁহারা তথায় পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন।  অসংজ্ঞ সত্ত্ব রূপব্ৰহ্ম ভূমিতে উৎপন্ন সত্ত্বগণের চিত্তে কোনো সংজ্ঞা বা চেতনা থাকে না।  জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত অচৈতন্য অবস্থায় তাহারা সেই খানে অবস্থান করে। মৃত্যুর পর তাহাদের চিত্ত অন্য ভূমিতে জন্ম হইলে তখন চেতনা উৎপন্ন হয়। 


উল্লেখ্য, অসংজ্ঞ সত্ত্ব রূপব্রহ্ম ভূমিতে কোনো আর্যপুদ্গল উৎপন্ন হন না। অরূপ ব্রহ্মভূমি: অরূপ ব্রহ্মভূমি ৪টি।  চারি প্রকার অরূপ ধ্যান ব্যতীত অরূপ ব্ৰহ্মলোকে উৎপন্ন হওয়া যায় না।  তথায় উৎপন্ন সত্ত্বগণের রূপ বা দেহ থাকে না অর্থাৎ তাঁহারা অশরীরী।  ধ্যান শক্তির দ্বারা তাঁহাদের শুধু মন বা চিত্ত বিদ্যমান থাকে।  চারি অরূপ ভূমিতে স্রোতাপত্তি মার্গফল লাভ করা যায় না।  তবে অন্য ভূমিতে স্রোতাপত্তি মার্গফল লাভ করিবার পর অরূপ ভূমিতে উৎপন্ন হইলে উপরি মার্গ অর্থাৎ সকৃদাগামী, অনাগামী ও অর্হত্ত্ব মার্গফল লাভ করা যায়।  তাহার কারণ, প্রথম আর্য মার্গ স্রোতাপত্তি লাভ করিতে  হইলে নাম রূপ বিষয়ে সংমর্শন করিয়া অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম এই ত্রিলক্ষণ জ্ঞান আয়ত্ত করিতে হয়।  নাম রূপ লোকে সত্ত্বগণের রূপ সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান থাকে না।  এই জন্য উক্ত ভূমিতে স্রোতাপত্তি মার্গফল লাভ করা সম্ভব নয়।  অরূপ ভূমিতে যাঁহারা অর্হত্ত্ব মার্গফল লাভ করেন, তাঁহারা তথায় পরিনিবার্ণ প্রাপ্ত হন।  পঞ্চগতি সমাপ্ত। 

Next Post Previous Post
1 Comments
  • MN V
    MN V 15 March 2022 at 06:47

    সত্য ধর্ম জানার এবং উপলব্ধি করার জন্য এই সাইটটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Add Comment
comment url