দেবদূত সূত্র
দেবদূত সূত্র
ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীর অনাথ পিণ্ডিক নির্মিত জেতবন বিহারে অবস্থান করার সময় একদা তিনি ভিক্ষু গণকে সম্বোধন করে বলিলেন “হে ভিক্ষুগণ মনে কর দুই গৃহের মাঝ খানে কোন চক্ষুম্মান পুরুষ স্থিত হইলে সে যেমন দেখিতে পায়, কোন গৃহে কে প্রবেশ করিতেছে এবং কে বাহির হইতেছে। আরও দেখতে পায় গৃহ প্রবিষ্ট ব্যক্তির ইতস্ততঃ বিচরণ, উপবেশন ও কার্য কলাপ।
আমিও সেই রূপ লৌকিক লোকোত্তরের সন্ধি পথে অবস্থান করিয়া মানব চক্রের অতীত বিশুদ্ধ দিব্য চোখে সম্যক রূপে দেখতে পাই প্রাণীদের অবস্থা ও গতি। কোন কর্মে কোন প্রাণী হীন ও শ্রেষ্ঠ হয়, সুশ্রী ও বিশ্রী হয়, সুগতি ও দুর্গতি পরায়ণ হয়, কার কখন মৃত্যু হচ্ছে, মৃত্যুর পর কে কোথায় জন্ম নিচ্ছে এবং উৎপত্তি স্থলে কে কি রূপে সুখ দুঃখ ভোগ করছে।
আরো দেখুন: হেম বত্তসূত্র
আরো দেখুন: মানব জীবন
![]() |
দেবদূত সূত্র |
এটাও আমি বিশেষ ভাবে দেখিতেছি যে ইহ জগতে মানব গণ কায় বাক্য মনে। ত্রিরত্নের আশ্রয়ে কুশল কর্ম সম্পাদন করিয়া স্বর্গে ও মানব কুলে জন্ম গ্রহণ করিতেছে। আর যাহারা পাপী, মিথ্যা দৃষ্টি পরায়ণ, আয্য নিন্দুক ও মাতা পিতা প্রভৃতি গুরু বর্গের সেবা পূজা করে না অগৌরব করে তাহারা মৃত্যুর পর নরক, প্রেত, অসুর ও তির্যক কুলে জন্ম গ্রহণ করিয়া দারুণ দুঃখ ভোগ করিতেছে।
পাপী নিয়ে গমন করে। নিরয় পাল তাদেরকে যম রাজের নিকট নিয়ে যায়। যম রাজ
তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে “ওহে, তুমি এত পাপ কাৰ্য্য করিলে কেন? তখন পাপী বলে “ধর্মাবতার,
আমি বুঝিতে পারি নাই। তখন যম রাজ বিস্ময়ের
স্বরে বলে কি আশ্চর্য! তুমি কি “প্রথম দেব দূতের দর্শন পাও নাই। ” “কৈ ধর্ম রাজ, আমি
তো কোনও দেব দূতকে দেখি নাই। ”
কেন? তুমি কি মানব কুলে দুগ্ধ পোষ্য শিশুকে স্বীয় মল মুত্রে লিপ্ত হইয়া পড়িয়া থাকিতে দেখ নাই? “হ্যাঁ তাতো দেখিয়াছিপ্রভু।” “তাহাকেদেখে তুমি কিচিন্তা করনাই? এই শিশু পূর্ব জন্ম স্থান হইতে মৃত্যুর পর মানব কুলে জন্ম নিয়াছে, তুমিও যে সে জন্ম মৃত্যুর হাত এড়াইতে পার নাই। তুমিও মরবে আবার জন্ম নিবে। তা কি তুমি চিন্তা কর নাই? প্রভু আমার ভুল হয়েছে।
তুমি স্ত্রী পুত্রের মায়া মমতায় পড়িয়া, পুণ্য কাজ
করিতে ভুল করিয়াছ, অথচ পাপ কাজ করিতে ছাড় নাই, আমি তোমাকে কি করিব, তোমার কর্ম যে রূপ,
সে রূপ ফল তুমি ভোগ করিবে। তোমাকে এই পাপের ভাগী মাতা পিতা, ভাই বোন, জ্ঞাতি মিত্র,
শ্রামণ ব্রাহ্মণ ও দেবগণের মধ্যে কেহই হবে না, তোমার কর্ম ফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে।
তার পর যম রাজ বলেন ওহে, তুমি দ্বিতীয় দেব দূতের দর্শন পাইয়া ছিলে কি? প্রভু, আমি তো সেরূপ কাহাকেও দেখি নাই। “কেন, তুমি মানব কুলে এমন কোন নর নারী দেখিয়াছ? জরা জীর্ণ বক্র পৃষ্ট, লাঠির উপর ভার দিয়া কাপিতে কাপিতে গমন শীল, বার্ধক্য পীড়িত, দন্ত হীন, পক্ক কেশ, কেশ বিহীন, লোলিত চৰ্ম্ম; হ্যা প্রভু দেখিয়াছি। সকলকে সেই জরা রূপ দ্বিতীয় দেব দূত শিক্ষা দিতেছে যে, ওহে প্রমত্ত মানব, আমিও তোমাদের মত যুবক ছিলাম আমার শরীর বল তোমাদের মত ছিল।
এখন আমার শক্তি দুর্বল হইয়াছে। হাত পা থাকিয়াও কাজে লাগছে না।জরা হইতে মুক্ত হতে পারি নাই বলিয়া, আমাকে এই রূপ
দুর্দশা ভোগ করিতে হচ্ছে। আমার ন্যায় তোমাদেরও
এক দিন এই জরা দুঃখ আসিবে, সেই কারণে বৃদ্ধ না হইতেই পুণ্য কর্ম সম্পাদন কর।
ওহে পুরুষ! তুমি এই রূপ কত বৃদ্ধ দেখিয়াছ, অথচ ভাবনা কর নাই যে, আমিও এক দিন বৃদ্ধ হব। নিশ্চয়ই আমি এবার কায় বাক্য মন দ্বারা সুকর্ম সাধন করিব। কেন তখন তুমি যুবাবস্থায় বৃদ্ধ দেখিয়া সাব ধান হও নাই? প্রভু, আমার ভুল হইয়াছে। তুমি সাংসারিক বাসনায় মোহিত হইয়া পুণ্য কার্য করিতে ভুল করিয়াছ, অথচ। বৃদ্ধ কাল পর্যন্ত পাপ কর্ম হইতে বিরত হও নাই। এখন আমি তোমাকে কি করিব! তোমার অর্জিত কর্মানু রূপ ফল তুমিই ভোগ করিবে।
তোমার এই পাপের ভাগী মাতা
পিতা, ভাই বোন, জ্ঞাতি মিত্র, শ্রামণ ব্রাহ্মণও দেবগণের মধ্যে কেহই হই বার নয়। তোমার কর্ম ফল তুমিই ভোগ করিবে। তার পর যম রাজ পাপীকে আবার জিজ্ঞাসা করেন “ওহে,
তুমি মানব কুলে তৃতীয় দেব দূতের দর্শন পাইয়া ছিলে কি?” “না প্রভু, আমি তো দেখি নাই।
”
তুমি মানব দের মধ্যে ব্যাধি গ্রস্ত দুঃখীত স্ত্রী পুরুষকে শায়িতা অবস্থায় নিজের মল মূত্রে লিপ্ত এবং অপরের সাহাৰ্য্যে উঠিতে বসিতে ও পথ্যাদি সেবন করিতে কি দেখ নাই?” “হ্যাঁ দেব, তাহাতো দেখিয়াছি। ” ওহে তখন তুমি বুদ্ধি প্রাপ্ত এবং বৃদ্ধ হইয়াও কি এরূপ চিন্তা কর নাই? “আমিও। ব্যাধি ধর্ম পরায়ণ ব্যাধি ধর্মকে অতি ক্রম করিতে পারি নাই, সুতরাং নিশ্চয়ই আমি কায় বাক্য মনে কল্যাণ ধর্ম আচরণ করিব। ” “দেব প্রমাদ বশে তাহা করিতে সক্ষম হই নাই। ”
“ওহে, তুমি প্রমাদশে কায় বাক্য মনে কল্যাণ আচরণ কর
নাই, অথচ পাপ কাৰ্য্য করিতে ছাড় নাই সুতরাং তুমি প্রমাদ বশে যাহা পাপ কর্ম করিয়াছ। তাহা তোমার পিতা মাতা, ভাই, বোন, জ্ঞাতি, মিত্র,
শ্রামণ, ব্রাহ্মণ ও দেবতা কেহই। তোমার পাপের
অংশ নিবে না, তোমাকেই এই পাপের বিপাক ভোগ করিতে হইবে। ”
যম রাজ তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন “হে মানব, তুমি মানব কুলে চতুর্থ দেব দূতের দর্শন পাইয়াছ কি? না দেব, তাহা তো আমি দেখি নাই। ” “কি আশ্চর্য্য মানব দের মধ্যে চোরকে ধরিয়া রাজ পুরুষ গণ রাজ দণ্ডে দণ্ডিত করিতে কি তুমি দেখ নাই? “হ্যাঁদেব, দেখিয়াছি। ” “ওহেতখন তুমিবুদ্ধি বিবেচনা সম্পন্নবৃদ্ধ হইয়াও কিএরূপ চিন্তা করনাই?’ জগতে যাহারা পাপ কর্ম করে, তাদেরকে ইহলোকেই এরূপ বিবিধ শাস্তি প্রদান করে, পরলোকের কথাই বা কি? নিশ্চয়ই আমি কায় বাক্য মনে কল্যাণ কর্ম সম্পাদন করিব। ”
“প্রভু, তাহা আমি প্রমাদ বশে আচরণ করি নাই। ” ওহে, তুমি প্রমাদ বশে কল্যাণ ধর্ম আচরণ কর নাই অথচ পাপ কর্ম করিতে ছাড় নাই। প্রমাদিত হইয়া যে সমস্ত পাপ কর্ম করিয়াছ সেই পাপ তুমিই করিয়াছ। অন্য কেউ নয় তদ্বেতু তুমিই ইহার বিপাক ভোগ করিবে। যম রাজ পাপীকে আবার জিজ্ঞাসা করেন “ওহেতুমি মানবকুলে পঞ্চমদেব দূতের দর্শন পাইয়াছিলে কি?” “না প্রভু, তাহা তো আমি দেখি নাই।”
“তুমি মানব কুলে কোন স্ত্রী বা পুরুষের মৃত দেহ কি দেখ নাই? যেই মৃত দেহ এক দিন, দুই দিন, অথবা তিন দিন পরে পঁচিয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে, তাহা হইতে পুঁজ বাহির হইতেছে? হাঁ প্রভু দেখিয়াছি। “ওহে, তখন তুমি বৃদ্ধ হইয়াও কি এরূপ চিন্তা কর নাই “আমিও মরণ ধর্ম পরায়ণ, মরণ ধর্ম অতি ক্রম করিতে পারি নাই, সুতরাং আমি কায় বাক্য মনে কল্যাণ ধর্ম আচরণ কবির”? প্রভু, তাহা আমি প্রমাদ বশে চিন্তা করিতে সক্ষম হই নাই, ওহে তুমি প্রমাদ বশে কল্যাণ ধর্ম আচরণ কর নাই অথচ পাপ কর্ম করিতে ছাড় নাই, তুমি পাপ কর্ম করিয়াছ, তাহার বিপাক তোমাকেই ভোগ করিতে হইবে।
যম রাজ পাপীকে এই রূপে পঞ্চম দেব দূত সম্বন্ধে প্রকাশ করার পর নিরব হন। তখন নিরয় পাল গণ পাপীর দুই কর তলে দুইটি, দুই পদ তলে দুইটি এবং বক্ষ স্থলে একটি তাল বৃক্ষ প্রমাণ প্রজ্জ্বলিত লৌহ শূল বিদ্ধ করিয়া আবদ্ধ করে। এই পঞ্চ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া নারকী বর্ণনা তীত দুঃসহ দুঃখ বেদনা অনুভব করিতে থাকে। পাপ কর্মের বিপাক শেষ না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যু হয় না। দেবদূত সূত্র সমাপ্ত।